প্রবন্ধ রচনা : সাহিত্য পাঠের আনন্দ
সাহিত্য পাঠের আনন্দ
ভূমিকা : সাহিত্য জগৎ ও জীবনের দর্পণ । বৈত্র্যিময় জগৎ-জীবনের নিগূঢ় বার্তা রসের আধারে ধারণ করে সাহিত্য । মানবমনের অতলান্ত ভাবনাকে, প্রকৃতির অন্তর্নিহিত রহস্যকে সাহিত্যিক তাঁর সূক্ষ্মানুভূতিময় অন্তর্দৃষ্টির সাহায্যে অমৃতের রসধারায় সিক্ত করে আমাদের সামনে তুলে ধরেন। আমরা তাতে জগৎ-জীবনের খবর যেমন পাই, তেমনি আমাদের মনোবীণায় সঞ্চারিত হয় আনন্দের অপূর্ব সুরধারা। এককথায় জীবনকে পূর্ণতাদানের জন্য মানুষের কাছে সাহিত্যের আবেদন অনিঃশেষ ।
সাহিত্যের স্বরূপ : ‘সাহিত্য’ শব্দটির ব্যুৎপত্তি ‘সহিত’ শব্দ থেকে। এ শব্দটি পারস্পরিক সম্পর্কের একটি বাতাবরণ তৈরি করে। সাহিত্য এমন এক সেতুবন্ধ যা লেখকের সঙ্গে পাঠককে নিবিড় সম্পর্কে বাঁধে। কোন লেখনীর মাধ্যমে লেখকের ভাবনা, কল্পনা,অনুভূতি অকৃত্রিম সংবেদ্যতায় পাঠকের মনকে রসসিক্ত করে, তখনই সে লেখনীটি সাহিত্য পদবাচ্যের মর্যাদা লাভ করে। মানুষ সমাজ গড়েছে শুধু বস্তুগত প্রয়োজন মেটানোর তাগিদে নয়; বরং সমাজগঠনে মানুষের সবচেয়ে বড় তাগিদটি ছিল নিজেকে অন্যের সঙ্গে মেলানো; নিজের চিন্তা-ভাবনা, কল্পনা, হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনার বিচিত্র অন্তর্ময় অনুভূতিগুলোকে অন্যের কাছে গভীরতর তাড়না। ব্যক্তি নিজেকে সমর্পণ করতে চায় সমষ্টির মধ্যে; নিজের ভাবকে সঞ্চারিত করতে চায় অন্যের ভাবের মধ্যে; নিজের প্রাণের মধ্যে অনুভব করতে চায় অন্যের প্রাণের সাড়া। পারস্পরিক সাহচর্য মানবসভ্যতাকে দান করেছে বিশিষ্টরূপ। আর মানুষে মানুষে সাহচর্যলাভের সবচেয়ে প্রভাবসঞ্চারী ও নান্দনিক মাধ্যম হচ্ছে সাহিত্য। সাহিত্যে মানুষের বিচিত্র ভাবের প্রকাশ ঘটে শুধু তা-ই নয়; রসমণ্ডিত হয়ে বাস্তবনিষ্ঠ ও জীবনঘনিষ্ট রূপ লাভ করে। জগৎ ও জীবনের বিচিত্র বিষয় সাহিত্যের উপজীব্য এবং তা মানুষের বিচিত্র রস পিপাসা মিটানোর জন্য বিচিত্র আঙ্গিকে রূপলাভ করে। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, “ ভাবকে নিজের করিয়া সকলের করা ইহাই সাহিত্য, ইহাই ললিতকলা ।”
সাহিত্যপাঠের উদ্দেশ্য : সাহিত্যপাঠের প্রধান উদ্দেশ্য আনন্দলাভ। লেখক নিজের চিত্তকে পরিতৃপ্ত করতে তাঁর রসভূবন তৈরি করেন; আর পাঠক সেই ভুবনে অবগাহন করেন আনন্দরসে সিক্ত হওয়ার অভিপ্রায়ে। মানবহৃদয়ের বিচিত্র অভিব্যক্তি ও ব্যঞ্জনা উপলব্ধি করা যায় সাহিত্যপাঠের মাধ্যমে। সাহিত্যপাঠে পাঠকের মনে যেমন নির্মল আনন্দানুভূতির সৃষ্টি হয়; তেমনি বিচিত্র জ্ঞানে সমৃদ্ধ করে পাঠকের মননকে। সাহিত্য মানুষের জীবনচর্যার সমগ্রতাস্পর্শী মাধ্যম। ত্যাগে, ভোগে, আত্মদানে, মহত্ত্বে, বীরত্বে অথবা এসবের বৈপরীত্যে মানুষ যে জীবন যাপন করে; যে রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক পরিবেশে জীবন যাপন করে তার চড়াই-উত্রাই ও বিবর্তনের ইতিবৃত্ত; ভ্রমণবৃত্তান্ত, দুঃসাহসিক অভিযান, বিজ্ঞানের আবিষ্কার, দেশ-দেশান্তরের ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিক পরিচয়, সামাজিক আচার-আচরণ অর্থাৎ মানবজীবন ও বৈচিত্র্যময় জগতের সকল প্রান্তের সংবাদ নিয়েই শিল্প-সাহিত্যের বহুমুখী স্রোতোধারা। সাহিত্যপাঠে মানুষের মনের দিগন্ত উন্মোচিত ও প্রসারিত হয়; উঁকি দেয় মুক্তচিন্তা; মন হয় পরিশুদ্ধ ও নির্মল ।
সাহিত্যপাঠের প্রয়োজনীয়তা : সাহিত্যের সাধনা সত্য ও সুন্দরের সাধনা। সাহিত্যের মধ্য দিয়ে আমরা জগৎ ও জীবনের চিরায়ত সত্য ও সুন্দরকে অনুধাবন করি। ঋদ্ধ মননশীলতা, অপার সৃজনশীলতা আর সূক্ষ্ম অনুভবময়তার কারণেই শিল্পী-সাহিত্যিকেরা মানবসমাজের সবচেয়ে অগ্রসর অংশ। অনুভূতির সূক্ষ্ম শিকড় চাড়িয়ে শিল্পী-সাহিত্যিকেরা জগতের অপার রহস্যজাল থেকে সত্য ও সুন্দরকে ছেনে বের করে তার অমৃতরস আমাদের সামনে তুলে ধরেন। পাঠক সেই রসসুধা পান করে এক অনাবিল আনন্দে পরিপ্লাবিত হয়; পাশাপাশি যে সত্য-সুন্দরের বার্তা পায় সাহিত্যে, তারই আলোকে সাজায় আপন জীবন-ভুবন। সাহিত্যপাঠে মানুষ অর্জন করে পরিচ্ছন্ন চিন্তা ও মুক্তবুদ্ধি, যা সকল ক্ষুদ্রতার বন্ধন মুক্ত করে তাঁকে উপনীত করে মহত্ত্বের উপলব্ধিতে । সাহিত্য মানুষের মনে নান্দনিকতার বোধ জাগায়, জগৎ ও জীবনকে দেখার শৈল্পিক দৃষ্টি দান করে। সাহিত্য মানুষকে উন্নত রুচিবোধ ও চিন্তা-চেতনার সন্ধান দেয়। সাহিত্য শুভবোধে উদ্দীপ্ত কল্যাণময় ও সৌন্দর্যময় জীবন বিনির্মাণের রসদ জোগায়। ফলত সাহিত্যপ্রেমী মানুষের প্রতিটি কর্মে ও আচরণে শিল্পের ছোঁয়া থাকে।
মানবতার বাণী সাহিত্যে মন্ত্রের মতো উচ্চারিত হয়; শোষণ, বঞ্চনা, উৎপীড়ন, নিষ্ঠুরতা আর সহিংসতার বিরুদ্ধে সাহিত্যের উচ্চারণ অত্যন্ত বলিষ্ঠ। সত্য, সুন্দর ও কল্যাণের মন্ত্রে উজ্জীবিত করে সাহিত্য বিশ্বময় মানুষকে সম্প্রীতির বন্ধনে বাঁধে। সাহিত্য জাতীয় জাগরণ, স্বাধীনতা সংগ্রাম, স্বাধিকারের দাবি উচ্চারণের মাধ্যমে পরাধীন, অধিকার-বঞ্চিত মানুষের মনে জাতীয় চেতনার উন্মেষ ও বিকাশ ঘটায়।
সাহিত্যে সমাজ, সংস্কৃতি তার ইতিহাস-ঐতিহ্যসমেত সমগ্র চেহারা নিয়ে প্রতিফলিত হয়। সমাজের সকল শ্রেণির মানুষের বৈচিত্র্যময় জীবনের আনন্দ-বেদনা, আশা-আকাঙ্ক্ষা, সংকট-সম্ভাবনার চিত্র বাঙ্ময় হয়ে ওঠে সাহিত্যে। তাই সাহিত্যপাঠে সমাজকে জানা যায় অনুপুঙ্ক্ষরূপে।
সত্য-সুন্দরের সাধনায় জীবনকে মহিমান্বিত করার ক্ষেত্রে সাহিত্যের ভূমিকা অনন্য। এটি সাহিত্যের উপযোগের দিক; কিন্তু গৌণ দিক মাত্র। দৈনন্দিন জীবনে কর্মে ক্লান্ত, হতাশায় নিমজ্জিত, সমস্যায় ক্লিষ্ট মানবমন চায় একটু স্বস্তির অবসর; প্রত্যাশা করে ক্লান্তিদায়ী ভুবনের প্রতিস্পর্ধী অন্য ভুবন, যে ভুবন স্বপ্নের, আনন্দের, রোমাঞ্চের। আমরা যখন শোকে বিহ্বল, আনন্দে আত্মহারা আর হতাশায় বিধ্বস্ত হই তখন জ্ঞান-বিজ্ঞান-দর্শন আমাদের এ অনুভূতি জগৎকে সাহায্য করতে পারে না। ক্লান্ত-বিধ্বস্ত-অবসাদগ্রস্ত মনে আনে অনাবিল শান্তি। সাহিত্য প্রাণের ভাষায় প্রাণের কথা বলে। তাই সাহিত্য প্রাণে প্রাণে প্রেরণা ছোটায়, স্পন্দন জাগায়। কবি ওমর খৈয়াম তাই বেহেশতের আসবাবপত্রের ফিরিস্তি বানাতে গিয়ে কাব্যগ্রন্থের কথা ভুলেননি : রুটি,মদ হয়তো নিঃশেষ হয়ে যাবে, সাকি ক্লান্ত হয়ে পড়বে, কিন্তু অমর কাব্য তার সাথে থাকবে অনন্ত যৌবনা সঙ্গিনীর মতো।
উপসংহার : মানুষের হৃদয়ানন্দে সৃষ্টি হয়েছে সাহিত্য; সাহিত্যে বিম্বিত হয়েছে মানুষের আপন অন্তরতম সত্তার পরিচয়। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন : “গোলাপের সৌন্দর্য আমি যে উপভোগ করছি তা এমন করে প্রকাশ করতে হয়, যাতে তোমার মনেও সৌন্দর্যভাবের উদ্রেক হয়।” সাহিত্যিক তাঁর সাহিত্যকর্মে যে আনন্দরসের সঞ্চার করেন, তা উপলব্ধির জন্য পাঠককেও প্রস্তুত হতে হয়। সাহিত্যের জগৎ থেকে আনন্দ লাভের জন্য মানুষকে অধ্যবসায়ী হতে হয়। তবেই সাহিত্যপাঠের আনন্দ দীর্ঘদিন মানুষের মনকে সুরভিত রাখে।