বাংলা রচনা : একটি শীতের সকাল

একটি শীতের সকাল
একটি শীতের সকাল

শীতের সকাল
অথবা, একটি শীতের সকাল


[সংকেত : ভূমিকা; শীতের সকালের প্রাকতিক সৌন্দর্য; শহরে শীতের সকাল; গ্রামে শীতের সকাল; শাতের সকালে পশপ! শীতের সকালের প্রধান আকর্ষণ; শীতের সকালের সুখ-দুঃখ; শীতের সকালের অসুবিধা; যানবাহন চলাচলের সব উপসংহার]


 ভূমিকা : ষড়ঋতুর দেশ আমাদের এই বাংলাদেশ। প্রতিটি ঋতুই ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। এর মধ্যে শীত ঋতু আমাদের সামনে হাজির হয় সম্পূর্ণ ভিন্ন আবেশে। উত্তরের হিমশীতল হাওয়া আর কুয়াশার চাদর গায়ে দিয়ে শীত আসে কনকনে বুড়ির মতাে। মানুষের কাছে শীতের দিনের প্রধান আকর্ষণ শীতের সকাল। এ সময় প্রকৃতি কুয়াশার চাদরে ঢাকা থাকে। কুয়াশার ঘন সাদা পর্দা ভেদ করে নবীন সূর্যের আলাে পৃথিবীতে ঔজ্জ্বল্য ছড়াতে পারে না । হিমেল হাওয়ায় প্রকৃতি ও প্রাণিজগতে শুরু হয় কাপন। তাই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন —



শীতের হাওয়ার লাগল নাচন আমলকীর এই ডালে ডালে।
পাতাগুলি শিরশিরিয়ে ঝরিয়ে দিল তালে তালে । 


শীতের সকালের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য : পৌষ ও মাঘ এ দুমাস শীতকাল । তখন কুয়াশার নাচন শুরু হয় প্রকৃতিকে নিয়ে । উত্তরের হিমেল হাওয়া বয়, গাছপালা পাতাহীন হয়ে পড়ে। নদ-নদীতে স্রোতের তীব্রতা হ্রাস পায়। শীতের সকালে যখন ঘন কুয়াশায় সবকিছু ঢেকে যায় তখন প্রকৃতিকে অপূর্ব সুন্দর মনে হয়। পাণ্ডুর প্রকৃতির মধ্যে এক নীরব সৌন্দর্য দেখা যায় শীতের সকালে । এ সৌন্দর্য অনেকটা বিমূর্ত। শীতের সকালে প্রকৃতি আশ্চর্য নিস্তব্ধতায় মগ্ন হয়ে পড়ে । কুয়াশার অবগুণ্ঠন ছিড়ে নিস্তব্ধতার বুক চিরে কোনাে পথিক হেঁটে গেলে মনে হয় শীতের কনকনে ঠান্ডায় তার শরীর কাঁপছে। টিনের চালে, গাছের ডালে, ঘাসের ডগায়, শিশির বিন্দু জমে থাকার মনােরম দৃশ্য শীতের সকাল ছাড়া আর দেখা যায় না। ঘন সাদা চাদর মুড়ে থাকা প্রকৃতির বুকে মুক্তার মতাে ফুটে থাকা শিশির বিন্দুগুলাে চিকচিক করে। প্রকতি হয়ে ওঠে সতেজ। মৌমাছির গুঞ্জনে মুখরিত হয় হলুদ সরষে খেত আর ফুলের বাগান। কুয়াশার চাদর সরিয়ে সূর্য যখন উঁকি দেয় তখন স্নিগ্ধ আলােয় ঝলমল করে কুয়াশায় ভেজা প্রকৃতি।



শহরে শীতের সকাল : শহরে শীতের সকালটা একটু ভিন্ন আঙ্গিকেই কাটে। শীতের সকালে শহরবাসীর ঘুম বিভিন্ন পাখির কলরবে না ভাঙলেও, ভাঙে কাকের ডাকে। শীতের সকালটা শহরবাসী ঘুমের মধ্যেই কাটিয়ে দেয়। শীতের সকালে তাদের লেপের উষ্ণতা। ছেড়ে কাজকর্মে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে না। যাদের সকালে উঠতেই হয় তারাও ছুটির দিনে বেশ দেরি করে ঘুম থেকে ওঠে। তাই শহরের লােকেরা গ্রামের মানুষদের মতাে শীতের সকালকে উপভােগ্য করে তুলতে পারে না। আর শহরে পিচ ঢালা রাস্তা কুয়াশায়। আচ্ছন্ন থাকে, শিশিরও পড়ে তবে গ্রামের মতাে শিশির ভেজা ঘাসের ছোঁয়ায় পথিকের মন আন্দোলিত হয় না। শীতের সকালে উঠে কনকনে ঠান্ডা পানিতে মুখ ধুতে ইচ্ছে করে না বড়ােদেরও, ছােটোরা তাে ঠান্ডা পানিতে ভয়ে পালাই পালাই করে । শহরের মানুষদের সূর্যোদয় দেখা, সূর্যাস্ত দেখা, শীতের সকালের কুয়াশা দেখার মন-মানসিকতা নেই। যান্ত্রিক জীবনে যারা অভ্যস্ত তাদের কাছে ওসব হলাে আবেগের ব্যাপার। তবে শহরের লােকেরা রংবেরঙের শীতের কাপড়ের মাধ্যমে শীতের সকালকে বরণ করে। কোট, জ্যাকেট, সােয়েটার, টুপি, চাদর, মাপলার প্রভৃতি আরামদায়ক পােশাক জড়িয়ে শীতের সকালে নিজ নিজ কর্মস্থলে বেরিয়ে পড়ে।



গ্রামে শীতের সকাল : গ্রামে-গঞ্জে শীতের সকালে সৃষ্টি হয় অভূতপূর্ব দৃশ্য। শীতের সময় শাকসবজি, তরিতরকারি উৎপন্ন হয়। বেশি। শীতের সকালে পাওয়া যায় টাটকা খেজুর রস। ভাপা পিঠার মৌ মৌ গন্ধে সকালবেলায় খিদে বেড়ে যায় । দুঃস্থ-দরিদ্র গ্রামবাসীদের শীতের সময় গরম জামাকাপড় থাকে না। রাতে তারা ঠান্ডায় কাঁপতে থাকে। আর সুয্যি মামা উকি দেওয়ার আগে মনে হয় এই বুঝি সকাল হলাে, এই বুঝি সকাল হলাে। গ্রামের মসজিদে আজান হয়, ঘাের অন্ধকার ভেদ করে দূর-দূরান্ত থেকে মুসল্লিরা মসজিদে আসেন নামাজ পড়তে। ভরপেট পান্তা ভাত খেয়ে কৃষক কুয়াশাচ্ছন্ন ভাের বেলায় মাঠের কাজে যায়। গঞ্জের হাটে যায়। কেনাকাটার জন্য। গ্রামের মক্তবে ছেলেমেয়েরা পড়তে যায়। মসজিদে বা মক্তবের কাছ দিয়ে হেঁটে গেলেই ছাত্র-ছাত্রীদের সজোরে সমবেত কণ্ঠে ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ করার দৃশ্য চোখে পড়ে। কানে আসে তাদের কণ্ঠস্বর । শীত একটু বেশি লাগলে সকালবেলায় নাড়ার আগুনে ছেলের দল মটরশুটি পুড়িয়ে খায় আর আগুন পােহায়।



শীতের সকালে নদ-নদী : আমাদের দেশে শীতকালে নদ-নদী গুলােতে তেমন পানি থাকে না। তখন নদী থেকে প্রচুর মাছ ধরা যায়। এজন্য শীতের খুব সকালে জেলেরা মাছ ধরতে নদীতে চলে যায়। জেলে নৌকাগুলাে অল্প দূরে হলেও কুয়াশার ধূম্রজালে দেখা যায় না। আর সেই ধূম্রজাল ভেদ করে দূরযাত্রার নৌকা, লঞ্চ, ফেরি ইত্যাদি ভালােমতাে চলাচল করতে পারে না। তখন নদীর উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঠান্ডা বাতাসে হাড় কাঁপানাে শীত লাগে।



শীতের সকালের প্রধান আকর্ষণ : শীতের সকালের প্রধান আকর্ষণ হলাে বিভিন্ন রকম পিঠা । তখন গ্রামে প্রচুর খেজুরের রস পাওয়া যায়। খুব সকালে খেজুর গাছ থেকে হাঁড়ি নামানাে হয়। শীতের সকালে এ রস খেতে খুবই ভালাে লাগে। সকাল হতে না হতেই গ্রামগঞ্জে সর্বত্র খেজুর রসের পায়েস খাওয়ার ধুম পড়ে। গ্রামের ছেলেমেয়েরা দলবেঁধে রােদ পােহাতে পােহাতে মুড়ি-মুড়কি, পিঠাপায়েস এসব খেতে পছন্দ করে। এ সময়ের প্রধান আকর্ষণ হলাে চিতই পিঠা ও ভাপা পিঠা। এছাড়া হরেক রকম পিঠা ঘরে ঘরে বানানাে হয়। তাই তাে কবি সুফিয়া কামাল বলেছেন—



পৌষ-পার্বণে পিঠা খেতে বসে খুশিতে বিষম খেয়ে
আরও উল্লাস বাড়িয়াছে মনে মায়ের বকুনি পেয়ে। 


শীতের সকালের সুখ-দুঃখ : শীতের সকালে লেপ-কম্বলের ভিতরে আরামে শুয়ে থাকার মতাে সুখ আর কিছুতে পাওয়া যায় না । শীতের সকালে বিভিন্ন পিঠা দিয়ে নাস্তা করা, নানা রকম শীতের সবজি প্রভৃতি মানুষের মধ্যে সুখানুভূতি সৃষ্টি করে। অন্যদিকে, কনকনে শীতেও যাদের গায়ে দেওয়ার মতাে শীতবস্ত্র নেই, যারা রাস্তার পাশে শীতের হিমশীতল বাতাসে শুয়ে থাকে তাদের জন্য শীতের সকাল অনেক কষ্টের।


শীতের সকালের অসুবিধা : শীতের সকালে হাড় কাঁপুনে শীত পড়লে গ্রামের মানুষ জড়তা ও বিষন্নতায় ভােগে। মানুষের কাজের উদ্যম থেমে যায় । আরাম-আয়েস করে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। গরিব মানুষগুলাে গরম কাপড়ের অভাবে কষ্ট করে। কবির ভাষায় তাদের মনে প্রার্থনা জাগে—

হে সূর্য!
তুমি আমাদের স্যাতসেঁতে ভিজে ঘরে
উত্তাপ আর আলাে দিও। 


যানবাহন চলাচলের অসুবিধা : শীতের রাতে বা সকালে পরিবেশ কুয়াশাচ্ছন্ন থাকে। ফলে দূর থেকে স্পষ্ট কিছু দেখা যায় না। মনে হয় কয়াশার সাদা পর্দা ছাড়া সামনে কিছু নেই। এ সময় রাস্তাঘাটে যানবাহন চলাচলের ফলে দুর্ঘটনা ঘটে সবচেয়ে বেশি। নদীপথে লঞ্চ-স্টিমার চলাচলের ক্ষেত্রেও সমস্যা সৃষ্টি হয়। কুয়াশাচ্ছন্ন অবস্থায় রাস্তায় বা নৌপথে চলাচল না করাই ভালাে।


উপসংহার : শীতের সকালে শিশির ভেজা সােনালি রােদের স্পর্শ কার না ভালাে লাগে? সুবিধা-অসুবিধা দুয়ে মিলে শীতের সকাল আমাদের জীবনে প্রতি বছর দুই মাস সময় অন্যরকম ভালােলাগার অনুভূতিতে আমাদের হৃদয়কে পরিপূর্ণ করে তােলে। কবির ভাষায় বলা যায়- ‘একটি ধানের শীষের উপরে একটি শিশির বিন্দু’ শীতের সকালের সৌন্দর্যকে দ্যুতিময় করে তােলে।
Next Post Previous Post