জাতি গঠনে ছাত্রসমাজের ভূমিকা সম্পর্কিত আলোচনায় সুধীবৃন্দের উদ্দেশে ভাষণ প্রস্তুত কর

জাতি গঠনে ছাত্রসমাজের ভূমিকা সম্পর্কিত আলোচনায় সুধীবৃন্দের উদ্দেশে ভাষণ প্রস্তুত কর

'জাতি গঠনে ছাত্রসমাজের ভূমিকা' সম্পর্কিত আলোচনায় সুধীবৃন্দের উদ্দেশে ভাষণ প্রস্তুত কর।
অথবা, ‘ছাত্র রাজনীতির একাল ও সেকাল' শীর্ষক সেমিনারে উপস্থাপনের জন্য প্রধান বক্তা হিসেবে একটি মঞ্চভাষণ প্রস্তুত কর।

আজকের এ আলোচনা সভার সম্মানিত অধ্যক্ষ মহোদয়, বিজ্ঞ আলোচকবৃন্দ ও সুপ্রিয় সুধীবৃন্দ আস্সালামু আলাইকুম । একটি জাতির গর্বের ধন কিংবা অহংকারের নাম ছাত্রসমাজ । সেই দেশই সমৃদ্ধ যে দেশের ছাত্রসমাজ জ্ঞানে-গুণে ও নৈতিক আদর্শে বলীয়ান । কিন্তু নানা কারণে আজ আমাদের দেশের ছাত্রসমাজের অতীত ঐতিহ্য অনেকটা ম্লান হয়ে পড়েছে; আর ছাত্রসমাজও নানা কারণে হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনতে পারছে না। আমাদের আপত্তির জায়গাটি এখানেই ।

সুপ্রিয় সুধীবৃন্দ
অনেকেই বলে আমরা নাকি বর্তমান নিয়ে সন্তুষ্ট নই বরং বরাবরই অতীতের স্মৃতিতে বেশি আবেগ-আপ্লুত হই । মোটেই নয়, আমরা ছাত্রসমাজের গৌরবগাথার বর্ণনা দিতে চাই না; তবে তার বাস্তব চিত্র আজও আমাদের চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে ভাসছে।

সম্মানিত সুধী
আমাদের ছাত্রসমাজ ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে '৪৭-এর দেশভাগ, ভাষা আন্দোলন, ছয় দফা, গণঅভ্যুত্থান এবং স্বাধীনতা যুদ্ধে যে অবদান রেখেছে তা চিরস্মরণীয় । তৎকালে আমাদের ছাত্ররা নেতৃত্বের যোগ্য উত্তরাধিকার হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন । তার প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তোফায়েল আহমদ, আব্দুর রাজ্জাক, আব্দুল কুদ্দুস মাখন, রাশেদ খান মেনন, মতিয়া চৌধুরীসহ আরও অনেকে । যারা অদ্যাবধি বাংলাদেশে কিংবদন্তি হয়ে আছেন।

প্রিয় সুধীবৃন্দ
তখনকার সময়ে এসব যোগ্য ছাত্রনেতাদের প্রতি আপামর জনগণের অগাধ ভালোবাসা আর অপরিসীম বিশ্বাস ছিল। জনগণ তাদের ভবিষ্যৎ-নেতা হিসেবে ছাত্রসমাজের প্রতি জুগিয়েছিল অকুণ্ঠ সমর্থন । এখনো এর শেষ স্রোতটি ক্ষয়িষ্ণু হয়ে রয়েছে। তাই তো সংসদে, রাষ্ট্রক্ষমতায়, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে সেই সময়কার ছাত্রসমাজের উপস্থিতি আমার বক্তব্যকে সমর্থন করে । অথচ আজ ছাত্রসমাজের হাল-হকিকত বড়োই করুণ।

প্রিয় সুধী
ছাত্রসমাজের কতিপয় হীন-স্বার্থপরের জন্য ছাত্রসমাজ আজ কলঙ্কিত। এখন রাজনীতিক সংকটের শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে ছাত্রসমাজের প্রতি মানুষের বিশ্বাসে যেন চিড় ধরেছে; নানা মেরুকরণে ছাত্রসমাজের অস্তিত্বও যেন বিপন্ন হতে চলেছে । আজ আর কোনো মেধাবী ছাত্র নেতৃত্বে নেই বরং ক্ষেত্র বিশেষে সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ, মাদকাসক্ত, চোরাকারবারি তথা ছাত্র নামধারীরা আজ প্রচণ্ড প্রতাপে সমস্ত ছাত্রসমাজকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাচ্ছে।

সম্মানিত সুধীমণ্ডলী
ছাত্রসমাজ যেন' একটি জীবন্ত আগ্নেয়গিরির নাম, আমাদের দেশের অসৎ সরকারি কর্মকর্তাসহ তথাকথিত রাজনীতিক নেতাদের হাতের পুতুল, গুণ্ডা-মাস্তান । তাই ছাত্রসমাজের প্রতি জনগণের প্রত্যাশা নীরবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে; পক্ষান্তরে, এক ছাত্র আরেক ছাত্রের বুকে নির্বিবাদে গুলি ছোড়ে। সত্যি এক বিচিত্র পরিস্থিতি। নেশার সামগ্রী আর অস্ত্র এখন সহজলভ্য এদের কাছে । তাই জাতি হিসেবে আমরা আর এখন এদের কাছে কী পেতে পারি! এমনিতে নানা সমস্যা জর্জরিত এদেশ, তারপর ছাত্রসমাজের এ ধরনের অপকর্মে লজ্জায় পড়তে হয়।

প্রিয় সুধী
কোনো এক বিশ্ববিদ্যালয়ের তথাকথিত ছাত্রনেতা যখন মার্সিডিজ চালিয়ে ধুলো উড়িয়ে যায়, তখন তারই শিক্ষক বাই-সাইকেলে বাসায় ফিরে। ছাত্রসমাজ আজ বইপুস্তক ছেড়ে দিয়ে অধঃপতনের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। এছাড়াও দেখা যায় নকলের দাবিতে কিংবা অন্যকোনো অবাঞ্ছিত আপত্তিতে বাধা দিলে দ্বিতীয় জন্মদাতা বলে খ্যাত প্রিয় শিক্ষককেও অপমান করতে ছাড়ে না । এ ধরনের ঘটনা প্রায়ই পত্রপত্রিকায় পাওয়া যায়।

সম্মানিত সুধীমণ্ডলী
ছাত্রসমাজের এই অধঃপতন শুধু তাদের নিজেদের জন্যই নয়; বরং সমস্ত জাতিকে এ ভার গ্রহণ করতে হবে । প্রথমত আমাদের বৈষয়িক চাহিদা এতটা বেড়ে গেছে যে, শিক্ষা নয় বরং সনদই প্রধান হয়ে দাঁড়িয়েছে । শিক্ষা যখন জ্ঞান বিস্তারের বাহন না হয়ে অর্থ উপার্জনের হাতিয়ার হয় তখন আর কী করার থাকে । এক্ষেত্রে অভিভাবকসহ আমাদের সকলের দোষ স্বীকার না করে উপায় নেই । অন্যদিকে, শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষক যখন শ্রেণিকক্ষের পড়াশুনা তৈরি না করে প্রাইভেট কিংবা কোচিং-এ আহ্বান করে, সংগত কারণেই সেই ধরনের শিক্ষকের প্রতি ছাত্রসমাজের শ্রদ্ধা থাকতে পারে না। এছাড়াও অধিকাংশ সময় ছুটি ও ক্লাস না হওয়ার সংস্কৃতি আমাদের ধীরে ধীরে পঙ্গু করে ফেলছে। নানা সময় প্রশ্ন ফাঁস-- ছাত্রসমাজে এক নৈরাজ্য সৃষ্টি করে চলছে। বিদ্যা-বুদ্ধি-সৌজন্য-ভদ্রতা আজ কর্পূরের মতো উবে গেছে।

প্রিয় সুধীবৃন্দ
নৈতিক শিক্ষার স্থানটি ক্রমাগত সংকুচিত হচ্ছে। শিক্ষা ক্ষেত্রে ছাত্রসমাজের মন-মানসিকতাকে সেভাবে তৈরি করা হচ্ছে না । এক্ষেত্রে বহুবিধ কারণও রয়েছে । ক্ষেত্র বিশেষে যোগ্য-মেধাবীরা শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাচ্ছে না; নানাভাবে শিক্ষক নিয়োগে দলবাজি ও অর্থের কারবার হচ্ছে । ফলে অযোগ্য সে শিক্ষক ছাত্রদের মন-মানসিকতা, স্বদেশপ্রেম কিংবা মনুষ্যত্ব বিকাশের বীজ বপনে বরাবরই ব্যর্থ হচ্ছে । আর এ প্রভাব পড়ছে সমস্ত ছাত্রসমাজে।

সম্মানিত সুধীমণ্ডলী
এত কিছুর পরেও আমাদের ছাত্রসমাজের কিছু ভূমিকায় আশ্বস্ত হই; না এখনও সমূলে বিনষ্ট হয়নি বরং গৌরবে আবারও মাথা উঁচু হয় । সম্প্রতি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা শিক্ষার ওপর ভ্যাটের' বিরুদ্ধে যে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তাদের ন্যায়সংগত দাবি আদায় করেছে— তা ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

প্রিয় সুধীমণ্ডলী
এত বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও ছাত্রসমাজের কিছু অংশ নানাবিধ উন্নয়নমূলক কার্যক্রমে সরাসরি যুক্ত । ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ, নিরক্ষরদের শিক্ষা, পথশিশু শিক্ষা, রক্তদান কর্মসূচি, দুস্থদের পুনর্বাসনসহ নানা উদ্যোগে আমরা যেন সম্বিত ফিরে পাই । কখনো বাংলাদেশি ছাত্রসমাজের গণিত অলিম্পিয়াডে সফলতা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে সফলতায় আবার আমরা আশায় বুক বাঁধি। 

সুপ্রিয় সুধী
নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও আমাদের ছাত্রসমাজ যখন বিএনসিসি-তে কিংবা রোভার স্কাউটে দেশ-দেশান্তরে সুনাম অর্জন করে চলছে তখন কতিপয় ছাত্রনামধারী সন্ত্রাসীদের সমস্ত আস্ফালনে তা ঢাকা পড়ে। অন্যদিকে, প্রকৃত ছাত্র সম্প্রদায়ের বিজয়গাথাকে অভিনন্দন জানিয়ে কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে কণ্ঠ মিলে যায় এভাবেই—
ভেঙেছ দুয়ার এসেছ জ্যোতির্ময়
তোমারি হউক জয় ।
আপনাদের সকলকে আবারও আমার আন্তরিক ভালোবাসা জানিয়ে শেষ করছি ।
Next Post Previous Post