যৌতুক প্রথার বিরুদ্ধে একটি ভাষণ রচনা কর

'যৌতুকের অভিশাপ' বিষয়ে একটি ভাষণ রচনা কর

যৌতুকের অভিশাপ বিষয়ে একটি ভাষণ রচনা কর।
অথবা, যৌতুক প্রথার বিরুদ্ধে একটি ভাষণ রচনা কর।

শিশু উন্নয়ন সংস্থা (শিউস) কর্তৃক আয়োজিত এ আলোচনা সভার সম্মানিত সভাপতি, মাননীয় প্রধান অতিথি এবং উপস্থিত সুধীবৃন্দ আপনাদের প্রথমেই ধন্যবাদ জানাচ্ছি যে, এ ধরনের একটি যুগোপযোগী বিষয়ে আমাকে কিছু বলার সুযোগ দানের জন্য ।

নারীর প্রতি প্রচণ্ড অবমাননার এক অভিশপ্ত নাম যৌতুক প্রথা। কবে কখন এটি প্রথা হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে সে ইতিহাস আমাদের জানা নেই; তবে প্রতিনিয়ত যৌতুকের বলি হচ্ছে অসংখ্য নারী; এ চিত্র আজ আমাদের সমস্ত মানবতাকে ভূলুণ্ঠিত করে সেই মধ্যযুগীয় বর্বর ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করছে ।

সম্মানিত সুধী
এক সময় ভারতীয় উমহাদেশে পণ প্রথা প্রচলিত ছিল; আর বিয়ের ক্ষেত্রে নারীকে পণ দিয়েই গৃহে নিয়ে আসা হতো। এ ঐতিহ্যের অনেক প্রমাণ ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং সে সময়কার লোকসংগীত ও কাহিনিতে পাওয়া যায়। কিন্তু সভ্যতার ক্রমবিকাশের পথ পরিক্রমায় কখন ‘যৌতুক প্রথা' এক বিষ ফোঁড়া হয়ে দেখা দিল তার হদিস মোটেই পরিষ্কার নয় ।

প্রিয় সুধী
সম্ভবত নারীর প্রতি হীন মানসিকতা আর বৈষয়িক নির্লজ্জ চাওয়া-পাওয়া থেকেই প্রথাটি সকলের অগোচরে আজ বিরাট বিষবৃক্ষে পরিণত হয়েছে । তাই তো শিক্ষিত কী অশিক্ষিত, ভদ্র-অভদ্র সকল সমাজেই এখন এ এক উল্লেখযোগ্য বিষয়ে পরিণত হয়েছে। বিয়ের মতো পবিত্র ও মহৎ কার্যে প্রথমেই দর কষাকষি চলে । টাকার অঙ্কে যেন সম্পর্কটি গড়ে ওঠে । মনে হয় দাস প্রথারই নবতর সংস্করণ ।

সম্মানিত সুধীমণ্ডলী
যৌতুক প্রথার শিকড় অনেক দূর প্রোথিত বলেই আমাদের সাহিত্যিক, সাংবাদিক, লেখক ও গবেষকদের লেখার উপজীব্য হিসেবেই ক্ষেত্রবিশেষে দেখা যায়। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কিংবা কবি কাজী নজরুল ইসলামসহ অনেক লেখক-রচয়িতার কলমে যথেষ্ট গুরুত্ব পেলেও যৌতুক প্রথার বিরুদ্ধে কখনোই সোচ্চার কোনো প্রতিরোধ গড়ে ওঠেনি। এমন কী আজ পর্যন্তও নয় । তাহলে আমরা যে এত গলা উঁচিয়ে মানুষের অধিকারের কথা, নারীর ক্ষমতায়নের কথা বলছি এগুলো অন্তঃসার শূন্য মাকাল ছাড়া আর কিছু নয় ।

প্রিয় সুধী
আজও দরিদ্র পিতার কন্যা আলেয়া যৌতুকের দাবি না মিটাতে পেরে স্বামী কর্তৃক অমানুষিক নির্যাতনে শেষ পর্যন্ত ফাঁসিতে ঝুলে আত্মহত্যা করে; তখন কী করে আমরা সভ্য সমাজের লোক হিসেবে নিজেদের পরিচয় দেই? যৌতুকের শিকার হয়ে রোকেয়া যখন গৃহ ছাড়ে, তিনদিন পর ফিরে আসলে দুশ্চরিত্রা হিসেবে সমাজে তারই বিচার হয় এবং শেষ পর্যন্ত তালাকপ্রাপ্ত হয়ে তাকে সহ্য করতে হয় অমানুষিক জীবন-যন্ত্রণা । বাবা-মা হারা রোকেয়ার জায়গা ভাইদের বাড়িতে হয় না; শেষ পর্যন্ত কোনো নিষিদ্ধ পল্লিতে তাকে আশ্রয় খুঁজতে হয়— অন্তত এখান থেকে কেউ তাকে বের করে দেবে না; তবুও মাঝে মধ্যে প্রশাসনের কিছু অসৎ কর্মকর্তার দাবিও তাকে মেটাতে হয় ৷

সম্মানিত সুধীবৃন্দ
পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় আজ যৌতুক সিদ্ধ হয়েছে; বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চ ডিগ্রিধারী কিংবা বিসিএস অফিসার, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার আজ পাত্রের তালিকায় অনেক দামের । শিক্ষা-সংস্কৃতিকে বিসর্জন দিয়ে বেহায়ার মতো দেদারসে চলছে যৌতুকের কারবার । আমাদের দীনতা কতদূর পর্যন্ত পৌঁছেছে এর চেয়ে বড়ো প্রমাণ আর কী হতে পারে ।

প্রিয় সুধীজন
আপনারা হয়তো বলবেন এ ব্যাপারে সরকারের অনেক নিয়ম-নীতি, আইন-কানুন আছে । কিন্তু এ নিয়মের সঠিক বাস্তবায়ন আজও ঘটেনি; বরং নিয়মের যারা প্রণয়ন করেন তারাই যদি নিয়মভাঙার খেলায় মেতে ওঠেন তখনই আর করার কিছু থাকে না । এজন্যই হয়তো কার্ল মার্কস বলেছিলেন, ‘রাষ্ট্রযন্ত্রের সকল কিছুই জনগণের স্বার্থে নয় বরং রাষ্ট্রচালকদের স্বার্থে ।’ 

সম্মানিত সুধীমণ্ডলী
এ অরাজকতা যত দিন যাচ্ছে শাখা-প্রশাখায় এর বিস্তৃতি ব্যাপকভাবে বেড়ে চলছে । অবশ্য এক্ষেত্রে আজকের এ শিশু উন্নয়ন সংস্থা (শিউস)'র কথা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতে হয়। তারা বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে এবং যৌতুক প্রথার বিরুদ্ধে ইতোমধ্যেই এলাকায় একটা জনমত গড়ে তুলতে পেরেছে । এজন্য সংস্থাটির সংশ্লিষ্ট সকলকে আবারও আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি । এছাড়াও দেশের বিভিন্ন নারী সংগঠন ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা, সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় যৌতুকের অভিশাপ থেকে নারীসমাজকে রক্ষার জন্য নানা ধরনের উঠোন বৈঠক, সভা-সমিতি, আলোচনা-সভা, সেমিনার-সিম্পোজিয়ামের আয়োজন করেই চলছে। এর সঙ্গে বর্তমানকালের বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াকে এক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে হবে । কেননা বিভিন্ন কেস স্টাডি থেকে উপলব্ধি করা যায় যে, শুধু আইন কিংবা দণ্ড বা শাস্তি নয় বরং জনসচেতনতা সবচেয়ে বড়ো সমাধান হতে পারে ।

সম্মানিত ভদ্রমহিলাগণ
বিনয়ের সঙ্গে আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি— অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে, যৌতুকের দাবিতে পুত্রবধূকে সবচেয়ে বেশি নির্যাতন করে তার শাশুড়ি; অথচ তিনি নিজেও একজন নারী । নারীর প্রতি নারীর নির্যাতনও বন্ধ করা অত্যন্ত জরুরি।

প্রিয় সুধীমণ্ডলী
যৌতুকের অভিশাপ থেকে মুক্ত হতে হবে; নারীর প্রতি সর্বপ্রকার নির্যাতন বন্ধ করতে হবে । কৃতজ্ঞচিত্তে নারীর অবদানকেও স্বীকার করতে হবে। তাই তো কবি নজরুল ইসলাম যথার্থই উচ্চারণ করেছেন—

জগতের যত বড় বড় জয় বড় বড় অভিযান,
মাতা, ভগ্নী ও বধূদের ত্যাগে হইয়াছে মহীয়ান ।

আসুন নারীর প্রতি সকল বৈষম্য, অত্যাচার আর বিভেদের জাল ছিন্ন করে এক শান্তিময় বিশ্ব বিনির্মাণ করি । সকলকে আন্তরিক শুভেচ্ছা জানিয়ে আমার বক্তব্য এখানেই শেষ করছি। ধন্যবাদ ।
Next Post Previous Post