বাংলা রচনা : দেশপ্রেম

জাতীয় জীবনে স্বদেশপ্রেমের গুরুত্ব

স্বদেশপ্রেম
দেশপ্রেম 
জাতীয় জীবনে স্বদেশপ্রেমের গুরুত্ব 
মাতৃভূমির প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য 

[ রচনা সংকেত : ভূমিকা, স্বদেশপ্রেমের উৎস, স্বদেশপ্রেমের অভিব্যক্তি, স্বদেশপ্রেমের প্রভাব, স্বদেশপ্রেমের উপায়, স্বদেশপ্রেম ও বিশ্বপ্রেমের সম্পর্ক, উপসংহার। ]

ভূমিকা :

“স্বদেশের তরে নেই যার মন
কে বলে মানুষ তারে? পশু সেইজন।”

স্বদেশ ও স্বজাতির উপকার সাধনে যে দ্বিধাগ্রস্ত, দেশের কল্যাণে যে নিবেদিত প্রাণ নয়, দেশ ও জাতির মহাবিপর্যয়ে যার প্রাণ কাঁদে না, সে বিবেকবর্জিত অমানুষ মাত্র। কেননা দেশপ্রেম মানব জীবনের অপরিহার্য উপাদান। দেশ ও জাতির সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করার মাঝেই নাগরিক জীবনের সার্থকতা নিহিত। স্বদেশের উপকার ও কল্যাণের জন্য দায়িত্ববোধ, দেশের সামান্যতম অকল্যাণ দেখেও হৃদয় ব্যথিত হওয়া, দেশ ও দেশের মানুষের জন্য ভালোবাসার প্রকাশ এসব মানবীয় গুণাবলির নামই হচ্ছে স্বদেশপ্রেম। দেশ ও জাতির প্রতি প্রেমহীন মানুষ সত্যিকারের মানুষ হতে পারে না। প্রেমহীন এহেন মানুষ ও বিবেকহীন পশুর মধ্যে কোনই পার্থক্য নেই। যারা নিবেদিতচিত্তে দেশকে ভালোবাসে এবং দেশ ও জাতির উপকারে আত্মোৎসর্গ করে প্রকৃতপক্ষে তারাই মানুষ, দেশপ্রেমিক ।

স্বদেশপ্রেমের উৎস : স্বদেশপ্রেম সকলের অন্তরেই থাকে। কখনও এ প্রেম থাকে সুপ্ত অবস্থায় কখনও থাকে অন্তরের অন্তঃস্থলে। সুখের দিনে স্বদেশপ্রেম সুপ্ত অবস্থায় থাকে। দুঃখের দিনে আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হয়ে স্বদেশপ্রেম উদ্দীপিত হয়ে ওঠে। পরাধীনতার দুঃখ, বেদনায় পরদেশীর অকথ্য নির্যাতনে অন্তরের সুপ্ত স্বদেশপ্রেমের ঘুম ভাঙে কিংবা দেশ যখন শত্রুর আক্রমণে পর্যুদস্ত হয়, তখন সমগ্র জাতি স্বদেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে স্বদেশের ও স্বজাতির মান-মর্যাদা রক্ষাকল্পে রণক্ষেত্রে প্রাণ বিসর্জন দেবার জন্য দলে দলে ছুটে যায় তখন মনে হয় ‘নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান ক্ষয় নাই, তার ক্ষয় নাই।' প্রকৃতপক্ষে স্বদেশপ্রেমের উদ্ভব আত্মসম্মানবোধ থেকে। যে জাতির আত্মসম্মানবোধ যত প্রখর, সে জাতির স্বদেশপ্রেম তত প্রবল। স্বদেশপ্রেম এক প্রকার পরিশুদ্ধ ভাবাবেগ। নিঃস্বার্থ হিংসাবিহীন দেশপ্রেমই প্রকৃত স্বদেশ প্রেম। ব্যক্তিগত ক্ষুদ্রস্বার্থের গণ্ডি উপেক্ষা করে বৃহত্তর স্বার্থের দিকে মন যখন পরিচালিত হয়, যখন আত্মকল্যাণ অপেক্ষা বৃহত্তর কল্যাণবোধ সক্রিয় হয়ে ওঠে, তখন জ্বলে ওঠে স্বদেশের প্রতি ভালোবাসার নিষ্কলুষ প্রদীপ শিখা । স্বদেশপ্রেমিকের দেশ সেবার পথে বাধা অনেক। কিন্তু পথের ঝড়, ঝঞ্ঝা, বজ্রপাত তাদের দৃঢ় বলিষ্ঠ পদক্ষেপের নিকট মিথ্যে প্রমাণিত হয়। ইতিহাসের পানে তাকালে এর ভুরিভুরি দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। পরদেশী কিংবা স্বৈরশাসকের রক্তচক্ষু কিংবা উদ্যত অস্ত্র তাদের নিবৃত্ত করতে পারে না। আমাদের বাংলাদেশের ইতিহাসও স্বদেশপ্রেমের গর্বে গর্বিত। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬১ সালের গণঅভ্যুথান, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধ এবং সর্বশেষে ১৯৯০ সালের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থান আমাদের স্বদেশপ্রেমের প্রমাণ দেয়।

স্বদেশপ্রেমের অভিব্যক্তি : সভ্যতার অগ্রগতির পথে এক সময় যাযাবর মানুষ সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস শুরু করে, সৃষ্টি হয় রাষ্ট্রের। জীবন ও সম্পদের নিশ্চয়তা পেল। রাষ্ট্র কর্তৃক মানুষের জন্য এই যে অবদান- তা যুগান্তকারী এবং সুদূরপ্রসারী। আত্মীয়- স্বাধীনভাবে চলার পথ যখনই রুদ্ধ হয়েছে তখনই মানুষ শিকার হয়েছে নির্যাতন আর নিষ্পেষণের। আত্মসম্মান, স্বজন, ধন-সম্পদ সব হারাতে হয়েছে। বিচারের বাণী কেঁদে ফিরেছে নীরবে-নিভৃতে। এই অভিজ্ঞতা থেকে মানুষের মনে উজ্জীবিত হয়েছে স্বদেশপ্রেম। ফলে মানুষের জন্মভূমির প্রতি এক নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠে। স্বদেশ যেমন মাতৃস্নেহের ন্যায় তাকে লালন করে, স্বদেশের জন্যও সে তেমনি জীবন পণ করতে শেখে ।

স্বদেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে যুগে যুগে মানুষ বিভিন্নভাবে নজির স্থাপন করে গেছে। আমাদের এই সুজলা-সুফলা সোনার বাংলাকে ভালোবেসে এবং স্বাধীনতা রক্ষায় অথবা স্বাধীনতা সংগ্রামে কত মানুষ যে নিজের প্রাণ বিলিয়ে দিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। ইংরেজ বেনিয়াদের তাড়াতে যেয়ে অকাতরে তিতুমীর বুকের রক্ত দিয়েছে, স্বদেশের গান গেয়ে ক্ষুদিরাম ঝুলেছে ফাঁসির কাষ্ঠে, কারাগারের শিকল ভাঙার গান গেয়েছেন কাজী নজরুল ইসলাম। পাক-কুশাসন থেকে মুক্তির জন্য লড়তে গিয়ে শেখ মুজিবকে কারাবরণ করতে হয়েছে, ত্রিশ লক্ষ মানুষ ঢেলে দিয়েছে বুকের তাজা রক্ত, তিন লক্ষ মা বোনকে বিসর্জন দিতে হয়েছে সম্ভ্রম। স্বদেশের জন্য এই যে উচ্ছ্বাস তা সালাম, বরকত, রফিক, সফিক, জব্বাররা দেখিয়ে গেছে বুকের রক্ত ঝরিয়ে। বর্তমান বিশ্ব সংসার বা বর্তমান সভ্যতা নানা দেশপ্রেমিকের অবদানমাত্র। সমাজ সংস্কার, রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠা, আবিষ্কার, সেবা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চা ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করে এই বিশ্বসভ্যতা উপহার দিয়েছেন তাঁরা। ধর্মের বাণী মানুষকে শান্তির পরশ বুলিয়ে দিয়েছে কিন্তু ধর্মের প্রবক্তাগণ নিজেরা জীবন বিসর্জন দিয়ে ধর্মীয় সত্য প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। নবী ও রাসূলগণ এই পন্থায় দেশ ও সমাজের সেবা করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হতে আমাদেরও তাদের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করা উচিত।


স্বদেশপ্রেমের প্রভাব : মানব চরিত্রের গুণাবলি বিকাশের ক্ষেত্রে স্বদেশপ্রেম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। স্বদেশপ্রেমের চেতনায় উজ্জীবিত হলে তার মন ও মানসিকতা সদর্থক গুণের সমাবেশ ঘটে। তার মন থেকে সংকীর্ণতা ও স্বার্থপরতা দূরীভূত হয়। স্বদেশপ্রেমের কারণে দেশ ও জাতির জন্য কল্যাণ চিন্তা জাগ্রত হয় ফলে জনসেবার অনুভূতি জাগে। স্বদেশপ্রেম মানুষকে উদার করে, আত্মসুখ বিসর্জনের প্রেরণা দান করে। এ কারণে যারা দেশপ্রেমিক তারা নিজের স্বার্থ ত্যাগ করে পরের উন্নয়ন সাধন করে। তার উদাহরণ দেশমাতৃকার সঙ্কটকালে অনেক বীর সন্তানেরা নিজের জীবন দিয়ে স্থাপন করেছেন। দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে যারা নিজের জীবন দিয়ে দেশ স্বাধীন করেছে তারা স্বদেশপ্রেমের চূড়ান্ত নজির রেখেছেন। যারা বুদ্ধিজীবী, কবি, সাহিত্যিক তাঁরা তাঁদের লেখার মাধ্যমে স্বদেশপ্রেমের পরিচয় দেন। তাদের লেখা কবিতা, গান শুনে অনেক মানুষ স্বদেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়। রাজনীতিবিদ, চিকিৎসক, শিক্ষক, বিজ্ঞানী প্রকৃতি নানাক্ষেত্রের মানুষ আপন আপন কর্মের মাধ্যমে স্বদেশপ্রেমের প্রকাশ ঘটিয়ে থাকেন। তাদের দ্বারাও মানুষ দেশাত্ববোধে উদ্বুদ্ধ হয়। দেশের প্রতি সকল মানুষের মমত্ববোধ স্বদেশপ্রেমের উজ্জ্বল নমুনা।

স্বদেশপ্রেমের উপায় : প্রতিটি মানুষের মাঝেই মন-মনন, চিন্তা-চেতনা, মেধা-প্রজ্ঞার পার্থক্য রয়েছে স্বদেশপ্রেমের উপায় সম্পর্কেও ভিন্নতা থাকে। তাছাড়া মানুষের শিক্ষা, যোগ্যতা ও অবস্থানগত পার্থক্যও একটি বড় কারণ। তবে সকল মানুষের নামামুখী ভিন্নতা থাকলেও স্বদেশপ্রেমের দৃষ্টান্ত স্থাপনের ক্ষেত্রে কেউ কারও থেকে কম যায় না। কারণ স্বদেশপ্রেমের চেতনা কারও চেয়ে কারও কম নয়। বরং প্রতিটি মানুষই স্ব স্ব অবস্থানে থেকে স্বদেশপ্রেমের দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে চায়। স্বীয় দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালনের মধ্যেও স্বদেশপ্রেমের মহিমা নিহিত। দেশ ও জাতির জন্য সকল মানুষেরই কিছু না কিছু করার থাকে। যদি দেশের জন্য সামান্য অবদানও রাখা যায় তবে দেশপ্রেমের নিদর্শন রাখা যায়। উগ্র স্বদেশপ্রেম দেশ ও জাতি উভয়ের জন্যই ক্ষতিকর। অন্ধ দেশাত্মবোধ জাতিগত দাঙ্গা সৃষ্টি করে। ফলে দেশ ও জাতির ক্ষতি সাধিত হয়। উদারনৈতিক স্বদেশপ্রেমের মাধ্যমে বরেণ্য ব্যক্তিদের মত দেশপ্রেমের দৃষ্টান্ত স্থাপন করাই সকলের কাম্য হওয়া উচিত।

স্বদেশপ্রেম ও বিশ্বপ্রেমের সম্পর্ক : অনেকে খাঁটি দেশপ্রেমের সংজ্ঞা বিশ্বপ্রেম বা আন্তর্জাতিকতাবাদের সম্পর্ক গুলিয়ে বদশমে ফেলেন। তারা মনে করেন দেশকে ভালোবাসার অর্থই অন্য দেশকে দাবিয়ে রাখা, যেনতেনভাবে অন্য দেশের প্রতি স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠা। অথচ প্রকৃত দেশপ্রেমের সঙ্গে বিশ্বপ্রেমের কোন বিরোধ নেই। বিশ্বের দরবারে নিজের দেশকে এক ও অদ্বিতীয় করে তোলা অবশ্যই সুস্থ স্বাভাবিক মানসিকতার লক্ষণ। কিন্তু জোর জবরদস্তি করে সেই অধিকার ছিনিয়ে নিতে গেলে তার ফল কখনোই মঙ্গলজনক হয় না। বাংলাদেশ তৃতীয় বিশ্বের অন্যতম উন্নয়নশীল দেশ। বাংলাদেশের স্বার্থ যাতে অক্ষুণ্ণ থাকে সেদিকে নজর দেয়া সকলের কর্তব্য। বিশ্বব্যাপী প্রতিযোগিতা, ছল-চাতুরিতে রূপান্তরিত হলে বিভিন্ন দেশের মধ্যে সম্পর্কের বাঁধন আলগা হয়ে যেতে পারে। পৃথিবীর ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, বহু বীরযোদ্ধা শান্তির নামে দেশের শান্তি বিঘ্নিত করেছে। জার্মানির হিটলার, গ্রীসের আলেকজান্ডার, ইরানের নাদির শাহ নিজেদেরকে শ্রেষ্ঠ দেশপ্রেমিক হিসেবে প্রমাণ করার জন্য, বহুদেশের কপাল পুঁড়িয়েছে। একথা ভুললে চলবে না যে, দেশকে ভালোবাসার দোহাই দিয়ে অনেক সময় আঞ্চলিকতাবাদের জন্ম হয়। কাজেই বাঁচো এবং বাঁচতে দাও নীতিই প্রকৃত দেশপ্রেমকে উদ্বুদ্ধ করে। এই দেশপ্রেমের ধরন কখনো বিশ্বপ্রেমের পরিপন্থী নয় বরং স্বাভাবিক আন্তর্জাতিক বিশ্ব গড়তে রসদ যোগায়।

উপসংহার : পরিশেষে বলতে হয়, দেশপ্রেমের কোন বিকল্প নেই। শিশুমনে দেশপ্রেমের ভাব জাগাতে হবে। ছাত্রদের মধ্যে গড়ে তুলতে হবে দেশপ্রেমের অভ্যাস। বর্তমান বাংলাদেশের উন্নয়নশীল সমাজ ছাত্রসমাজের দায়িত্ব ও শৃঙ্খলা দাবি করে। ছাত্রসমাজের মনে রাখতে হবে যে, ছাত্রজীবনই হলো দায়িত্ববোধ বিকাশের কাল, সামাজিক কর্তব্যবোধে দীক্ষিত হওয়ার সময়। বর্তমানের নৈরাশ্যের অন্ধকার কিংবা রুচিবিকৃতির কুয়াশা অপসারিত হয়ে শীঘ্রই নতুন আশা ও আদর্শের সূর্যোদয় হবে। এরপর আসবে নতুন দিন, নতুন জীবন। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে ছাত্র সমাজকে সেই সুদিন ছিনিয়ে আনতে হবে।
Next Post Previous Post