বাংলা রচনা : পরীক্ষায় দুর্নীতি ও তার প্রতিকার

পরীক্ষায় দুর্নীতি ও তার প্রতিকার

পরীক্ষায় দুর্নীতি ও তার প্রতিকার

[ রচনা সংকেত : সূচনা, দুর্নীতির বিস্তারিত বিবরণ, দুর্নীতির প্রক্রিয়া, দুর্নীতির কারণ, পরীক্ষায় দুর্নীতি বন্ধ করার উপায়, উপসংহার। ]

সূচনা : আমাদের দেশে সমাজের সর্বস্তরেই কিছু কিছু দুর্নীতি চোখে পড়ে। অফিস-আদালতে, ব্যবসা-বাণিজ্যে, রাস্তা-ঘাটে সর্বত্রই কিছু চরিত্রহীন লোক দুর্নীতি করে থাকে। ঠিক একই নিয়মে ছাত্রদের মধ্যেও কিছু উৎকট দুর্নীতিপরায়ণ ছাত্র দেখা যায়। যারা পরীক্ষা পাশের ক্ষেত্রে বিভিন্ন রকমের দুর্নীতি করে থাকে, আবার কেউ কেউ উচ্চ নম্বর প্রাপ্তি কিংবা ভাল রেজাল্ট করার জন্য করে থাকে। পরীক্ষায় দুর্নীতি অতি পুরানো কথা হলেও বর্তমান বছরগুলোতে এর মাত্রা চরম সীমান্ত স্পর্শ করেছে। কতিপয় ছাত্র-ছাত্রীর এ হীন প্রচেষ্টা গোটা, ছাত্র সমাজকে কলঙ্কিত করে ফেলছে। এতে শুধু ছাত্র সমাজ নয় গোটা জাতির ভাগ্যে অশনি সংকেতের সৃষ্টি করেছে যা বেদনাদায়ক ও হতাশাব্যঞ্জক। 

পরীক্ষায় দুর্নীতির স্বরূপ : শিক্ষার্থীরা পঠিত বিষয় ও নির্দিষ্ট সময় অধ্যয়নের পর অচির্জত জ্ঞানের প্রমাণ দেয় পরীক্ষায়। পরীক্ষার সাফল্য ব্যর্থতা নির্ভর করে শিক্ষা গ্রহণের আগ্রহ অনাগ্রহের উপর। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর যুদ্ধ বিদ্ধ দেশে ভঙ্গর প্রশাসনিক কাঠামোর ভিতর অনুষ্ঠিত পাবলিক পরীক্ষায় অব্যবস্থখাপনা ও দুর্নীতির সূচনা। পরবর্তীকালে সামাগ্রিকভাবে আর্থসামাজিক অসঙ্গতি ও অবক্ষয়ের ধারায় পরীক্ষায় দুর্নীতি তথা সকল প্রবণতা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। সারা বছর লেখাপড়া না করেও পরীক্ষার হলে অসাধু পন্থা অবলম্বনের মাধ্যমে অবলীলায় পাস করার এক অশুভ ক্ষেত্র প্রস্তুত হয় স্বাধীনতা পর থেকেই। শিক্ষাক্ষেত্রে রাজনৈতিক অপশক্তির প্রসার ও সন্ত্রাস নকলকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়। তবে একবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই দেশ থেকে নকল বাজির মতো অশুভ প্রবণতা অপসারণ শুরু হয়েছে।

দুর্নীতির বিস্তারিত বিবরণ : শিক্ষা শুধু পরীক্ষা পাশের জন্য নয়, শিক্ষা হচ্ছে মনুষ্যত্বের বিকাশ এবং আত্মার তুষ্টি ও পুষ্টি সাধনের মাধ্যমে মানুষকে সমাজের নানান সমস্যার সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলার মত যোগ্যতা অর্জন করতে শেখানো। জগত ও প্রকৃতির পটভূমিকায় জীবনের বিকাশকে বিস্তারিত করে মানুষের অস্তিত্ব রক্ষা করা বড় কঠিন সংগ্রাম। এ জন্য সবাইকে ছেলেবেলা থেকেই বিভিন্ন বিষয়ে পাঠ গ্রহণ ও পদ্ধতিগতভাবে বিভিন্ন স্তর অতিক্রমণের পরীক্ষা দিতে হয়। কিন্তু সম্প্রতি নানা কারণে স্কুল, কলেজ এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পরীক্ষা এক নিদারূণ প্রহসনে পরিণত হয়েছে। কিছু কিছু ছাত্র বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি করে শিক্ষাক্ষেত্রকে কলঙ্কিত করে চলছে।

দুর্নীতির প্রক্রিয়া : কতিপয় উচ্ছৃংখল ছাত্র নিম্নলিখিত প্রক্রিয়ায় পরীক্ষায় দুর্নীতি করে চলছে। যেমন—(ক) পরীক্ষার হলে নকল করে, (খ) অসৎ পরীক্ষকদের দ্বারা নম্বর বাড়িয়ে এবং অসৎ নিরীক্ষক ও বোর্ড কর্মচারীদের দ্বারা নম্বর বাড়িয়ে। ছাত্রদের কাজ লেখাপড়া করে জ্ঞানার্জন, কিন্তু তারা যদি লেখাপড়া না করে দুর্নীতি দ্বারা পার পেয়ে যায় তাহলে এর চেয়ে দুঃখজনক ঘটনা আর হতে পারে না। তাদের কাছে জ্ঞানার্জনের চেয়ে একটি সার্টিফিকেটই বড়। এটি হস্তগত করার জন্য তারা এত বেশি মরিয়া হয়ে উঠে যে, পরীক্ষার হলের যাবতীয় নিয়ম শৃঙ্খলা উপেক্ষা করে এমনকি অনেক সময় পর্যবেক্ষক দের পর্যন্ত প্রভাবিত করে ব্যাপক দুর্নীতির মাধ্যমে জাতির ভবিষ্যৎ নাগরিকদের অন্ধকারের দিকে ঠেলে দেয়। কোন কোন ক্ষেত্রে অভিভাবক ও কিছু সংখ্যক শিক্ষকের আনুকূল্য লাভ করতে সমর্থ হয়। এক্ষেত্রে যারা ছাত্রদের এ হীনকার্যে সহযোগিতা করে তারাও সমানভাবে দায়ী।

দুর্নীতির কারণ : অনেকেই দুর্নীতির কারণ খোঁজেন। তারা বলতে চান শিক্ষা ব্যবস্থার ত্রুটি, প্রশ্নপত্র প্রণয়নের পদ্ধতি, পরীক্ষা পদ্ধতি, ত্রুটিযুক্ত পরীক্ষা পদ্ধতি ইত্যাদি ছাত্রদের পরীক্ষায় দুর্নীতির কারণ। কিন্তু আসলে বিষয়টি সম্পূর্ণ অর্থে সঠিক নয়। একই শিক্ষা ব্যবস্থায় হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী সদভাবে পরীক্ষা দিয়ে ভাল রেজাল্ট করে জাতীয় জীবনে বিভিন্নমুখী অবদান রাখছে। অথচ একই পদ্ধতিতে তারা দুর্নীতি করছে। এরা লেখাপড়া না করে সারা বছর দুষ্টুমী করে। গাছে গাছে, ডালে ডালে বিচরণ করে পরীক্ষায় দুর্নীতি করে পাশ করে যেতে চায়। মূলত আইনের দৃষ্টিতে এরা অপরাধী, এদের শাস্তি হওয়া উচিত।

পরীক্ষায় দুর্নীতির জন্য ছাত্রদের পাশাপাশি কতিপয় শিক্ষকও দায়ী। আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় টিউশনি কালচার ব্যাপকভাবে শুরু হয়েছে। শিক্ষকেরা ক্লাসে ছাত্রদের যতটুকু শিক্ষা দান করেন, তা পর্যাপ্ত নয়। প্রাইভেট টিউশনির জন্য কিছু কিছু শিক্ষক কৌশল অবলম্বন করেন। তাঁরা শিক্ষাদানে এমন ফাঁক রাখেন, যাতে ছাত্রছাত্রীরা আলাদাভাবে তাঁর কাছে শিক্ষা লাভ করে। ব্যক্তিগত ছাত্রদের ভালো ফলাফল লাভের জন্য কখনো কখনো পরীক্ষার হলে তাঁরা ছাত্রদের সহযোগিতা করে থাকেন। ইদানিং একটা বিষয় বেশ চোখে পড়ছে। পরীক্ষার হলে ছাত্রদের সাথে সাথে শিক্ষকেরাও বহিষ্কৃত হচ্ছেন। আমাদের জন্য এটি বড়ই লজ্জার ব্যাপার। পরীক্ষায় দুর্নীতির কারণ হিসেবে রাজনৈতিক নেতাদের নেতিবাচক মনোভাব অনেকাংশে দায়ী। কোন কোন এলাকার রাজনৈতিক নেতারা পরীক্ষার কেন্দ্রের ওপর প্রভাব বিস্তার করে থাকেন। এসব নেতাদের ছত্রচ্ছায়ায় পরীক্ষার হলে নকল হয়ে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে প্রশাসনও দুর্নীতিপরায়ণ হয়ে থাকেন। প্রশাসনে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গও অনেক সময় অর্থের বিনিময়ে পরীক্ষার হলে নকল করার সুযোগ দিয়ে থাকেন। এগুলোকেই পরীক্ষায় দুর্নীতির কারণ বলে চিহ্নিত করা যায়।

পরীক্ষায় দুর্নীতি বন্ধ করার উপায় : পরীক্ষায় দুর্নীতি একটি মারাত্মক অন্যায়। এ দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে হাজার হাজার ছেলে জীবনে পঙ্গু হয়ে যাচ্ছে। যারা উপযুক্ত শিক্ষা না নিয়ে এর মাধ্যমে পার পাচ্ছে কর্মজীবনে তারা ধ্বংস করছে জাতীয় উন্নতি। এর কারণ শিক্ষা জীবনে যারা দুর্নীতি করে কর্মজীবনে তারা সৎ হতে পারে না। সুতরাং পরীক্ষায় দুর্নীতি যে কোন উপায়ে রোধ করা উচিত। দুর্নীতিপরায়ণ ছাত্রদের জন্য কঠোর শাস্তিমূলক আইন পাশ করা উচিত। যেন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেখে অন্যান্য ছাত্ররা পরীক্ষায় দুর্নীতি থেকে দূরে থাকে। শিক্ষাপদ্ধতি, পরীক্ষাপদ্ধতি, প্রশ্নপ্রণয়ন পদ্ধতি যদি সংশোধন করতে হয় তাও করার ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রয়োজনে সমাজের সব স্তরের জনগোষ্ঠী নিয়ে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে যেন কোন ক্রমেই ছাত্ররা পরীক্ষায় দুর্নীতি করতে না পারে। কারণ ছাত্ররা আমাদের ভবিষ্যৎ, তারাই জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষা। তাদের সুন্দর, সৎ ও দক্ষ করে গড়ে তোলা সমাজের বড়দের দায়িত্ব ও কর্তব্য। পরীক্ষায় দুর্নীতি বন্ধ করে আমাদের যুব সমাজকে অন্ধকার পথ থেকে রক্ষা করতে হবে।

পরীক্ষায় দুর্নীতি রোধ করতে ছাত্রছাত্রীদের বইমুখি করতে হবে। পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র এমনভাবে করতে হবে যাতে ছাত্রছাত্রীরা পড়ালেখা না করে উত্তর দিতে না পারে। পড়ালেখায় যদি আনন্দ থাকে তাহলে ছাত্রছাত্রীদের পড়ার টেবিলে বসানো সম্ভব। পরীক্ষায় নকল এড়াতে ছাত্রদের পাশাপাশি শিক্ষক, কর্মচারি, প্রশাসন, রাজনৈতিক নেতাসহ সাধারণ জনগণকে এগিয়ে আসতে হবে। এভাবে আমরা সবাই যদি একত্রিত হয়ে পরীক্ষায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হই, তাহলে দুর্নীতির এ বিষবৃক্ষ উপড়ে ফেলা অসম্ভব নয়।

পরীক্ষায় নকল রোধে সাম্প্রতিক সাফল্য : সরকার পরীক্ষায় নকল রোধ ও শিক্ষার মানোন্নয়নে বেশ কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। শিক্ষা মন্ত্রনালয় ও প্রসাশনের সুদৃঢ় নকল বিরোধী অবস্থানের কারণে নকল প্রবণতা বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছে। সরকার পরীক্ষার্থী বা হল পরিবর্তন ছাড়াও নকলের জন্য বহিষ্কারের সঙ্গে জেল জরিমানার ব্যবস্থা করেছে। পরীক্ষার হলে দায়িত্ব পালনে অবহেলার জন্য শিক্ষাকদের বহিষ্কার ছাড়াও জেল জরিমানার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ফলে সম্প্রতি নকলরোধে ইতিবাচক ফল লক্ষ করা যাচ্ছে।

উপসংহার : পরীক্ষায় দুর্নীতি বর্তমানে জাতীয় জীবনে এক মারাত্মক ক্ষতের সৃষ্টি করেছে। যে কোন মূল্যে জাতিকে এ অভিশাপ থেকে মুক্ত করতে হবে। এ সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য যে সব ত্রুটি রয়েছে তা সংশোধন পূর্বক সরকারকে কার্যকরি পদক্ষেপ নিতে হবে। নৈতিক মূল্যবোধে, জীবনে সৌন্দর্য, প্রেম ও মনুষ্যত্বের আদর্শগত প্রেরণা সৃষ্টিই আমাদের এ সমস্যা নিরসনের পথ প্রশস্ত করে দিতে পারে।
Next Post Previous Post