বাংলা রচনা : মানব কল্যাণে সাহিত্য

মানব কল্যাণে সাহিত্য

মানব কল্যাণে সাহিত্য

[ রচনা সংকেত : ভূমিকা, বর্ণনা, উপসংহার। ]

ভূমিকা : মানুষের স্বভাব সমাজবদ্ধভাবে বাস করা। এ সুন্দর পৃথিবীতে মানুষ একা বাস করতে পারে না। সমাজের অবলম্বন প্রেম, প্রীতি ও বিশ্বাস। দৈনন্দিন জীবনের কাজকর্মের প্রয়োজনে মানুষকে ভালোমন্দ অনেক কথা বলতে হয়। যেসব অর্থপূর্ণ কথা মানবের কল্যাণ সাধন করে এবং যা শুনলে শ্রোতার মনে জ্ঞানের সঞ্চার হয়, তা-ই সাহিত্য। অনেক সমালোচকের মতে সাহিত্যের কাজ মানুষের মনে আনন্দ সৃষ্টি করা ছাড়া আর কিছুই নয়। বাস্তব জীবনের বহু ঘাত- প্রতিঘাতে মানুষ প্রতিনিয়ত জর্জরিত। এ ব্যথাভরা জগতের অন্তরালে যে আনন্দের জগৎ বিদ্যমান, মানুষ সাহিত্যের মধ্য দিয়েই তার নাগাল পায় ।

বর্ণনা : মানুষের সামগ্রিক কল্যাণ এবং তার সাংস্কৃতিক উৎকর্ষের পক্ষে সাহিত্য আজ অগ্রদূত। সমাজ বহু জীবনকে বাইরের দিক থেকে এক করে, সাহিত্য মানসিকভাবে বহু হৃদয়কে এক নিগূঢ় ঐক্যানুভূতি দ্বারা গ্রথিত করে। তাই সাহিত্য ও মানব মৈত্রীর বাণী নিয়ে এগিয়ে এসেছে। সাহিত্যের আনন্দ সৃষ্টিকে অনেকে খেলার আনন্দের সাথে তুলনা করেছেন। সাহিত্য মানুষের মনের গহনে শুধু সাড়াই র গহনে শুধু সাড়াই জাগায় না, মানুষের সাথে মানুষকে একাত্ম করে দিতে সাহিত্যই সবচেয়ে শক্তিশালী বাহক। 

মানবতা ও মানবিকতার স্ফূরণ ঘটাতে সাহিত্য টনিকের মতো কাজ করে। মানুষকে যথার্থ শান্তি ও কল্যাণের পথ প্রদর্শন করে সাহিত্য মানুষের মাঝে সম্প্রীতি গড়ে তোলে। সাহিত্যের বাণী— অত্যাচার, নিষ্ঠুরতা ও স্বার্থপরতার বিপক্ষে। উচ্চ জীবন, পরার্থপরতা ও সত্যের মহিমা উপলব্ধিতে সাহিত্যই মানুষকে সাহায্য করে। মানুষের উপদেশ — বাক্যে যা হয়নি, বিশ্ব স্বস্তি পরিষদ যা করতে পারেনি অথবা নোবেল সমিতির শান্তি পুরস্কার বিতরণেও যা সার্থক হয়ে ওঠেনি, সাহিত্য অনায়াসে তা করতে পেরেছে। সাহিত্যের বাণী মানবকল্যাণের বাণী। মানুষের মনে আত্মবোধের সৃষ্টিই সাহিত্যের মহান লক্ষ্য।

জ্ঞানের ভাণ্ডার সাহিত্য মানুষের মন-মনন ও মেধার বিকাশ সাধন করে। সাহিত্য মানুষকে নীতি শিক্ষা দান করে আদর্শবান মানুষ হওয়ার পথ দেখায়। যদিও বিষয় বিতর্কের, তারপরও সাহিত্য যে মানুষকে শিক্ষা দান করে তা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। কেননা সত্যযুগে ‘রামায়ণ' রচিত হয়েছিল মানুষকে নীতিশিক্ষা দেয়ার জন্য। কিন্তু কালের বিবর্তনে সাহিত্য সম্পর্কে মানুষের ধ্যান-ধারণা ও চিন্তা-চেতনার পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। যে কারণে মানুষ এখন আর সাহিত্যকে শিক্ষা দানের বিষয় বলে মনে করে না। বরং সাহিত্যকে অনেকে খেলার সাথে তুলনা করেছেন। অর্থাৎ সাহিত্যের মধ্যদিয়ে মানবাত্মার খেলা সৃষ্টি হয়। আর সাহিত্যিক খেলার ছলে সাহিত্যকর্ম রচনা করেন।

প্রখ্যাত প্রাবন্ধিক প্রমথ চৌধুরী মনে করেন সাহিত্য কারও মনোরঞ্জনের বিষয় নয়। কেননা সাহিত্যকে অনেকেই মনোরঞ্জনের বিষয় বলে মনে করেন। কিন্তু সাহিত্য যদি কারও মনোরঞ্জন করে তবে তা স্বধর্মচ্যুত হয়ে যায়। কারণ মনোরঞ্জন করতে গেলে সেখানে অনেক গর্হিত বিষয় এসে যেতে পারে। আমাদের বর্তমান সাহিত্যের একটি বড় অংশ এ কাজে প্রবৃত্ত হয়েছে। যা সাহিত্য ও সাহিত্য পাঠক উভয়ের জন্যই ক্ষতির কারণ। সাহিত্য যদি মনোরঞ্জনের বিষয় হয় তবে তা আজকে অদৃত হলেও দুদিন পর বর্জিত হবে। কারণ শিশু আজ যে খেলনা পছন্দ করে কাল তা আর পছন্দ করে না। কাজেই সাহিত্যে খেলা করতে গিয়ে তা যেন খেলনা না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। 

সাহিত্য সমাজজীবনে কল্যাণ সাধন করে। এ কল্যাণের দৃ এ কল্যাণের দৃষ্টান্ত অসংখ্য রয়েছে। এক সময় সমাজজীবন তথা রাষ্ট্রীয় জীবনে অনেক কুসংস্কার প্রচলিত ছিল। কিন্তু সাহিত্যিকগণ যে সকল বিষয় সাহিত্যের মধ্যদিয়ে জনসমক্ষে তুলে ধরেছেন। ধীরে ধীরে যে সকল কুসংস্কার সমাজ রাষ্ট্র থেকে নির্মূল হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ হিন্দু সমাজ ব্যবস্থার নানা কুসংস্কার উল্লেখযোগ্য, যা পরবর্তীতে পরিবর্তিত হয়েছে। বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন তাঁর প্রবন্ধে নারীদের পশ্চাৎপদতার কারণ তুলে ধরে তা সমাধানের পথ নির্দেশ করেছেন। এক সময় তাও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যে কারণে আজকের দিনে নারী ও পুরুষের কোন বৈষম্য নেই। যা কিনা মহৎ সাহিত্যেরই দান।

পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম সাহিত্য আনন্দরসের উত্তরাধিকারী সবার মনেই প্রেম-ভালোবাসা, স্নেহ-প্রীতি ইত্যাদি সদগুণ স্থান লাভ করে। কালিদাসের ‘মেঘদূত'-এর রসাস্বাদনে ইউরোপীয় মনীষী যেমন আনন্দ লাভ করেন, তেমনি জার্মান কবি গ্যাটের ‘ফাউস্ট’ বা হোমারের ‘ইলিয়ড’ ও ‘ওডিসি’ পাঠ করে ভারতীয় রসিক চিত্ত পুলকে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে। বিশ্বমানবকল্যাণে সাহিত্যের অবদান তাই অনস্বীকার্য।

সাহিত্য শিল্পের উপাদান মানবজীবন। সাহিত্যের সামাজিক প্রভাব আছে। 'Uncle Tom's Cabin' দাসপ্রথার বিরুদ্ধে প্রচারমূলক রচনা। সাহিত্যের অমোঘ আবেদন এ উপন্যাসটির মাঝে রয়েছে। দাস প্রথা আজ দেশ থেকে অপসারিত হয়েছে কিন্তু এ উপন্যাসে যে মানবিকতার সুর নিহিত আছে, তা তাকে চিরন্তন সাহিত্যের অমর আসনে বসিয়ে রাখবে। ম্যাক্সিম গোর্কির 'Mother' (মা) জার আমলে রাশিয়ার অত্যাচার, অবিচার ও পীড়িত অবস্থার বর্ণনা এবং তা থেকে মুক্তির পথ নির্দেশ। কিন্তু তা যুগ যুগ ধরে মানুষের মনে আনন্দ দান করে আসছে। দীনবন্ধু মিত্রের 'নীলদর্পণ' সম্পর্কে ঐ একই কথা প্রযোজ্য ।

সাহিত্য পাঠে আত্মা পরিমার্জিত হয়। আত্মাকে পতিত রেখে স্রষ্টার সাথে সংযোগ সাধন সম্ভব নয়। এ পৃথিবীতে বেঁচে থাকার পক্ষে শুধু বিশ্বাসই যথেষ্ট নয়— চিন্তা, জ্ঞানদৃষ্টিও অপরিহার্য। একমাত্র সাহিত্যই মানুষকে পরিচ্ছন্ন চিন্তা, জ্ঞান ও দৃষ্টি দান করে। সাহিত্য মহৎ আদর্শের প্রচারক। জীবনের অসংগতি ও অপূর্ণতা নির্দেশ করে সাহিত্য। সাহিত্য বাস্তব জীবনের সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করার প্রেরণা যোগায় ।

সাহিত্য একটা বিশেষ ধরনের আর্ট বা শিল্প। মানুষের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা এবং বহু বিচিত্র বাসনাকেই সাহিত্য শিল্পী তাঁর রচনার মধ্যে রূপায়িত করে তুলেন। সাহিত্য রচয়িতা সমাজেরই মানুষ। ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশে সৃষ্ট সাহিত্যের সর্বজনীন আবেদন তাহলে কি প্রকারে সম্ভব? এক দেশের লোকের পক্ষে যা সত্য অন্য দেশের লোকের পক্ষে তা কি প্রকারে অভিন্ন হতে পারে ?

প্রশ্নটির সদুত্তর পেতে হলে আমাদের জানা দরকার, সাহিত্যের সত্য আর জীবনের সত্য, উভয়ের মধ্যে পার্থক্য আছে। সংসারী মানুষের জীবনের অসম্পূর্ণতার সীমা নেই। মানুষ জীবনে যা পায় তা দ্বারা অন্তর কামনাকে সম্পূর্ণরূপে পূর্ণ করতে পারে না। কারণ সে যা চায় তা পায় না। রবীন্দ্রনাথ এ সত্যকে উপলব্ধি করে বলেছেন ー

'আমি যাহা চাই, তাহা ভুল করে চাই
যাহা পাই তাহা চাই না ।'

সাহিত্য মানুষকে অমরত্ব দান করে। সাহিত্য যুগ যুগ ধরে মানুষের অন্তরের বাণী বহন করে থাকে। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, “মানুষ সাহিত্য সৃষ্টি করে আপনাকে চিরজীবী করার জন্য। যুগ ও কালের শত রূপান্তরের কথা অতিক্রম করে তার ভাবনা যাতে ভবিষ্যতে বেঁচে থাকে এটাই তার অন্তরের কামনা। সাহিত্য সেই কামনা প্রভূত পরিমাণে রূপায়িত করে এবং পরলোকে ক্ষণজন্মা পুরুষ ললাটে অমরত্বের জয়-তিলক অঙ্কিত করে দেয়।”

উপসংহার : সূক্ষ্ম বিচারে দেখা যায় — সমাজ ও জীবনের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়া সাহিত্যে সম্ভব নয়। সাহিত্য বরাবরই সুন্দরের স্বার্থে রচিত হয়। এতে মানবধর্ম জড়িয়ে থাকতে বাধ্য। তাই আদর্শবাদী সাহিত্য যেমন সাহিত্য, বস্তুবাদী সাহিত্যও তেমনি সাহিত্য। সাহিত্যের নীতি সমাজনীতি থেকে আরও ব্যাপক, আরও উদার। এ শাশ্বত জীবননীতিকে সাহিত্যিক অস্বীকার করতে পারে না। তাই বাস্তববাদী শরৎচন্দ্রের মুখে শুনি ‘যা অসুন্দর তা নীতিবিরোধী, যা অকল্যাণ কিছুতেই তা আর্ট নয়, ধর্ম নয়।

'সত্যম শিবম সুন্দরম।'

একথা অবশ্যই সাহিত্যে অস্বীকার করার উপায় নেই ।

Next Post Previous Post