বাংলা রচনা : শ্রমের মর্যাদা

শ্রমের মর্যাদা
পরিশ্রমের মর্যাদা
জাতীয় উন্নয়নে শ্রমের গুরুত্ব
সভ্যতা বিকাশে শ্রমের অবদান

[ রচনা সংকেত : ভূমিকা, শ্রমের মূল্য, শ্রমের গুরুত্ব, শ্রমবিমুখতা, শ্রমের সম্মান-অসম্মান, জাতীয় জীবনে শ্রমের প্রয়োজনীয়তা, বিভিন্ন দেশে শ্রমের মর্যাদা, শ্রম ও মানসিক উন্নতি, শ্রমশীল মানুষের উদাহরণ, শ্রম এবং কীর্তি, উপসংহার। ]

ভূমিকা : আজকের পৃথিবী সংগ্রামময়। সংগ্রাম করেই এ পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে হয়। আর পরিশ্রমই হলো এ সংগ্রামের মূল শক্তি। পৃথিবীর প্রতিটি জীবই কঠোর পরিশ্রম করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। শ্রম ছাড়া এক দিনের আহার উপার্জন করা সম্ভব নয়। মানুষও শ্রম ছাড়া বেঁচে থাকতে পারে না। পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে হলে কঠোর পরিশ্রম করেই বেঁচে থাকতে হয়। বিংশ শতাব্দীর সভ্যতার চরম উৎকর্ষতার দিকে তাকালে আমরা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাই। এ উৎকর্ষের মূলে রয়েছে যুগ যুগান্তরের অগণিত মানুষের নিরলস শ্রম।

শ্রমের মূল্য : পৃথিবীর জ্ঞানী ব্যক্তিদের আচরণ এবং উপদেশ লক্ষ করলে দেখা যায় তাঁরা কোন কাজকেই ছোট করে দেখেননি। পৃথিবীর উন্নত দেশসমূহের প্রতি দৃষ্টি দিলেও দেখা যাবে যে সেদেশের মানুষ শ্রমের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। কোন শ্রমকেই তারা হানিকর মনে করে না। ছোট কাজ বড় কাজ বলে তাদের কাছে কিছু নেই। তাদের কাছে সব কাজই সমান। প্রতিটি কাজের প্রতি তারা আগ্রহ দেখিয়ে থাকে। যে কোন কাজের প্রতি তাদের এ শ্রদ্ধাবোধই তাদেরকে উন্নত করেছে। এটা পরীক্ষিত সত্য যে, পৃথিবীর যে জাতি যত বেশি পরিশ্রমী সে জাতি তত বেশি উন্নত ও সম্পদশালী। শ্রমকে যারা মূল্য দিতে পেরেছে, তারাই জগতে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছে। পৃথিবীর সব ধর্মে শ্রমকে বিশেষ মূল্য দেয়া হয়েছে। ইসলাম ধর্মে শ্রমের মূল্য সম্পর্কে হুজুর পাক (সা) বালেছেন, ‘শ্রমিকের গায়ের ঘাম শুকিয়ে যাওয়ার আগেই তার পাওনা পরিশোধ করে দাও।'

শ্রমের গুরুত্ব : মানুষের জীবনে শ্রমের গুরুত্ব অপরিসীম। মানুষ একদিকে যেমন সভ্যতার স্রষ্টা, অন্যদিকে তেমনি সে আপন ভাগ্যের নির্মাতা। নিজের ভাগ্যকে মানুষ নিজে গড়ে নিতে পারে। আর এ জন্য সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হলো শ্রম। ছোট হউক বড় হউক প্রত্যেকেরই কাজের প্রয়োজন রয়েছে এবং যার যার দায়িত্ব যথাযথ পালনের মধ্যেই রয়েছে জীবনের অনাবিল শান্তি। সব মানুষের মধ্যেই সুপ্ত প্রতিভা আছে। পরিশ্রমই মানুষের সুপ্ত প্রতিভাকে জাগ্রত করে এবং মানুষকে উন্নতির দিকে নিয়ে যায়। মানুষ যা চায় তা পৃথিবীতে বিদ্যমান। তবে তা পেতে হলে মানুষকে শ্রমের মাধ্যমে অর্জন করে নিতে হয়। ভাগ্য বলে যদি কিছু থাকে তাহলে তা নিশ্চয়ই সময়ের সঙ্গে আবর্তনশীল কয়েকটি ধারাবাহিক শূন্যস্থান যা পরিশ্রম দ্বারা পূর্ণ করতে হয়। কথাটিকে আরও সুস্পষ্টভাবে বলা যায়—

Luck is what happens when
Preparation mets opportunity

অর্থাৎ ভাগ্য হচ্ছে প্রস্তুতি এবং সুযোগের সুসমন্বয়। আর এ প্রস্তুতি হলো নিরলস এবং সুচিন্তিত শ্রমের একটি প্রক্রিয়া। শ্রম দ্বারা সব কিছুই অর্জন করা সম্ভব। পৃথিবীর সব ধর্মে শ্রমকে বিশেষ মূল্য দেয়া হয়েছে। হাদিসে আছে, নিশ্চয়ই নিয়তের (পরিকল্পনার) চেয়ে আমল (কাজ) বড়।

শ্রমবিমুখতা : পেশাগত ভিন্নতার কারণে মানুষের সামাজিক মর্যাদার ব্যাপারেও ভিন্নতা লক্ষ করা যায়। সমাজে বসবাসরত মানুষ নানান ধরনের কাজে বা পেশায় নিয়োজিত। এ পেশাগত কারণে মানুষের মধ্যে উঁচু-নিচুর ভেদাভেদ সৃষ্টি হয়েছে। যার ফলে শ্রমের প্রতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটেছে। প্রকৃতপক্ষে, কোন কাজই ঘৃণ্য নয়। সমাজে সব ধরনের কাজেরই গুরুত্ব রয়েছে। নেতার নেতৃত্ব, চিন্তাবিদদের চিন্তা, শিক্ষকের শিক্ষা, বিশেষজ্ঞের উপদেশ ইত্যাদি যেমন আবশ্যক তেমনি কুলি-মজুর, মেথর, চাষী, ডাক-হরকরা, দোকানি, কেরানি প্রভৃতি ব্যক্তিদের শ্রমও সমানভাবে আবশ্যক। সব ধরনের কাজই মহৎ এবং প্রয়োজনীয়। শ্রম সবাইকে কর্মী হিসেবে গড়ে তোলে, নিশ্চয়ই ছোট বা বড় হিসেবে নয়।

কিন্তু দুঃখের এবং লজ্জার বিষয়, আমাদের দেশে তথা এ উপমহাদেশে এখনও বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত শ্রমকে বিভিন্ন সামাজিক শ্রেণীতে ফেলা হয়। যে শ্রমিকের শ্রম না হলে আমাদের একদিনও চলে না, অথচ তাকেই আমরা সামাজিকভাবে তার ঐ শ্রমের জন্য ছোট বলে গণ্য করি। শ্রমের ক্ষেত্রে এ মনোভাব কখনও কোন জাতির জন্য উন্নতি বয়ে আনতে পারে না। উন্নত বিশ্বে সব শ্রমকেই মহৎ মনে করা হয়। আর এ কারণে তারা উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছতে পেরেছে। আমাদেরও এ শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত।

শ্রমের সম্মান-অসম্মান : জগতে কোন শ্রমই অসম্মানজনক নয়। বরং সকল প্রকার শ্রমই মানুষের জীবনে কল্যাণকর। শ্রমের মাধ্যমে মানুষ উন্নতির শীর্ষে পৌঁছে যেতে পারে। কিন্তু মানুষ সকল শ্রমেই আগ্রহ করে না। তারা শ্রমের ক্ষেত্রে সম্মান-অসম্মান বিবেচনা করে কোন কোন শ্রম থেকে বিরত থাকে। কিন্তু জাতের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায় সকল মানুষের শ্রমের ইতিবৃত্ত। মহামনিষীগণের কাছে শ্রমশীল মানুষ শ্রদ্ধার পাত্র। শ্রম বিমুখ মানুষকে সকলেই ঘৃণা করে। যারা শ্রমের ক্ষেত্রে মান-অপমান বিবেচনা করে নেই আজকের এ সভ্যতার জন্ম দিয়েছে। শ্রমজীবী মানুষের অক্লান্ত শ্রমের বিনিময়ে মানুষ উন্নতির শিখরে পৌঁছতে সক্ষম হয়েছে। আর ঐ সকল মানুষই (যারা মান-সম্মানের ভয় না করে শ্রম দিয়েছে) সকল মানুষের স্মরণীয় হয়ে আছে।

জাতীয় জীবনে শ্রমের প্রয়োজনীয়তা : জাতীয় জীবনে শ্রমের গুরুত্ব অপরিসীম। শ্রমের দ্বারা যে কোন জাতি উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছে যায়। পৃথিবীর অনেক দেশ তার উদাহরণ। যারা শুধু শ্রমের দ্বারা পৃথিবীতে উন্নত দেশে পরিণত হয়েছে। একটি দেশের জনশক্তি তখনই সম্পদে পরিণত হয়, যখন তারা কাজ করে। কিন্তু শ্রম না দিয়ে হাত গুটিয়ে বসে থাকলে সে জাতির ধ্বংস অনিবার্য। দেশের জনশক্তিকে সম্পদে পরিণত করতে হলে তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। তাদের কায়িক শ্রমের প্রতি উদ্বুদ্ধ করতে হবে। দেশের সকল মানুষ শ্রমের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হলে সে দেশ সফলতার শীর্ষে পৌঁছবেই তাতে কোন সন্দেহ নেই ।

বিভিন্ন দেশে শ্রমের মর্যাদা : পৃথিবীর বিভিন্ন উন্নত দেশের শ্রমকে শীর্ষে মর্যাদা দেয়া হয়। শ্রমের মর্যাদা দেয়ার কারণেই যুদ্ধ বিধ্বস্ত জাপান পৃথিবীর শীর্ষে উন্নত দেশে পরিণত হয়েছে। আমেরিকা, কানাডা, জার্মান, ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড, ভারত ইত্যাদি সকল দেশের উন্নতির মূলে রয়েছে শ্রম সাধনা। এসকল দেশের মানুষ কোন কাজকেই ছোট মনে করে না । নিজের কাজ নিজে করাই সম্মানজনক বলে তারা মনে করে। মোটকথা উন্নয়নের জন্য শ্রম কথাটিকে তারা জীবনের সাথে একাত্ম করে নিয়েছে।

শ্রম ও মানসিক উন্নতি : একটি প্রবাদ আছে, ‘অলস মস্তিষ্ক শয়তানের আড্ডাখানা।' কর্মহীন মানুষ কখনো সুস্থ চিন্তা করতে পারে না। তার মাথায় কেবল খারাপ চিন্তা ঘুরপাক খায়। কাজ না করলে তার সময় কাটে খারাপ কিছু করে। পরিশ্রমী মানুষের সময় কাটে কাজের মধ্যে। অকাজ কিংবা অন্য কিছু করার সময় তার থাকে না। কাজেই, তার জন্য খারাপ কাজগুলো বন্ধ হয়ে যায়, অপরদিকে সৎ ও উন্নতির পথ মুক্ত হয়ে যায়। ছাত্রদের বেলায় বিষয়টি অধিক গুরুত্বপূর্ণ। ছাত্ররা যদি পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকে, তাহলে খারাপ কাজ করার সুযোগ তাদের থাকে না। এতে তাদের মানসিক উন্নতি যেমন হবে, তেমনি ভবিষ্যতও হবে উজ্জ্বল।

শ্রমশীল মানুষের উদাহরণ : কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে পৃথিবীতে অনেক মানুষ বিখ্যাত হয়েছে। তাঁরা মানসিক ও শারীরিক উভয় প্রকার শ্রমের মাধ্যমে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। জর্জ ওয়াশিংটন, আব্রাহাম লিঙ্কন, আইনস্টাইন, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ মনীষী ছিলেন কঠোর পরিশ্রমী। ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক হযরত মুহাম্মদ (স) আজীবন কঠোর পরিশ্রম করেছেন। আল্লাহর নবী হয়েও তিনি সব কাজ নিজ হাতে সম্পন্ন করতেন। যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি ছিলেন একজন সফল সৈনিক। কোন কাজকেই তিনি ছোট কাজ মনে করতেন না। তিনি বলতেন নিজ হাতে কাজ করার মতো পবিত্র জিনিস আর নেই ।

শ্রম এবং কীর্তি : বিশ্বের সব কালজয়ী কীর্তিগুলো শ্রমের মাধ্যমেই সম্ভব হয়েছে। তাজমহল, রোম নগরী, চীনের প্রাচীর প্রভৃতি মহান কীর্তিগুলো শত বছরের হাজার হাজার মানুষের পরিশ্রমের ফসল। প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে শুরু করে বর্তমান কাল পর্যন্ত যত সভ্যতার উদ্ভব ঘটেছে সবই শ্রমের ফলশ্রুতি। যে দেশগুলো আজ বিশ্বে উন্নতির শিখরে আসীন, সে উন্নতির পেছনেই রয়েছে জাতিগত শ্ৰম।

উপসংহার : এক যুগ পার হয়ে আরেক যুগ আসে, এক শতাব্দী পার হয়ে আরেক শতাব্দীর আগমন ঘটে। কিন্তু শ্রমের মর্যাদার কোন অবমূল্যায়ন হয় না। বরং দিনের পর দিন শ্রমের মর্যাদা বেড়েই চলছে ।
Next Post Previous Post