ভাষণ, ভাষণের প্রয়োজনীয়তা, একটি উৎকৃষ্টতা ভাষণ লেখার নিয়ম

ভাষণ

ভাষণ

বাকশিল্পের একটি অন্যতম বিষয় হলো ভাষণ । বহুবিধ প্রয়োজনে, নানা আয়োজনে, সভা-সমিতিতে বা কোনো আলোচনায় বক্তব্য প্রদান করতে হয় । বক্তার বক্তব্যকে ভাষণ হিসেবে অভিহিত করা হয় । ভাষণে আলোচ্য বিষয় সম্বন্ধে বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা ও মতামত উপস্থাপিত হয় এবং উপস্থাপনের ভাষা অবশ্যই মাধুর্যময় ও সাবলীল হতে হয় । সুতরাং ভাষণেও একটি চমৎকার শিল্প-নৈপুণ্য পাওয়া যায় । সাধারণত ভাষণকে বক্তৃতা, অভিভাষণ, প্রতিভাষণ, বিবৃতি প্রভৃতি নামে আখ্যায়িত করা যায় । তবে ‘বক্তৃতা' ও ‘ভাষণ' শব্দ দুটি সর্বাধিক প্রচলিত ।

প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ বক্তৃতা কিংবা ভাষণকে গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করে এসেছে । ফলে প্রাচীন গ্রিস ও রোমে বাগ্মিতার চর্চা করা হতো । মনীষী সক্রেটিস, ডিমস্থিনিমাসহ আরও অনেকে বাগ্মিতার জন্য বিশ্বে মর্যাদার সঙ্গে স্মরণীয় হয়ে আছেন । অ্যাডমন্ড বার্ক তার অসাধারণ বক্তৃতায় ব্রিটিশ পার্লামেন্টকে অভিভূত করে ফেলতেন । স্বামী বিবেকানন্দ বিশ্ব-ধর্ম মহাসম্মেলনে যে ভাষণ প্রদান করেছেন তার জন্য তিনি আজও খ্যাত । আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগান শুধু অসাধারণ বাগ্মিতায় পৃথিবীর সকলের কাছে পরিচিতি লাভ করেছিলেন । বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী অসাধারণ বক্তা হিসেবে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন ।

ভাষণের প্রয়োজনীয়তা

একটি বিষয়কে শ্রোতা-দর্শকের কাছে বোধগম্য ও গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্য ভাষণের গুরুত্ব যথেষ্ট। সাধারণ কোনো বিষয়, কোনো ব্যবস্থা, কোনো পদক্ষেপের সমর্থন আদায়ে ভাষণ কার্যকর ভূমিকা রাখে । অর্থাৎ একটি বলিষ্ঠ জনমত গঠনে ভাষণের গুরুত্ব অনস্বীকার্য । তাই রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ স্তর থেকে একজন হকার পর্যন্ত ভাষণ প্রদান করে ।

ভাষণের উপাদান

ভাষণের প্রধান উপাদান তিনটি । যথা : 

১. বক্তা 
২. শ্রোতা/দর্শক 
৩. আলোচ্য বিষয় ।

ভাষণে বক্তা গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ । ভাষণের মূল উদ্দেশ্যকে বক্তা দর্শক-শ্রোতার কাছে এমনভাবে উপস্থাপন করবে, যাতে বিষয়ের মর্মার্থ সহজেই অনুধাবন করা যায়। তবে বক্তাকে যুক্তিসহকারে এবং হৃদয়গ্রাহী ভাষায় বক্তব্য উপস্থাপন করতে হবে । ভাষণে শ্রোতা/দর্শকের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম । কেননা যাদের উদ্দেশে বক্তব্য নিবেদিত হবে তাদের উপস্থিতি একান্ত দরকার । অন্যদিকে, আলোচ্য বিষয় সম্বন্ধে বক্তার স্পষ্ট ধারণা থাকা বাঞ্ছনীয় ।

ভাষণের শ্রেণিবিভাগ

সাধারণত ভাষণকে কোনো সুনির্দিষ্ট ছকে শ্রেণিভুক্ত করা যায় না । তবে বিষয়বস্তুর দিক থেকে ভাষণ বিভিন্ন প্রকারের হতে পারে । স্থান-কাল এক্ষেত্রে বিবেচনায় আসতে পারে । তাই গ্রাম-গঞ্জে, হাট-বাজারে, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে, বেতার-টেলিভিশনে কিংবা পত্র -পত্রিকায়ও ভাষণ উপস্থাপিত হতে পারে । ভাষণ প্রদানে দুই ধরনের রীতি অনুসৃত হয় । যেমন— 

১. মুখস্থ ভাষণ বা প্রস্তুতকৃত ভাষণ বা লিখিত ভাষণ ।
২. তাৎক্ষণিক ভাষণ বা অলিখিত ভাষণ ।

পূর্বপ্রস্তুতি নিয়ে বক্তা জনসম্মুখে লিখিত ভাষণ প্রদান করেন । পক্ষান্তরে, কোনো ধরনের পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়াই তাৎক্ষণিকভাবে দর্শক/শ্রোতার উদ্দেশে দেওয়া বক্তব্যকে তাৎক্ষণিক ভাষণ বলে । লিখিত ভাষণে বিষয়টি সম্বন্ধে সুনির্দিষ্ট ভাবনা এবং সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ তথ্য-উপাত্ত সরবরাহ করা যায় । অন্যদিকে, তাৎক্ষণিক ভাষণে প্রয়োজনীয় অনেক বিষয়ের উপস্থাপন নাও হতে পার । তাৎক্ষণিক ভাষণে অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ও মুখ্য হতে পারে, যার কারণে বক্তব্য দীর্ঘও হতে পারে । এতে করে দর্শক-শ্রোতার ধৈর্যচ্যুতি ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে । সুতরাং ভাষণ আকর্ষণীয় হওয়া একান্ত প্রয়োজন ।

ভাষণের উৎকৃষ্টতা

ভাষণের উৎকৃষ্টতার জন্য শিল্পসম্মতভাবে এর উপস্থাপন আবশ্যক । এক্ষেত্রে কিছু নিয়ম-নীতির প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই । তাই ভাষণ প্রদানের সময় কতিপয় বিষয়ের প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। যেমন-

১. বক্তার ভাষণের নির্দিষ্ট বিষয় সম্বন্ধে স্বচ্ছ ধারণা থাকতে হবে । বক্তব্য উপস্থাপনে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচনার যোগ্যতা অর্জন করতে হবে ।
২. বক্তব্যকে যুক্তিগ্রাহ্য এবং চিন্তা-চেতনাপ্রসূত হতে হবে । বক্তব্যে বস্তুনিষ্ঠ তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করতে হবে ।
৩. ভাষণে কোনো গল্প, কাহিনি কিংবা অভিজ্ঞতার বর্ণনাও থাকতে পারে; তবে তা প্রাসঙ্গিক হওয়া একান্ত প্রয়োজন।
৪. ভাষণে বক্তব্যের বিষয়কে আকর্ষণীয় করার জন্য বাচন ভঙ্গিতে নাটকীয়তা আনলে দর্শক/শ্রোতা আগ্রহ সহকারে গ্রহণ করবে।
৫. ভাষণে পরস্পরবিরোধী কোনো বক্তব্য প্রদান না করাই শ্রেয় ।
৬. অনেক ক্ষেত্রে বক্তা দর্শক/শ্রোতাকে আকৃষ্ট করার নিমিত্তে নানা উদাহরণ ও দৃষ্টান্ত ব্যবহার করে। এরূপ ক্ষেত্রে অবশ্যই লক্ষ রাখতে হবে যে, তাতে যেন নেতিবাচক কোনো প্রভাব না পড়ে ।
৭. ভাষণ প্রদানকালে অবশ্যই শ্রোতা/দর্শকের মানসিকতাকে মূল্যায়ন করতে হবে । এক্ষেত্রে খুব দীর্ঘ বক্তৃতা না রাখাই শ্রেয় । 
৮. ভাষণরত অবস্থায় নামাজ কিংবা আজানের সময় স্বেচ্ছায় বিরতি প্রদান করা উচিত ।
৯. লিখিত ভাষণ পাঠের ক্ষেত্রে শুধু কপিতে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলে তা অনেক সময় অসহিষ্ণুতার জন্ম দিতে পারে। তাই ভাষণ প্রদানকালে অবশ্যই উপস্থিত দর্শক/শ্রোতার সামনে মাথা উঁচু করে বিনয়ের সঙ্গে সম্বোধন করে পড়তে হবে ।
১০. ভাষণে অবশ্যই উপস্থিত সকলকে সম্বোধন করা উচিত ।
১১. ভাষণ প্রদানকালে ব্যক্তিগত আবেগের বহিঃপ্রকাশ না করাই শ্রেয় । কাউকে ছোটো করা কিংবা কাউকে বড়ো করে প্রশংসায় পঞ্চমুখ না হওয়াই ভালো ।
১২. ভাষণে যথাসম্ভব আঞ্চলিকতা কিংবা অন্যান্য মুদ্রাদোষ এড়িয়ে যাওয়া উত্তম ।
১৩. ভাষণে বক্তব্যকে দৃঢ়ভাবে উপস্থাপনের প্রয়োজনে কোনো মনীষীর উদ্ধৃতি ব্যবহৃত হতে পারে । তবে উদ্ধৃতিটি সার্বজনীন হওয়াই বাঞ্ছনীয় ।
১৪. ভাষণে প্রমিত উচ্চারণ ও আকর্ষণীয় বাচনভঙ্গি একান্ত প্ৰয়োজন ।
১৫. বক্তার পোশাক-পরিচ্ছদও ভাষণে প্রভাব ফেলতে পারে; তাই শ্রোতা/দর্শকের রুচি, ভাষণের বিষয়বস্তু উপযোগী পোশাক পরিধান করা উচিত ।
১৬. ভাষণ একটি শিল্প । তাই একটি সার্থক ভাষণ প্রদানে অবিরত চর্চার কোনো বিকল্প নেই । এর জন্য ভালো বক্তার ভাষণ শোনা, ভালো উপস্থাপনা, আবৃতি, নাটকসহ বিভিন্ন সভা-সেমিনার কিংবা আলোচনাসভায় অংশগ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ।

ভাষণের বিভিন্ন অংশ বা পর্যায়

একটি সার্থক ভাষণের চারটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ রয়েছে । যথা : 
১. সম্ভাষণ 
২. সূচনা বা প্রস্তাবনা 
৩. মূলবক্তব্য 
৪. উপসংহার । 

১. সম্ভাষণ : ভাষণে সম্ভাষণ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় । সাধারণত বক্তাকে মঞ্চে দাঁড়িয়ে কিংবা শ্রোতার উদ্দেশে উপস্থিত সকলকে মর্যাদা অনুযায়ী সম্ভাষণের পর্ব শেষ করেই বক্তব্যের সূচনায় আসতে হয় । সেজন্য ভাষণে সম্ভাষণ একটি আকর্ষণীয় বিষয়ও বটে । সম্ভাষণে প্রধান অতিথি, বিশেষ অতিথি, কোনো মান্যব্যক্তি, সভাপতিকে তাঁদের মর্যাদা অনুযায়ী সম্ভাষণ করা শ্রেয় । তবে উপস্থিত পরিবেশ, পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে সম্ভাষণকে আকর্ষণীয় করা যায়। যেমন— শ্রদ্ধেয় প্রধান অতিথি কিংবা মাননীয় প্রধান অতিথি, শ্রদ্ধাভাজন সভাপতি কিংবা সম্মানিত সভাপতি, মাননীয় বিশেষ অতিথি কিংবা শ্রদ্ধেয় বিশেষ অতিথি, শ্রদ্ধেয় অধ্যক্ষ কিংবা অধ্যক্ষ মহোদয়, শ্রদ্ধেয় শিক্ষকবৃন্দ কিংবা সম্মানিত শিক্ষকবৃন্দ, উপস্থিত সুধীমণ্ডলী কিংবা সমবেত সুধীবৃন্দ, প্রিয় ছাত্র-ছাত্রী ভাই ও বোনেরা, প্রিয় এলাকাবাসী, সহযোদ্ধা বন্ধুগণ কিংবা সংগ্রামী সাথি ও বন্ধুগণ কিংবা আমার প্রাণপ্রিয় সহযোদ্ধাগণ ইত্যাদি ।

অনেকের ধারণা প্রথমে সভার সভাপতিকে সম্ভাষণ করতে হবে তারপর প্রধান অতিথিসহ অন্যান্যদের। কিন্তু এটি কোনো ধরা- বাঁধা নিয়মের বিষয় নয় বরং শ্রদ্ধা ও আন্তরিকতার সঙ্গে সম্ভাষণই মূলকথা। সম্ভাষণ পর্ব শেষ হলেই ভাষণের সূচনা পর্বে প্রবেশ করতে হয়। অবশ্য ইদানীং ভাষণে প্রথম সূচনা পর্বে প্রবেশ করে সম্ভাষণ পর্বে আসা যায়। ফলে বাড়তি আকর্ষণ সৃষ্টি করা যায় । তবে বক্তার উপস্থাপনাই এখানে মূল বিষয় । অধিকাংশ ক্ষেত্রে সম্ভাষণের পর সূচনা বা প্রস্তাবনার বিষয়টি প্রাধান্য পায় ।

২. সূচনা বা প্রস্তাবনা : ভাষণে সূচনা বা প্রস্তাবনা পর্বটিও অধিক গুরুত্ব বহন করে। সাধারণত বক্তা তার মূলবক্তব্যে প্রবেশ করার আগেই এখানে বিষয়টি সম্বন্ধে স্বল্প পরিসরে উপস্থাপন করে। যার রেশ পরবর্তী সময়ে বক্তব্যে সঞ্চালিত হয়ে থাকে । তাই সূচনা পর্বটি অবশ্যই আকর্ষণীয় ও বস্তুনিষ্ঠ হওয়া বাঞ্ছনীয় । এরপর মূলবক্তব্যে প্রবেশ করতে হয় ।

৩. মূলবক্তব্য : ভাষণের প্রাণ হলো মূলবক্তব্য । সুতরাং মূলবক্তব্যটিকে যথাসাধ্য আকর্ষণীয় করতে হয় । চিন্তা-চেতনাপ্রসূত জ্ঞানের বিস্তার যেমন বক্তব্যকে গম্ভীর করে, তার পাশাপাশি সহজ-সরলভাবে এর উপস্থাপনও প্রয়োজন । সবচেয়ে বড়ো কথা হলো উপস্থিত দর্শক-শ্রোতার মন-মেজাজ, শিক্ষা-দীক্ষা ও রুচিবোধকে প্রাধান্য দিয়ে বক্তাকে তার মূল বিষয়ের অবতারণা করতে হয় । ভাষণে দর্শক/শ্রোতার মনোযোগকে ধরে রাখার প্রয়োজনে বক্তাকে অবশ্যই উপযোগী ভাষায় বক্তব্য উপস্থাপন করতে হয় । অবশ্য বক্তা দর্শক/শ্রোতার ক্লান্তি দূর করতে ভিন্ন প্রসঙ্গে মজাদার বিষয় মূলবক্তব্যে নিয়ে আসতে পারেন কিন্তু লক্ষ রাখতে হবে তা যেন বক্তব্যের মূল গতিধারাকে বিচ্ছিন্ন না করে । মূলবক্তব্যে এজন্য ধারাবাহিকতার প্রয়োজন রয়েছে । মূলবক্তব্যটি যথাসম্ভব গুছিয়ে বলতে হয় । তবে শুধু সাজিয়ে সাজিয়ে কঠিন বিষয়ের অবতারণা করলেই চলে না, বরং এর সঙ্গে আবেগের সংমিশ্রণও ঘটাতে হয় । বক্তব্যের মাঝে কোনো দর্শক কিংবা শ্রোতার কোনো ধরনের আচরণ বক্তব্যে কিছুটা বিঘ্ন ঘটালেও বিনয়ের সঙ্গে তা নিবৃত্ত করতে হবে ।

মূলবক্তব্যে কোনো মনীষীর উদ্ধৃতি অবশ্যই সঠিকভাবে ব্যবহার করা বাঞ্ছনীয় । কোনোভাবেই কোনো ভুল ব্যাখ্যা প্রদান করা উচিত নয় । এতে বক্তব্যের মান ক্ষুণ্ন হওয়ার আশঙ্কা থাকে । বর্তমান যান্ত্রিক সভ্যতার যুগে বক্তব্যের বিষয় যথাসম্ভব সংক্ষিপ্ত হওয়াই শ্রেয় এবং শ্রোতার ধৈর্যচ্যুতির আগেই বক্তব্যের সমাপ্তি টানা উচিত ।

৪. উপসংহার : ভাষণের সমাপ্তি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মূলবক্তব্যের সঙ্গে সংগতি রক্ষা করে ভাষণের সমাপ্তি টানতে হয় । এক্ষেত্রে শিল্পসম্মত পরিসমাপ্তি সকলেরই কাম্য ।

ভাষণের পরিসর

ভাষণের পরিসর কতটুকু হবে এটা সাধারণত ভাষণের বিষয়বস্তু, সভা-সমাবেশের প্রকৃতি এবং সময়ের ওপর নির্ভর করে । বেতার- টেলিভিশনসহ বিভিন্ন চ্যানেলে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই ভাষণের মূল বিষয়কে তুলে ধরতে হয় । অন্যদিকে সভা-সমাবেশে এবং সেমিনারে দীর্ঘক্ষণ ভাষণদানের সুযোগ রয়েছে । তবে পরীক্ষার খাতায় ভাষণের আকার-আয়তন সংশ্লিষ্ট প্রশ্নের নম্বর ও সময়ের প্রতি লক্ষ রেখেই তৈরি করতে হয় । স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে, এক্ষেত্রে যেন বক্তব্যটি প্রাঞ্জল ভাষায় উপস্থাপিত হয় ।

ভাষণের নমুনা :

আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস উপলক্ষ্যে আয়োজিত সভায় বক্তা হিসেবে একটি ভাষণ তৈরি কর ।

আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস - এ আয়োজিত আলোচনা সভার সম্মানিত সভাপতি, মাননীয় প্রধান অতিথি, মঞ্চে উপবিষ্ট সম্মানিত আলোচকবৃন্দ এবং উপস্থিত সুধীবৃন্দ, আপনাদের সবার প্রতি আমার আন্তরিক সালাম ও অভিনন্দন রইল । 

আমরা আজ এখানে সমবেত হয়েছি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনার অভিপ্রায়ে। বিশ্বে স্বীকৃত ৮ সেপ্টেম্বর, আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস । ১৯৬৫ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কো এ দিনটিকে আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে । এরপর ১৯৬৬ সালে বিশ্বব্যাপী এ দিবস পালিত হয়। এখনও দিবসটি গুরুত্বের সহিত পালনের প্রয়োজনীয়তা বিদ্যমান। কেননা মানুষের মৌলিক অধিকারের মধ্যে শিক্ষা অন্যতম । কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের সঙ্গে আপনাদের জানাতে হয়, আজও পৃথিবীর বহু মানুষ শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত । তাই অক্ষরজ্ঞান শূন্য মানুষের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে । অবশ্য একথা অনেকের বিশ্বাস হওয়ার কথাও নয় । প্রিয় সুধীবৃন্দ, আপনাদের যদি ধৈর্যচ্যুতি না ঘটে, তাহলে এ বিষয়ে একটু পরিষ্কার ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করব । শুধু কলম বা পেন্সিল দিয়ে নিজের নামটুকু কোনোরকমে লিখতে পারাটাই একসময় আমরা সাক্ষরতা ভাবতাম । কিন্তু বর্তমানে বিষয়টি সম্পূর্ণ পরিবর্তিত হয়েছে, যেখানে শুধু অক্ষরজ্ঞান নয়, তার সঙ্গে যোগাযোগের দক্ষতা, ক্ষমতায়নের দক্ষতা, জীবন নির্বাহের দক্ষতা, প্রতিরক্ষার দক্ষতা এবং সাংগঠনিক দক্ষতাও সাক্ষরতার অন্তর্ভুক্ত বিষয় । সুতরাং সাক্ষরতা একটি ব্যাপক বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছে ।

সম্মানিত সুধীমণ্ডলী
আজকের আলোচনার প্রতিপাদ্য বিষয় হিসেবে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অন্যান্য দেশগুলোর সাক্ষরতার চিত্রটি আমি সংক্ষেপে উপস্থাপন করছি। বাংলাদেশ সরকারের আর্থনীতিক সমীক্ষা ২০১৫-এ প্রদত্ত বর্তমান সাক্ষরতার হার ৬২.৩ ভাগ। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত ও পাকিস্তানে যথাক্রমে ৬১.০০ ও ৪৯.০০ ভাগ। বর্তমানে বহুদেশের সাক্ষরতার হার শতভাগ। এ থেকে আমরা কোথায় আছি— সে বিষয়টি সহজেই অনুমান করা যায় ।

প্রিয় সুধীবৃন্দ
আপনারা হয়তো জানেন, ২০০০ সালের এপ্রিলে সেনেগালের রাজধানী ডাকারে অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনে বিশ্বের প্রায় ১৬৪টি দেশের সরকার প্রধানের উপস্থিতিতে বিশ্বে ২০১৫ সালের মধ্যে সবার জন্য শিক্ষা বাস্তবায়ন' অঙ্গীকার করা হয়, তা আজও পূর্ণতা পায়নি। অন্যদিকে বাংলাদেশের চিত্র মোটেই সন্তোষজনক নয়, বরং আজও মাঠে-ঘাটে, খেতে-খামারে, শহরে-বন্দরে শিশু শ্রমিকের যে ভিড় লক্ষ করা যায় তাতে লজ্জায় মুখ ঢাকতে হয় । সম্মানিত সুধীমণ্ডলী, আপনাদের এ বিষয়ে আমার একটা বাস্তব অভিজ্ঞতার কথা বলি। কোনো একটা সংস্থার আলোচনা সভায় একটি গ্রামে প্রায় পঞ্চাশ জন মানুষের স্বাক্ষর সংগ্রহ করতে গিয়ে দেখতে পেলাম প্রায় ৩০/৩৫ জন লোকের টিপসই। জিজ্ঞাসা করেছিলাম এখানে গণশিক্ষা, বয়স্ক শিক্ষার বা এ ধরনের কোনো কার্যক্রম আছে কি না? উত্তর পেয়েছিলাম 'না'। আজও যেখানে স্বাক্ষর গ্রহণের সুযোগ নেই যেখানে সাক্ষরতা চাওয়া তো আকাশকুসুম কল্পনারই নামান্তর ।

প্রিয় সুধীবৃন্দ
তারপরও সরকার সাক্ষরতার অভিযানে প্রশংসনীয় ভূমিকা রাখছে । শিক্ষাক্ষেত্রে সর্বোচ্চ বরাদ্দ, বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা, বয়স্ক শিক্ষা কার্যক্রম, গণশিক্ষা কার্যক্রম, মসজিদ শিক্ষা, মন্দির শিক্ষা, মেয়েদের অবৈতনিক শিক্ষা, উপবৃত্তিসহ বহুবিধ উদ্যোগ সাক্ষরতার ক্ষেত্রে অবশ্যই ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে । এছাড়াও বিভিন্ন ধরনের বেসরকারি সংস্থা, সংগঠন যথেষ্ট প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। কিন্তু তারপরেও সাক্ষরতার ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থান মোটেই আশাপ্রদ নয় । অথচ যেকোনো জাতির উন্নয়নে সাক্ষরতাই প্রধান অবলম্বন । সুতরাং শুধু সরকার বা সংগঠন কিংবা সংস্থার ওপর এ গুরুভার ছেড়ে দিয়ে হাফ বাঁচার কোনো উপায় নেই। বরং সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণে সর্বস্তরের মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। সাক্ষরতা দিবসে এই হোক আমাদের অঙ্গীকার ।

আজকে এ ধরনের একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা সভায় আমাকে বক্তব্য রাখার সুযোগ দানের জন্য আয়োজকসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে ধন্যবাদ জানিয়ে এখানেই শেষ করছি । জয় হোক সাক্ষরতা দিবসের, মঙ্গল হোক সকলের ।
Next Post Previous Post