বাংলা রচনা : নাগরিক অধিকার ও কর্তব্য

বাংলা রচনা : নাগরিক অধিকার ও কর্তব্য
নাগরিক অধিকার ও কর্তব্য

নাগরিক অধিকার ও কর্তব্য

[সংকেত: ভূমিকা; সুনাগরিক ও কল্যাণমূলক রাষ্ট্র, নাগরিক অধিকার; সামাজিক অধিকার;রাজনীতিক আধকার; অধিকার; সামাজিক অধিকার; রাজনীতিক অধিকার; আর্থনীতিক। অধিকার; নাগরিকের কর্তব্য; নাগরিকের অধিকার ও কর্তব্যের স্বরূপ; নাগরিক অধিকার ও কর্তব্যের সম্পর্ক; নায়ক মে অর্জন; বাংলাদেশের সংবিধানে নাগরিক অধিকার ও কর্তব্য: বাংলাদেশে নাগরিক কর্তব্য; উপসংহার।]

ভূমিকা : রাষ্ট্রের স্থায়ী বাসিন্দাদের নাগরিক বলা হয়। যারা রাষ্ট্র প্রদত্ত সকল সামাজিক ও রাজনীতিক অধিকার ভােগ করে এবং রাষ্ট্রের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করে তারাই নাগরিক। নাগরিকের মর্যাদাকে নাগরিকতা বলে । নাগরিক যদি যথাযথভাবে তার দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করে তাহলে তার নাগরিকতার মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। নাগরিক হলাে সেই ব্যক্তি যে স্থায়ীভাবে রাষ্ট্রে বাস করে, রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করে, রাষ্ট্র প্রদত্ত সকল অধিকার ভােগ করে এবং রাষ্ট্রের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করে । শব্দগত অর্থে নগরের অধিবাসীকে নাগরিক বলে। যেমন- ঢাকার নাগরিক, লন্ডনের নাগরিক, দিল্লির নাগরিক । কিন্তু জাতীয় রাষ্ট্রের উদ্ভবের। ফলে নাগরিকতা কোনাে নগরকে কেন্দ্র করে হয় না বরং জাতীয় রাষ্ট্রকে কেন্দ্র করে হয়। যেমন : বাংলাদেশের নাগরিক, ভারতের নাগরিক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক ইত্যাদি। আর অধিকার ভােগ ও কর্তব্য পালনের মাধ্যমে নাগরিক জীবন বিকাশ লাভ করে । অধিকারের মাত্রা এবং কর্তব্য পালনের দ্বারা একটি দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার স্বরূপ জানা যায়। সুতরাং নাগরিক জীবন ও শাসনব্যবস্থার উৎকর্ষতা অধিকার ও কর্তব্যের চর্চার মধ্যে নিহিত।

সুনাগরিক ও কল্যাণমূলক রাষ্ট্র : কল্যাণমূলক রাষ্ট্রে সুনাগরিকের প্রয়ােজন। সুনাগরিককে রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য প্রকাশসহ রাষ্ট্রের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এবং আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নে সচেষ্ট থাকতে হয় । রাষ্ট্রের স্থায়িত্ব, স্থিতি, সমৃদ্ধি, সৌভাগ্য, সুনাম। ও সমষ্টিগত স্বার্থের প্রতি সুনাগরিককে বিশেষভাবে লক্ষ রাখতে হয়। কল্যাণমূলক রাষ্ট্র গঠনে দেশপ্রেমের অনুভূতিপরায়ণ নৈতিক ও দায়িত্ববান সুনাগরিকের প্রয়ােজন।

নাগরিক অধিকার : অধিকার বলতে সাধারণভাবে ইচ্ছামতাে কাজ করার ক্ষমতাকে বােঝায় । কিন্তু যথেচ্ছাচার অধিকার হতে পারে না। কারণ তাহলে কেউ কাউকে খুন করলে সেটি তার অধিকার হয়ে যায় । পৌরনীতিতে অধিকার বলতে রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত কতকগুলাে সুযােগ-সুবিধাকে বােঝায়, যা দ্বারা ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটে। অধ্যাপক লাস্কি বলেন, অধিকার হলাে সমাজ জীবনের সে সকল অবস্থা (সুযােগ-সুবিধা) যেগুলাে ছাড়া মানুষ তার ব্যক্তিত্বকে উপলদ্ধি করতে পারে না। অধিকারকে প্রথমত দুভাগে ভাগ করা হয় । যথা : 
  • ক. নৈতিক অধিকার। 
  • খ. আইনগত অধিকার। 
আইনগত অধিকারকে আবার তিন ভাগে ভাগ করা হয়। যেমন-
  • সামাজিক, 
  • রাজনীতিক ও 
  • আর্থনীতিক অধিকার।


১. সামাজিক অধিকার : নাগরিক জীবনের বিকাশ এবং ব্যক্তিত্বের উৎকর্ষের জন্য রাষ্ট্রকে যে সকল অধিকার সংরক্ষণ করতে হয় তাদের সামাজিক অধিকার বলে । সামাজিক অধিকারগুলাের মধ্যে জীবনধারণের অধিকার, চলাফেরার অধিকার, সম্পত্তি ভােগের। অধিকার, চুক্তি করার অধিকার, মতামত প্রকাশের অধিকার, সংবাদপত্রের স্বাধীনতার অধিকার, সভা-সমিতির অধিকার, ধর্মীয় অধিকার, আইনের চোখে সমান অধিকার, পরিবার গঠনের অধিকার, ভাষা ও সংস্কৃতির অধিকার ও খ্যাতি লাভের অধিকার। উল্লেখযােগ্য। সামাজিক অধিকারগুলাে যথাযথভাবে সংরক্ষণের মাধ্যমে সকলের জন্য অধিকার ভােগের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারলে নাগরিক জীবন উন্নত ও বিকশিত হয়।

২. রাজনীতিক অধিকার : রাজনীতিক অধিকারের মাধ্যমে মানুষ রাষ্ট্রের কাজে অংশগ্রহণের সুযােগ পায় । রাজনীতিক অধিকার যত বিস্তৃত হয় রাষ্ট্রীয় কাজে অংশগ্রহণের মাত্রা তত বৃদ্ধি পায়। রাষ্ট্রীয় কাজে অংশগ্রহণের জন্য রাষ্ট্র ও সরকার যে সকল অধিকার। সংরক্ষণ করে তাদের রাজনীতিক অধিকার বলে। রাজনীতিক অধিকারগুলাের মধ্যে স্থায়ীভাবে বসবাস করার অধিকার নির্বাচনের অধিকার, সরকারি চাকরি লাভের অধিকার, আবেদন করার অধিকার, বিদেশে অবস্থানকালে নিরাপত্তা লাভের অধিকার, সরকারের সমালােচনা করার অধিকার ও সংঘ গঠনের অধিকার উল্লেখযােগ্য।

৩.আর্থনীতিক অধিকার : জীবনধারণ ও জীবনকে উন্নত এবং অগ্রসর করে নেওয়ার জন্য রাষ্ট্র যেসব আর্থ-সামাজিক অধিকার প্রদান করে তাদের আর্থনীতিক অধিকার বলে । আর্থনীতিক অধিকারগুলাের মধ্যে কর্মের অধিকার, ন্যায্য মজুরি লাভের অধিকার, ক্ষধা থেকে মুক্তি লাভের অধিকার, অবকাশ লাভের অধিকার ও শ্রমিক সংঘ গটনের অধিকার অন্যতম। 

নাগরিকের কর্তব্য : নাগরিকের যেমন অধিকার আছে তেমনি কর্তব্যও রয়েছে। আইনের দ্বারা স্বীকৃত অধিকার ভােগ করতে গিয়ে যেসব দায়িত্ব পালন করতে হয় তাদের নাগরিক কর্তব্য বলে । কর্তব্য বলতে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের মঙ্গলের জন্য কোনােকিছু কর্তব্য বলতে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের মঙ্গলের জন্য কোনােকিছু করাকে বােঝায়। একজন নাগরিকের অন্যতম প্রধান কর্তব্য হলাে রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও সংহতি রক্ষা করার জন্য কাজ করা। কর্তব্য প্রধানত দুপ্রকার। যথা : ক. নৈতিক ও খ. আইনগত । মানুষ আগ্রহভরে ও নৈতিকতাবােধে উদ্বুদ্ধ হয়ে যে দায়িত্ব পালন করে তাকে নৈতিক কর্তব্য বলে । আর আইনের দ্বারা আরােপিত বিধি নিষেধের মাধ্যমে যেসব কাজ করা বা না করা হয় তাদের আইনগত কর্তব্য। বলে। আর অধিকার ভােগ করতে হলে এসব কর্তব্য পালন করতে হয়। নাগরিক কর্তব্যগুলাের মধ্যে রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করা, আইন মান্য করা, সুষ্ঠুভাবে ভােটাধিকার প্রয়ােগ করা, নিয়মিতভাবে কর প্রদান করা, রাষ্ট্রের সেবামূলক কাজে অংশগ্রহণ করা, সন্তানদের সুশিক্ষিত করা ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে দায়িত্ব পালন করা অন্যতম।

নাগরিকের অধিকার ও কর্তব্যের স্বরূপ : নাগরিক অধিকার ও কর্তব্য একটি সামাজিক ধারণা । সমাজবদ্ধ জীব হিসেবে কেবল রাষ্ট্রের নাগরিকই এ অধিকার ভােগ ও কর্তব্য পালন করতে পারে; তা সে জন্মসূত্রেই হােক কিংবা অনুমােদনসূত্রে নাগরিকত্ব লাভের মাধ্যমেই হােক। আবার নাগরিক অধিকার ও কর্তব্য একটি আইনগত ধারণা। কারণ তাতে থাকে রাষ্ট্রীয় আইনের স্বীকৃতি। নাগরিক অধিকার ও কর্তব্য সব নাগরিকের জন্য সমান । তা কোনাে ব্যক্তিবিশেষের জন্য আলাদা হয় না কিংবা কখনাে সামাজিক স্বার্থের বিরুদ্ধে যায় না। তবে নাগরিক অধিকার ও কর্তব্য শাশ্বত কিংবা চিরন্তন নয়। দেশ ও কালভেদে তাতে পার্থক্য হয় । সমাজ ও সভ্যতার স্তরভেদে নাগরিক অধিকারের পরিবর্তনও ঘটে থাকে।

নাগরিক অধিকার ও কর্তব্যের সম্পর্ক : অধিকার ও কর্তব্য ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত। অধিকার ও কর্তব্য শব্দগত দিক থেকে ভিন্ন। হলেও তাৎপর্যগত দিক থেকে অভিন্ন। মূলত কর্তব্য পালনের মধ্য দিয়েই অধিকার অর্জিত হয়ে থাকে। অপরদিকে, অধিকারের মধ্যেই কর্তব্য নিহিত। অধিকার মূলত সেসব শর্ত যেগুলাে নাগরিকের ব্যক্তিত্বের সুষম বিকাশ ঘটায় । আর কর্তব্য হলাে সেসব শর্ত পূরণের জন্য সম্পাদিত কার্যাবলি । রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক লাস্কি বলেন, 'ব্যক্তিত্বের পরিপূর্ণ উপলব্ধির জন্য কতিপয় শর্তের প্রয়ােজন । কিন্তু সেসব শর্ত সম্পাদনের প্রয়ােজন আরও অধিক। অপরদিকে, একজনের অধিকার ভােগ অন্যজনের প্রতি কর্তব্য পালনেরও নামান্তর। যেমন- যে কারাে পথে চলতে পারা তার অধিকার। কিন্তু নিজে চলার পাশাপাশি অন্যের চলার পথকে অবাধ করাও তার দায়িত্ব। তাই অধিকার ভােগ তখনই যথার্থ হয় যখন কর্তব্য সম্পাদন নিশ্চিত হয়।

নাগরিক যােগ্যতা অর্জন : নাগরিক কর্তব্য সম্পাদনের যােগ্যতা নাগরিককেই অর্জন করতে হবে। এজন্য প্রথমেই প্রয়ােজন উপযুক্ত শিক্ষা লাভ করে স্বীয় বিচার-বুদ্ধির উৎকর্ষ সাধন ও আত্মবিশ্বাস অর্জন। সুনাগরিকতা অর্জনের জন্য খাঁটি দেশপ্রেমিক হতে হবে । দেশের নিরাপত্তা ও উন্নতি সাধনের জন্য জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকলকেই সর্বশক্তি প্রয়ােগ করতে হবে । মূর্খ, রুগ্‌ণ ও দুর্বল নাগরিকের দ্বারা রাষ্ট্রের কোনাে কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পাদিত হতে পারে না। তাই প্রত্যেক নাগরিককে সুস্বাস্থ্য গঠন করতে হবে এবং উপযুক্ত শিক্ষা লাভ করে শিক্ষিত হতে হবে। 

বাংলাদেশের সংবিধানে নাগরিক অধিকার কর্তব্য : বাংলাদেশে একটি উত্তম সংবিধান রয়েছে। এ সংবিধান দেশের নাগরিকদের অধিকার ও কর্তব্যের পরিসীমা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। সংবিধানের ২৬ নম্বর অনুচ্ছেদ থেকে ৪৭-ক অনুচ্ছেদ পর্যন্ত নাগরিকের অধিকারের উল্লেখ রয়েছে। অপরদিকে, সংবিধানের ২০ ও ২১ নম্বর অনুচ্ছেদে নাগরিক কর্তব্যের সুস্পষ্ট ভাষা বর্ণনা করা হয়েছে। 'কাজেই, সংবিধানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল প্রতিটি নাগরিক নিজ নিজ অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন থাকবে, এটাই সঙ্গত। 

বাংলাদেশে নাগরিক কর্তব্য : বাংলাদেশে নাগরিক অধিকারসমূহ ১৯৭১ সালের সংবিধানে বিধিবদ্ধ হয়েছে এবং এসবের প্রয়ােগ উচ্চ আদালতের মাধ্যমে অঙ্গীকার করা হয়েছে। অধিকারগুলাের কয়েকটি হচ্ছে : আইনের চোখে সবাই সমান ; ধর্ম, জাতি, বর্ণ লিঙ্গ অথবা জন্মস্থান নিয়ে কোনাে বৈষম্য সৃষ্টি না করা; রাষ্ট্রের সকল ক্ষেত্রে জনজীবনে নর-নারীর সমানাধিকার; রাষ্ট্রের চাকরিতে সমান সুযােগ; আইনের সংরক্ষণের অধিকার; ব্যক্তিজীবন ও স্বাধীনতার অধিকার; বেআইনি গ্রেপ্তার ও আটকে রাখার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা; বাধ্যতামূলক শ্রমের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা চলাফেরায় স্বাধীনতা; সমবেত হওয়ার স্বাধীনতা; সংঘ-সমিতি করার স্বাধীনতা; চিন্তা, বিচারবুদ্ধি ও বাক স্বাধীনতা; পেশা ও বৃত্তির স্বাধীনতা; ধর্মের স্বাধীনতা; সম্পত্তির অধিকার এবং যােগাযােগের গােপনীয়তা। বর্তমানে আমাদের দেশের অগণিত সমস্যা জাতীয় জীবনকে বিপর্যস্ত করছে। এসব সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব দেশের কর্ণধারদের হাতে ন্যস্ত থাকলেও জনগণ সেগুলাে থেকে মােটেই বিচ্ছিন্ন নয়। তাই দেশকে সমৃদ্ধ করতে হলে এসব জনগণকে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। নাগরিকরা যদি তাদের কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হয় তবে দেশ শৃঙ্খলার মাধ্যমে উন্নতির দিকে ধাবিত হবে। দেশের স্বার্থের পরিপন্থি চোরাচালান কালােবাজারি ও দুর্নীতিপরায়ণতা রােধ করার দায়িত্ব নাগরিকদেরই পালন করতে হবে।

উপসংহার : স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্রকে উন্নত করে গড়ে তােলার দায়িত্বভার বর্তমানে আমাদের ওপর অর্পিত হয়েছে। তাই নাগরিক হিসেবে আমাদের সম্মুখে যে দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে, সে বিষয়ে আমাদের সদা সচেতন থাকতে হবে। দেশের অশিক্ষা ও কুশিক্ষা দূরীকরণে, দুঃখ-দারিদ্র লাঘবকল্পে প্রত্যেক নাগরিককেই যথাসাধ্য চেষ্টা করতে হবে। এ দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়েই ব্যক্তি একজন আদর্শ নাগরিকের মর্যাদা লাভ করে। এ দায়িত্ব পালনে যারা অনীহা প্রকাশ করে, তারা যথার্থ নাগরিক নয় বরং বলা যায়, তারা দেশের উন্নয়নকে ব গ্রস্ত করে।
Next Post Previous Post