বাংলা রচনা : আমার প্রিয় কবি

আমার প্রিয় কবি

আমার প্রিয় কবি 

ভূমিকা : যাঁর কবিতা আমাকে অভিভূত করে, যাঁর কবিতা পড়ে আমি আপুত হই, তিনি কাজী নজরুল ইসলাম। বাংলা সাহিত্যে ধূমকেতুর মতাে তাঁর আবির্ভাব। অন্যায়-অবিচার, জুলুম ও শােষণের বিরুদ্ধে তাঁর কবিতায় ধ্বনিত হয়েছে প্রচণ্ড বিদ্রোহ। তিনিই শুনিয়ে ছিলেন সগ্রাম ও বিপ্লবের কথা। জাতিকে দেখিয়ে ছিলেন স্বাধীনতার স্বপ্ন। এই বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামই আমার প্রিয় কবি। এ কবির সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ঘটে কৈশােরে পড়া একটি কবিতার মাধ্যমেㅡ

‘আমি হব সকাল বেলার পাখি
সবার আগে কুসুম বাগে উঠব আমি ডাকি।’

কেন প্রিয় কবি : ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হবার পর দেখলাম, আমাদের স্কুলে রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তী পালিত হচ্ছে। সেই অনুষ্ঠানে এক আবৃত্তিকারের উচ্চারণে তাঁর ‘বিদ্রোহী’ কবিতার আবৃত্তি শুনে আমি মুগ্ধ, অভিভূত। বিদ্রোহী' কবিতার সব কথা তখন বুঝিনি। কিন্তু যে কথাগুলাে তখন বুঝেছিলাম তার সবগুলাে কথাই যেন আমার মনের কথা। কিছু বুঝে কিছু না-বুঝে এর প্রতিটি শব্দ এবং পঙুক্তির সাথে সেদিন আমি যেন একাত্ম হয়ে গিয়েছিলাম। 

গ্রীষ্মের ছুটিতে মামার বাড়ি বেড়াতে গিয়ে দেখলাম, আমার ছােটমামার সংগ্রহে নজরুল রচনাবলি’ রয়েছে। ছােটমামারও প্রিয় কবি নজরুল। ছােটমামা আমাকে নজরুলের জীবনের অনেক কথা শােনালেন। আবৃত্তি করে শােনালেন নজরুলের কবিতা। খুকু ও কাঠবিড়ালী’, ‘লিচু চোর’, ‘খােকার সাধ’, ‘কুলি ও মজুর', সাম্যবাদী' প্রভৃতি কবিতা। এভাবে আমার মনের মণিকোঠায় নজরুল হয়ে ওঠেন প্রিয় কবি। আরাে একটু বড় হয়ে আমি নজরুলের আরাে কবিতা ও গান শুনেছি। 'সংকল্প' কবিতায় তিনি লিখেছেন :

‘থাকব না ক বদ্ধ ঘরে 
দেখব এবার জগৎটাকে 
কেমন করে ঘুরছে মানুষ
যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে।’

এ যেন আমার কিশােরমনের কথা। আমারাে মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় এই সীমাবদ্ধ গণ্ডিটা থেকে বেরিয়ে জগৎটাকে ঘুরেফিরে একটু দেখি। তাই আমি নজরুলকেই প্রিয় কবির আসনে বসিয়ে, তাঁকে শ্রদ্ধা নিবেদন করি। নজরুল ঘুণেধরা সমাজটাকে ভেঙেচুরে নতুন সমাজ গড়ার কথা বলেছেন। নজরুল আমার কাছে তাই,

‘বাবরি দোলানাে মহান পুরুষ 
সৃষ্টি সুখের উল্লাসে কাঁপা,’

নজরুলের জীবনালেখ্য : কবি নজরুলের ব্যক্তিগত জীবন ছিল খুবই বৈচিত্র্যময়। তাঁর জন্ম ১৮৯৯ সালে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে। তাঁর পিতার নাম ছিল ফকির আহমদ এবং মাতার নাম জায়েদা খাতুন। গ্রামের মক্তবেই তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয়। বাল্যকাল থেকে নজরুল কিছুটা খেয়ালি, বেপরােয়া, দুরন্ত ছিলেন। লেখাপড়া বাদ দিয়ে একসময় যােগ দেন গ্রামের লেটোর দলে। মাসিক পাঁচ টাকা বেতনে আসানসােলের এক রুটির দোকানে কাজ করেন। আসানসােলের তৎকালীন পুলিশের দারােগা রফিজউদ্দিন বালক নজরুলের প্রতিভার পরিচয় পেয়ে ময়মনসিংহে এনে তাঁকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। তিন বছর পর নজরুল সেখান থেকে পালিয়ে যান। শিয়ারশােল স্কুলে দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। নজরুল পড়ালেখা অসমাপ্ত রেখে বাঙালি পল্টনে গিয়ে সৈনিকের খাতায় নাম লেখান। কর্মদক্ষতার গুণে অল্পদিনের মধ্যে তিনি হাবিলদার পদে উন্নীত হন। সৈনিক থাকা অবস্থায় করাচি থেকে তিনি কলকাতার পত্রিকায় লেখা পাঠাতেন। ১৯১৯ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে তিনি কলকাতায় ফিরে এসে পত্রিকা সম্পাদনা ও সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত হন। ইতােমধ্যে প্রকাশিত হয় তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘বিদ্রোহী’। এই কবিতাই নজরুলকে রাতারাতি খ্যাতির চূড়ায় পৌছে দেয়। তিনি হয়ে ওঠেন বিদ্রোহী কবি। তারপর একে একে প্রকাশিত হয় তাঁর অন্যান্য কাব্যগ্রন্থ, গীগ্রিন্থ, গল্পগ্রন্থ, উপন্যাস, নাটক ও প্রবন্ধগ্রন্থ। তাঁর উল্লেখযােগ্য কাব্যগ্রন্থ: ‘অগ্নিবীণা’, ‘বিষের বাঁশি, ‘সাম্যবাদী’, ‘দোলন চাঁপা’, ‘সিন্ধু হিন্দোল’, ‘সর্বহারা'। তিনি ছােটদের জন্যও অনেক লিখেছেন। ‘ঝিলিমিলি’, ‘আলেয়া’, ‘পুতুলের বিয়ে’ তার শিশুতােষ রচনা।

নজরুল ছিলেন ঔপনিবেশিক আমলের কবি। তাই ঔপনিবেশিক শাসন-শােষণের বিরুদ্ধে তিনি কবিতা লিখেছেন। তাঁর কবিতা বাজেয়াপ্ত হয়েছে। কবিতা লেখার অপরাধে তিনি জেলে গেছেন। তবু তিনি পিছপা হননি, সত্য-সুন্দর-ন্যায়ের কথা বলেছেন, জাতিকে শুনিয়েছেন মুক্তির গানㅡ

‘প্রার্থনা কর যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস
যেন লেখা হয় আমার রক্ত লেখায় তাদের সর্বনাশ।

নজরুল এভাবে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছেন। হিন্দু-মুসলমানের ঐক্যের মাধ্যমে তিনি সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তােলেন। শােষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সদা সােচ্চার। জাতিকে দেখান তিনি স্বাধীনতার স্বপ্ন। ১৯৪২ সালে নজরুল হঠাৎ এক দুরারােগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে নির্বাক হয়ে পড়েন। তারপর দীর্ঘ তেত্রিশ বছর নজরুল নির্বাকই ছিলেন। ১৯৭৬ সালে ঢাকায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদের পাশে তাকে সমাহিত করা হয়।

উপসংহার : নজরুল সাম্যের কবি, সুন্দরের কবি। মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরি, আর হাতে রণতূর্য’– এ কেবল নজরুলের পক্ষেই বলা সম্ভব। কারণ, তিনি নিপীড়িত-লাঞ্ছিত মানুষের কথা ভেবেছেন।রাধীন জাতির মুক্তির কথা বলেছেন। উপমহাদেশের ইতিহাসে একমাত্র নজরুলই কবিতা লেখার অপরাধে জেল খেটেছেন। নজরুল ছিলেন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা। তাই বাংলাদেশ সরকার তাঁকে দিয়েছে আমাদের জাতীয় কবির মর্যাদা। মহান এই কবিই আমার প্রিয় কবি

Next Post Previous Post