বাংলা রচনা : আধুনিক জীবন ও প্রযুক্তি

আধুনিক জীবন ও প্রযুক্তি

আধুনিক জীবন ও প্রযুক্তি
আধুনিক প্রযুক্তি বিদ্যা 

[ রচনা সংকেত : সূচনা, আধুনিক জীবনের স্বরূপ, জীবনের সাথে প্রযুক্তির সম্পর্ক, প্রযুক্তির অগ্রগতি ও জীবনের উন্নয়ন, প্রযুক্তির বিরূপ প্রভাব, উপসংহার। ]

সূচনা : বিজ্ঞানের যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে কালের গতিশীলতার সাথে তাল মিলিয়ে মানুষ যে জীবন যাপন করছে, তাকেই বলে আধুনিক জীবন। আর বিজ্ঞানের জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে মানুষ যা আবিষ্কার করছে, তা-ই প্রযুক্তি। মানুষ সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য তাদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে প্রযুক্তি সৃষ্টি করছে। বিজ্ঞানের জ্ঞানকে যে পদ্ধতির মাধ্যমে বিভিন্ন আবিষ্কার বা উৎপাদনের রূপ দেয়া হয়, তাকে বলে প্রযুক্তিবিদ্যা। এ প্রযুক্তিবিদ্যার সীমাহীন কল্যাণে আমাদের জীবনকে সুখময় করার যা কিছু প্রয়োজন, জীবনের বিকাশের জন্য যা কিছুর সমাবেশ সবই প্রযুক্তিবিদ্যার বিচিত্র অবদান হিসেবে বিবেচ্য। বিভিন্ন প্রযুক্তি ব্যবহারের মধ্য দিয়েই মানুষ আধুনিক জীবনে পদার্পণ করতে সমর্থ হয়েছে। যখন কোনো প্রযুক্তির সৃষ্টি হয়নি, মানুষ তখন অনাধুনিক জীবন যাপন করত। প্রযুক্তির কল্যাণে মানুষের কাছে সবকিছু সহজ থেকে সহজতর হচ্ছে। বিদ্যুৎ আবিষ্কার, টেলিফোন, টেলিভিশন, জেনারেটর, কম্পিউটার ইত্যাদি প্রযুক্তি মানব জীবনকে যেমন করেছে আরামদায়ক তেমনি করেছে আধুনিক। আধুনিক জীবন ও প্রযুক্তি একে অপরের পরিপূরক। প্রযুক্তি ব্যতীত আধুনিক জীবন কল্পনা করা যায় না।

আধুনিক জীবনের স্বরূপ : আধুনিক জীবন বলতে আমরা এমন জীবনকে বুঝি, যে জীবন চিন্তা-চেতনায় আধুনিকতা লালন করে, যে জীবন নিজ সম্পর্কে সচেতন এবং বিজ্ঞানের যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে পৃথিবীকে নিজের আয়ত্তে আনতে সমর্থ এমন জীবনকে। মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশের ধারায় আমরা এখন যে অবস্থানে রয়েছি, আজ থেকে দুশ' বছর পূর্বে জীবনের এ অবস্থানে ছিলাম না। মানুষকে বর্তমান জীবনে পৌঁছতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। আদিম মানুষের প্রতি লক্ষ করলে আমরা সহজেই অনুধাবন করতে পারি, আমাদের সাথে তাদের কত পার্থক্য ছিল। এককালে মানুষের শরীরে পোশাক ছিল না। তারা গাছের পাতা অথবা বাকল পরিধান করত। তারা আগুনের ব্যবহার জানত না। সবকিছু কাঁচাই খেত। সময়ের বিবর্তনে মানুষ বর্তমান অবস্থানে উপনীত হতে পেরেছে। আধুনিক হতে হলে মানুষকে হতে হয় শিক্ষিত। শিক্ষা ছাড়া আধুনিক জীবন কল্পনা করা যায় না। শুধু শিক্ষিত হলেই আধুনিক জীবন যাপন করা যায় না। আমরা যদি মনেপ্রাণে আধুনিকতা লালন না করি, তাহলে কখনও আধুনিক জীবনের দাবি করতে পারব না। মানুষ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রযুক্তি ব্যবহারের চেষ্টা করছে। আমরা যেসব কাজ যন্ত্র দ্বারা করতে পারছি, সেসব যন্ত্র দ্বারাই সমাধা করার চেষ্টা করছি। প্রযুক্তি আমাদের শারীরিক পরিশ্রম অনেকাংশে লাঘব করেছে। কর্মক্ষেত্রে মানসিক শ্রমের প্রয়োগ ঘটছে, এটিই আধুনিকতার লক্ষণ। আমরা আজ কুসংস্কারমুক্ত সমাজ আশা করছি, সব সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে মানুষকে বিবেচনা করছি, বাস্তবমুখী চিকিৎসা গ্রহণ করছি, ঘরে এবং বাইরে প্রযুক্তির ব্যবহার করছি এ সবই আধুনিকতার লক্ষণ। 

জীবনের সাথে প্রযুক্তির সম্পর্ক : জীবনের সাথে প্রযুক্তি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। প্রযুক্তি আধুনিক জীবনের সাথে এমনভাবে মিশে রয়েছে যে, এটি ছাড়া আধুনিক জীবন কল্পনা করা যায় না। প্রযুক্তিই মানব জীবনকে করেছে স্বাচ্ছন্দ্যময়, আরামদায়ক, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে মানুষ প্রযুক্তির ব্যবহার করতে সচেষ্ট হচ্ছে। আমরা ব্যক্তিগত জীবনের পাশাপাশি জাতীয় জীবনেও প্রযুক্তির ব্যবহার করছি। এমন এক সময় ছিল যখন মানুষের জীবনে আধুনিকতার ছোঁয়া ছিল না। তারা অনেকটা অসহায় জীবন যাপন করত। আমরা এখন গৃহকর্ম থেকে শুরু করে বাইরের অনেক কাজে প্রযুক্তির ব্যবহার করছি। আমরা এক স্থান থেকে অন্য স্থানে খুব সহজেই যাতায়াত করতে পারছি। এর পেছনে রয়েছে প্রযুক্তির অবদান। বাস, ট্রাক, লঞ্চ, স্টিমার, রেলগাড়ি সবই প্রযুক্তির অবদান। যোগাযোগ ব্যবস্থার এ সব মাধ্যম আমাদের যাতায়াতকে করেছে সহজতর। মধ্যপ্রাচ্য, পাশ্চাত্য বা আমেরিকা যেতে আমাদের আর মাসের পর মাস সময় ব্যয় করতে হয় না। ইচ্ছে হলেই স্বল্প সময়ের ব্যবধানে আমরা গন্তব্যস্থলে পৌঁছতে পারি। মানুষ মাত্রই পরিশ্রম করতে হয়। পরিশ্রম করে বাসায় ফিরে চিত্তবিনোদনের মাধ্যমে আমরা আমাদের কষ্ট লাঘব করি। টেলিভিশন, বেতার প্রভৃতি আমাদের সহায়ক হিসেবে বিবেচিত হয়। এসবই বিজ্ঞানের দান। ময়লা কাপড় এখন আর হাতে পরিষ্কার করার দরকার হয় না। ইচ্ছে করলে যন্ত্রের সাহায্যে আমরা এসব কাপড় স্বল্প সময়ে পরিষ্কার করতে পারি। রান্না থেকে শুরু করে অনেক কাজ এখন যন্ত্রের সাহায্যে সমাধা করা সম্ভব হচ্ছে। অর্থাৎ জীবনের সাথে প্রযুক্তি এমনভাবে জড়িয়ে গেছে যে, আমরা ইচ্ছে করলে এটা বাদ দিয়ে উন্নত জীবন যাপন করতে সমর্থ হব না।

প্রযুক্তির অগ্রগতি ও জীবনের উন্নয়ন : বর্তমান যুগে মানব জীবনের বিভিন্ন শাখায় বিজ্ঞানের বহুবিধ অবদান পরিলক্ষিত হচ্ছে। যাতায়াত, কৃষি, শিক্ষা, চিকিৎসা, প্রকৌশলসহ মানব জীবনের বহুক্ষেত্রে বিজ্ঞান বড় অবদান রাখছে। প্রযুক্তির অগ্রগতির সাথে সাথে জীবনের সামগ্রিক উন্নয়ন সাধিত হচ্ছে। প্রযুক্তির কল্যাণে কৃষিতে মানুষ এনেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। মানুষ তৈরি করেছে ট্রাক্টরসহ নানা রকম কৃষি যন্ত্রপাতি। মানুষ এখন ভূঅভ্যন্তর হতে পানি উত্তোলন করে সেচ কাজ সমাধা করছে। প্রযুক্তির কল্যাণে অধিক ফসল উৎপাদন করে খাদ্য চাহিদা মেটানো হচ্ছে। বিজ্ঞান আজ দূরকে করেছে কাছের। বিজ্ঞানের বদৌলতে মানুষ আবিষ্কার করেছে দ্রুতগামী যানবাহন, বুলেট ট্রেন, শব্দাতিগ উড়োজাহাজ ইত্যাদি। মানুষ টেলিভিশন, ফ্যাক্স, রেডিও, ই-মেইলের সাহায্যে সারা বিশ্বের খবর যে কোন মুহূর্তে পেয়ে যেতে পারে। ইন্টারনেটের সাহায্যে লেনদেন করা যাচ্ছে কম্পিউটারের তথ্যাবলি। এভাবে বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি সারা বিশ্বকে মানুষের হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে। চিকিৎসাক্ষেত্রে প্রযুক্তির অগ্রগতি বিস্ময়কর। চিকিৎসা বিজ্ঞানে ফাইবার অপটিক্স ব্যবহারের ফলে মানবদেহের অভ্যন্তরস্থ ফুসফুস, পাকস্থলী, বৃহদন্ত্র, ক্ষুদ্রান্ত্র, উদর, অস্থিগ্রন্থি, শিরা, ধমনী ইত্যাদির অবস্থা যন্ত্রের সাহায্যে অবলোকন করে নির্ভুলভাবে রোগ নির্ণয় করা যায়। বিভিন্ন ধরনের ঔষধ আবিষ্কারের ফলে অনেক কঠিন রোগ নিরাময় করা সম্ভব হচ্ছে। সামাজিক জীবনে তো বটেই গৃহকর্মেও বিদ্যুৎ শক্তির প্রভাব ব্যাপক। আলো, পাখা, ইলেকট্রিক ইস্ত্রি, এয়ার কন্ডিশনার সবই প্রযুক্তির অবদান। শিক্ষাক্ষেত্রেও বিজ্ঞানের ব্যবহার লক্ষণীয়। শিক্ষার প্রয়োজনীয় উপাদানগুলোর প্রায় সবই বিজ্ঞানের উদ্ভাবন। বর্তমানে বিজ্ঞান শিক্ষা ব্যবস্থাকে করেছে আরও আধুনিক ও উন্নত। বিভিন্ন শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান প্রচারের মাধ্যমে রেডিও টেলিভিশন শিক্ষার মাধ্যমে পরিণত হয়েছে। কম্পিউটার বিশ শতকের এক বিস্ময়কর আবিষ্কার। কম্পিউটার এমন এক মহাপরাক্রমশালী অথচ অনুগত যন্ত্র যা মানুষের কর্মজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে অবলীলায় অক্ষরে অক্ষরে প্রতিটি হুকুম পালন করে। আজকের দিনে তাই মানব সভ্যতা হয়ে পড়েছে কম্পিউটার নির্ভর। কম্পিউটার আবিষ্কারের ফলে মানুষের কর্মক্ষমতা, দক্ষতা ও নিয়ন্ত্রণশক্তি বেড়ে গিয়েছে বহুগুণ, বৃদ্ধি পেয়েছে উৎপাদন ক্ষমতা। অনেক সহজ হয়ে উঠেছে প্রশাসনিক কাজকর্ম ও হিসাব-নিকাশের জটিলতা। অনাবশ্যক অনেক মানসিক শ্রমের হাত থেকেও রেহাই পেয়েছে মানুষ। প্রযুক্তির অগ্রগতির সাথে সাথে মানব জীবন হয়ে উঠছে আরও উন্নত, আরও আধুনিক। 

প্রযুক্তির বিরূপ প্রভাব : প্রযুক্তির কল্যাণে মানব সভ্যতা এগিয়ে গিয়েছে সত্যি, কিন্তু এটি শুধু মানুষের উপকারই সাধন করেনি, অনেক অপকারও করেছে। প্রযুক্তি মানব জীবনকে যেমন করেছে সহজ ও সচ্ছল, তেমনি বাড়িয়েছে বেকারত্ব। আগে যে কাজ করতে হাজার হাজার লোক লাগত, এখন সে কাজ স্বল্প লোক স্বল্প পরিশ্রমে সমাধা করতে পারছে। বৈজ্ঞানিক যন্ত্র সংবলিত বড় বড় যন্ত্রচালিত গাড়িগুলো নষ্ট করছে পরিবেশ, ক্ষতিসাধন করছে মানুষের 13 জীবনের। বৈজ্ঞানিক গবেষণায় ব্যবহৃত বিভিন্ন তেজস্ক্রিয় পদার্থ নষ্ট করছে পরিবেশ, ক্ষতি সাধন করছে মানুষের। বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের ফলে মানুষ তৈরি করছে বড় বড় অস্ত্র। আজ মানুষে-মানুষে, ধর্মে-ধর্মে, জাতিতে-জাতিতে, দেশে-দেশে যে যুদ্ধ চলছে তা সবই সম্ভব হচ্ছে প্রযুক্তির জন্য। বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের ভয়াবহতা পৃথিবীর মানুষ সবচেয়ে বেশি প্রত্যক্ষ করেছিল প্রথম ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করে অসংখ্য শহর-বন্দর ধ্বংস করা হয়েছিল। প্রযুক্তির অপব্যবহারের জন্য আমরা বিজ্ঞানকে দায়ী করতে পারি না। এর জন্য দায়ী প্রযুক্তির অপপ্রয়োগকারী মানুষেরা।

উপসংহার : প্রযুক্তির কল্যাণেই সমগ্র বিশ্ব আজ মানুষের হাতের মুঠোয়। বিজ্ঞানের নব নব উদ্ভাবনের মাধ্যমে মানব জীবন সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। ঘরে-বাইরে সর্বত্রই আজ বিজ্ঞানের নিয়ন্ত্রণ অপরিসীম। বাইরে তো বটেই, ঘরের ভেতরেও বিজ্ঞান আমাদের ওপর তার প্রভুত্ব বাড়িয়ে চলেছে। শুধু শহরের জীবনেই নয়, গ্রামীণ জীবনেও প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে। আমরা যদি গ্রামের অধিবাসীদের পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রযুক্তিগত সুযোগ-সুবিধা না দেই, তাহলে পিছিয়ে পড়বে গ্রামীণ জনগোষ্ঠী, পিছিয়ে পড়বে আমাদের এ বাংলাদেশ। মানব জীবনে প্রযুক্তির সার্থক ও ইতিবাচক প্রয়োগ ঘটাতে হবে। প্রযুক্তির আলোকে মানব জীবন আলোকিত করতে হবে।

Next Post Previous Post