প্রবন্ধ রচনা : পরিবারে নৈতিক শিক্ষা
পরিবারে নৈতিক শিক্ষা
মানুষ সামাজিক জীব, কিন্তু তার জীবনের শুরু হয় পরিবার থেকে। সামাজিক হওয়ার জন্য মানুষকে রপ্ত করতে হয় কিছু আচার-আচরণ, রীতিনীতি ও মূল্যবোধ; আত্মকেন্দ্রিকতার বৃত্ত ভেঙে নিজেকে গড়তে হয় সমাজের উপযোগী করে; নিজেকে শাণিত করতে হয় সমষ্টিচেতনায়; নিজেকে নিবেদন করতে হয় পরার্থপরতায়। যে প্রক্রিয়ায় মানুষ আদিম প্রবৃত্তি ত্যাগ করে নিজের অন্তর্নিহিত শক্তির বিকাশ ঘটিয়ে উন্নত মূল্যবোধসম্পন্ন সত্তায় পরিণত হয় তা-ই শিক্ষা। শিক্ষা মানুষকে করে কর্মদক্ষ, মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিকে করে তীক্ষ্ন, মানুষের বিবেককে করে পরিচ্ছন্ন, রুচি ও মূল্যবোধকে করে উন্নত। এক কথায়, শিক্ষাই মানুষের সার্বিক বিকাশের একমাত্র উপায়। আর নৈতিক শিক্ষা হলো সেই শিক্ষা যা মানুষের মধ্যে শুভ ও কল্যাণচিন্তার উন্মেষ ঘটায়, যার প্রভাবে ভাল-মন্দের তফাৎ নির্ণয় করে মানুষ ভালর পক্ষে অবস্থান নিতে পারে, মানুষ পরার্থে নিজেকে উৎসর্গ করতে পারে। সমাজে একজন মানুষকে আমরা যে ভূমিকায় পাই তার বুনিয়াদ নির্মিত হয় পরিবারে। অর্থাৎ পরিবার ও শিক্ষা পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত এবং নীতি-আদর্শ শিক্ষায় পরিবারের ভূমিকা অপরিসীম। মানুষের একসঙ্গে থাকা ও সামবায়িকভাবে প্রতিকূলতা মোকাবেলার প্রয়োজন থেকে সমাজ গড়ে উঠেছে। আর সমাজ গড়ে তোলার পেছনে সক্রিয় রয়েছে মানুষের পারস্পরিক দায়বদ্ধতা— সহমর্মিতা, সহযোগিতা, স্বার্থত্যাগের মানসিকতা । সমাজ গঠিত হয় বিভিন্ন পরিবারের সমন্বয়ে। আর পরিবার হলো পিতা-মাতা, ভাই-বোন, দাদা-দাদি ও অন্যান্য রক্ত-সম্পর্কীয় আত্মীয়-স্বজন, যারা এক সঙ্গে একই বাড়িতে থাকে, তাদের নিয়ে গঠিত সংসার। একটি শিশুর জন্মের পর থেকেই তার শিক্ষার শুরু হয়। জন্মগ্রহণের পর শিশুর সকল নির্ভরতা তার পরিবার, বিশেষত মা-বাবার ওপর। তার শেখার শুরুও মা- বাবার কাছ থেকেই । বাবা-মা ও পরিবারের অন্য সদস্যদের নীতি-আদর্শেই বেড়ে ওঠে শিশু। ঘরেই শুরু হয় শিশুর প্রথম পাঠ আর মা-বাবাই শিশুর প্রথম শিক্ষক। একটি সুন্দর পারিবারিক পরিবেশই শিশুর পরিপূর্ণ শারীরিক, মানসিক ও আত্মিক বিকাশ এবং সফলতার জন্য উপযুক্ত স্থান। পরিবারে নৈতিক ও মূল্যবোধ শিক্ষার ভিত দৃঢ় হয়; এ সময়ে শিশুকে যা দেখানো ও শেখানো হয় তা-ই তার চেতনাজগতের মৌল ভিত্তি নির্মাণ করে দেয়। পারিবারিক শিক্ষার আলোকে শিশু পরবর্তীতে সমাজ ও প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষা নেয়। পরিবারের সদস্যদের যাপিত জীবন গভীর ছাপ ফেলে শিশুর চেতনায় । পরিবারের সদস্যরা সুশৃঙ্খল জীবনে অভ্যস্ত হলে শিশুও ভাল মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠে। অন্যদিকে পরিবারের সদস্যরা উচ্ছৃঙ্খল ও অনৈতিক জীবন যাপন করলে শিশু বিপথে পরিচালিত হবে— এটাই স্বাভাবিক। পারিবারিক প্রভাবে সে হবে একজন অনৈতিক, অসৎ ও নীতিবিবর্জিত মানুষ; যে দেশ, জাতি ও সমাজের জন্য বিপজ্জনক ।
কোন কিছু সৃষ্টির জন্য দৃঢ় ভিত্তির প্রয়োজন হয়; ভিত্তি যত মজবুত ও শক্ত হয় নির্মিত জিনিসের প্রতিকূলতা জয় ও টিকে থাকার ক্ষমতাও তত বেশি হয়। পরিবার একজন শিশুর গড়ে ওঠার প্রাথমিক ভিত নির্মাণ করে দেয়। জীবনের শুরুতেই যদি একটি শিশু সদগুণাবলি অর্জন করতে পারে, তাহলে পরবর্তী জীবনে বাইরের কোন প্রভাব তার নীতি আদর্শকে টলাতে পারবে না। তাই শিশুর আদর্শ চরিত্র গঠনে পরিবারই যথার্থ ও আসল ভূমিকা পালন করতে পারে । জন্মের পর একটি শিশু সাদা কাগজের অলিখিত পৃষ্ঠার মতো; অথবা এ সময়টিকে তুলনা করা যায় কাদা মাটির সঙ্গে। সাদা কাগজটিতে যা ইচ্ছা তা-ই লেখা সম্ভব, আর নরম মাটিকে ইচ্ছেমত আকৃতি দেওয়া খুবই সহজ। সাদা কাগজের পৃষ্ঠা কোন লেখায় পূর্ণ হবে তা যেমন নির্ভর করে লেখকের মেজাজ, রুচি আর দক্ষতার ওপর এবং নরম মাটি দিয়ে কী তৈরি হবে ও তা কতটা শৈল্পিক হবে তা যেমন নির্ভর করে কারিগরের শিল্প প্রতিভার ওপর, তেমনি একজন শিশু কোন রুচি, আদর্শ ও নীতির মানুষ হবে তা প্রকৃতই নির্ভর করে তার মা-বাবা ও পরিবারের সদস্যদের আচার-আচরণ, শিক্ষা, রুচি ও নৈতিক আদর্শের ওপর। পরিবারের মানুষদের প্রতিদিনের আচরণ, কথাবার্তা, চলাফেরা, কাজকর্ম, ব্যবহার ইত্যাদি শিশু অবচেতনে নিজের চেতনায় শুষে নিয়ে নিজের চেতনাজগৎ নির্মাণ করতে থাকে। পারিবারিক পরিবেশ যদি হয় শান্তিময়, ভালবাসাপূর্ণ, রুচিস্নিগ্ধ ও নৈতিক মূল্যবোধে শাণিত, তাহলে শিশুটি অবধারিতভাবেই হবে শান্তিপ্রিয়, ভালবাসায় পরিপূর্ণ হবে তার অন্তর, রুচির ছাপ থাকবে তার কথায় ও কর্মে, নৈতিক মূল্যবোধে তার জীবন হবে সমুন্নত। যে শিশু ভালবাসার মধ্যে বড় হয় সে কখনো সহিংস ও নিষ্ঠুর হতে পারে না; যে শিশু নৈতিক মূল্যবোধের মধ্যে বেড়ে ওঠে, তার মধ্যে হীনতা, নীচতা ও অনৈতিকতাকে প্রশ্রয় দেবে না; যে শিশু সদাচারের মধ্যে বড় হয় সে কখনো অন্যের সঙ্গে আচরণে রূঢ় হতে পারে না। অর্থাৎ শিশু পরিবার থেকে যা শেখে তা-ই তার চেতনার গভীরে স্থায়ী হয় এবং তার সারা জীবনের আচরণ ও কর্মকে নিয়ন্ত্রণ করে। যেহেতু একটি শিশু তার পরিবারের সদস্যদের অনুসরণ করে তাই শিশুর সার্বিক বিকাশের জন্য পরিবারের সদস্যদের দায়-দায়িত্বও অনেক। যেমন সন্তানের সামনে ঝগড়াঝাটি না করা, খারাপ ভাষায় কথা না বলা, নেশা না করা, অনৈতিক কোন কাজ না করা, ধর্মীয় ও নৈতিক অনুশাসন মেনে সুশৃঙ্খল জীবন যাপন করা, আদর্শ ব্যক্তিদের জীবনী সম্পর্কে শিশুদের আগ্রহী করা- এসবের মাধ্যমে শিশুর মধ্যে ইতিবাচক জীবনবোধের বার্তা ও আদর্শ পৌঁছে দিতে পারলে শিশু তার জীবনের পথটি সহজেই চিনে নিতে পারবে। একটি সুশিক্ষিত, ভাল, সৎ, রুচিশীল পরিবারের আগামি প্রজন্ম নীতি-আদর্শ শিক্ষায় অনুপ্রাণিত হবে— এটাই স্বাভাবিক। আর একটি অসৎ পরিবারের সন্তান আদর্শবান ব্যক্তি হবে তা কল্পনা করাও অযৌক্তিক।