সন্ত্রাসমুক্ত সমাজ ও বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি ভাষণ তৈরি কর

'সন্ত্রাসমুক্ত সমাজ ও বাংলাদেশ' সম্পর্কে একটি ভাষণ তৈরি কর।

'সন্ত্রাসমুক্ত সমাজ ও বাংলাদেশ' সম্পর্কে একটি ভাষণ তৈরি কর ।

সম্মানিত সভাপতি, বিজ্ঞ আলোচকবৃন্দ ও সুধীমণ্ডলী— এই পড়ন্ত বিকেলে আপনাদের প্রতি রইল আমার প্রাণঢালা ভালোবাসা । সুজলা, সুফলা, শস্য-শ্যামলা এই বাংলাদেশ । এর সমৃদ্ধি-ঐতিহ্য লোকমুখে কিংবদন্তি ছড়াত— 'গোয়াল ভরা গরু আর পুকুর ভরা মাছ' অন্যদিকে অনেকে এদেশের মানুষকে লক্ষ করে বলত- 'গোলাভরা ধান আর গলায় গলায় গান' । এই তো আবহমান কালের বাংলাদেশ। অথচ সন্ত্রাসের কালিমা আমাদের সমস্ত অর্জনকে ম্লান করে দেয়, জাতি হিসেবে হীন করে। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিষবাষ্প ছড়ায় । সুতরাং এই জঘন্য অপবাদ থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করতেই হবে।

সুপ্রিয় সুধী
আজকের এই আলোচনা নানাবিধ কারণে গুরুত্ব বহন করে । বিশেষত বাংলাদেশে সন্ত্রাস এখন আর লুক্কায়িত কোনো বিষয় নয় । বরং জাতির সমস্ত উন্নয়ন ও অগ্রগতির অন্যতম অন্তরায় হিসেবে গণ্য হচ্ছে ।

সম্মানিত সুধীমণ্ডলী
আজ আমাদের ঘুম ভাঙে পাখির কলকাকলিতে নয়, গুলির শব্দে । দিনের শুরু হয় চায়ের কাপে চুমুকে আর খবরের কাগজে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের সংবাদ দিয়ে । উদীচীর অনুষ্ঠানে বোমা হামলা, রমনার বটমূলে বোমা, একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলা- আমরা এগুলো শুধু রাজনীতিক বিচারে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলেই উড়িয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু যখন বাংলা ভাইয়ের জন্ম হয়, তথাকথিত ধর্মের দোহাই দিয়ে মানুষকে গাছের সঙ্গে বেঁধে নির্যাতন চালায়, কখনও কখনও হাত-পায়ের রগ কাটে, কলেজ- বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন খুনের মহড়া চলে, অগণিত শিশু-কিশোরী আর নারী ধর্ষিত হয় এবং নিহত হয়; ব্রিটিশ কূটনীতিকের ওপর চলে বোমা হামলা, একযোগে ৬৩টি জেলায় একই সঙ্গে বোমা বিস্ফোরণ, মুক্তিপণের দাবিতে অপহরণ-অবশেষে হত্যা, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হত্যা, এমপি-মন্ত্রী হত্যা, নারায়ণগঞ্জে সাত খুন, মুক্তমনা বুদ্ধিজীবী খুন, ব্লগার খুন, বিচারক খুন, অতর্কিত জঙ্গি হামলা, পেট্রোল বোমায় দগ্ধ অগণিত নারী ও শিশু – এসবই আমাদের সন্ত্রাসের সামান্য পরিসংখ্যান মাত্র । এছাড়াও নীরবে-নিভৃতে সন্ত্রাসের রাজত্ব আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রকে কতটা পঙ্গু করছে তা সহজেই অনুমেয় ।

প্রিয় সুধীমণ্ডলী
বিশ্বে বাংলাদেশের সন্ত্রাস এখন একটি আলোচিত বিষয় । সম্প্রতি উদ্বেগজনকভাবে ব্লগার হত্যা বাংলাদেশের ভাবমূর্তি পাল্টে দিতে চাচ্ছে । আমরা পত্র-পত্রিকায় এ হত্যার পিছনে কখনও আইএস, আলকায়দা, জেএমবি, হুজি, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, হিজবুত তাহরির কিংবা অন্য কোনো জঙ্গী সংগঠনের নাম পাই । এ থেকে অনুমিত হচ্ছে হয়ত আন্তর্জাতিক কোনো জঙ্গী সংগঠন এরূপ হত্যাকাণ্ডের পিছনে মদদ জোগাতে পারে। এছাড়াও বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানও সন্ত্রাসীদের জন্য নিরাপদ হিসেবে বিবেচিত হয় । এর দক্ষিণ-পূর্বে বিস্তীর্ণ সাগর এবং অতি সহজ-সরল মানুষের আতিথেয়তাও সন্ত্রাসীদের জন্য সহায়ক ।

সম্মানিত সুধী
একথা আর হয়তো নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না যে, আমাদের দেশের অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসের মূলে রয়েছে রাজনীতিক দলের সীমাহীন বাড়াবাড়ি, মারামারি এবং খুনখারাবি । এখানে রাজনীতি চর্চার চেয়ে পেশিশক্তিই প্রাধান্য পায় । ফলে সংঘাত অনিবার্য । আবার রাজনীতিক নেতারা নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখার প্রয়োজনে অর্থ-বিত্ত দিয়ে যে গুন্ডাবাহিনী পোষে- তারাই মাঝে মধ্যে রক্তের হোলিখেলায় মেতে ওঠে । অন্যদিকে, কর্মসংস্থানের অপ্রতুলতা এবং আর্থনীতিক ব্যাপক বৈষম্য সমাজে নতুন করে সন্ত্রাসের জন্ম দেয় । জনসংখ্যার মাত্রাতিরিক্ত চাপ নিয়ন্ত্রণ করতে সরকার যখন ব্যর্থ, তখন সেখানে নতুন করে সন্ত্রাসীর জন্ম নেওয়া তো স্বাভাবিক ।

প্রিয় সুধী
আমাদের অমিত তেজদীপ্ত যুবসমাজের অধিকাংশই তথাকথিত অপরাজানীতির শিকার হয়ে মাস্তান, চোরাকারবারি, মাদক পাচারকারীসহ নানা ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত ।

সম্মানিত সুধী
অধিকাংশ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের পেছনে আমাদের কিছু অসৎ সরকারি কর্মকর্তার হাত রয়েছে, যারা সন্ত্রাসীদের কাছ থেকে মাসোহারা পেয়ে থাকে । এছাড়া সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে যথোপযুক্ত আইনের প্রয়োগ এখনও নিশ্চিত হয়নি; বরং পুলিশের চার্জশিট লেখায় দুর্বলতা, ঘুষের কারবার, বিচারে দীর্ঘসূত্রিতা, ক্ষেত্রবিশেষে বিচারহীনতার সংস্কৃতি সন্ত্রাসীকে এ হীনকাজে উদ্বুদ্ধ করে ।

প্রিয় সুধী
সন্ত্রাসী নির্মূ ণর উদ্দেশ্যে র‍্যাব কর্তৃক ক্রসফায়ার— যা সুশীল সমাজ কখনোই গ্রহণ করতে পারছে না বরং এ ধরনের বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড প্রকারান্তরে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের অপর নাম ।

উপস্থিত সুধী
সন্ত্রাসের এই রাহুগ্রাস থেকে আমাদের বাঁচতে হবে । বাঙালি শান্তিপ্রিয় জাতি; অথচ সন্ত্রাস যেভাবে অক্টোপাসের মতো ঘিরে রেখেছে— সেখানে থেকে বের হতেই হবে । এজন্য আমাদের প্রথমত একটি রাজনীতিক ঐকমত্য দরকার; সামাজিক সচেতনতা দরকার । আমাদের পাঠ্যসূচিতে সন্ত্রাসের কারণ ও প্রতিকার বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করা দরকার । সন্ত্রাসীদের শাস্তি কিংবা দণ্ড দিয়ে নয় বরং তাদের সংশোধনের সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে হবে ।

সম্মানিত সুধীমণ্ডলী
বাঙালি বীরের জাতি— সন্ত্রাসী নয় । বাঙালির হাজার বছরের সংস্কৃতিতে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে শান্তির পতাকা উত্তোলিত হয়েছে আজও হবে ।

প্রিয় সুধী
প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্রের উদ্ধৃতি দিয়ে শেষ করতে চাই— ‘পাপকে ঘৃণা কর পাপীকে নয়।' সন্ত্রাসীরা অন্য কেউ নয় বরং আমাদের বাংলা মায়ের সন্তান । আসুন তাদের সংশোধন করে সোনার বাংলা গড়ি। আপনাদের ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে এখানেই শেষ করছি।
Next Post Previous Post