বাংলা রচনা : বাংলাদেশের পাট শিল্প

বাংলাদেশের সোনালি আঁশ পাট

বাংলাদেশের সোনালি আঁশ পাট

বাংলাদেশের সোনালি আঁশ : পাট
অথবা, বাংলাদেশের পাট শিল্প


[ সংকেত : ভূমিকা; আকৃতি, প্রকৃতি ও প্রকার; উৎপত্তি স্থান; পাট চাষের পদ্ধতি; পাটের নানাবিধ ব্যবহার; বাংলাদেশের অর্থনীতিতে পাটের স্থান; পাটশিল্প ও পাটজাত দ্রব্যের রপ্তানি; বর্তমান অবস্থা; উপসংহার । ]

ভূমিকা : কৃষিপ্রধান দেশ হিসেবে বাংলাদেশের পরিচিতি সমগ্র পৃথিবীব্যাপী । বাংলাদেশের অন্যতম কৃষিজাত অর্থকরী ফসল পাট । একে ‘স্বর্ণসূত্র’ বা ‘সােনালি আঁশ বলা হয়। অর্থকরী ফসল পাট বাংলাদেশকে বিশ্বের বুকে সুপরিচিত করেছে। স্বাধীনতা উত্তরকালে পৃথিবীর উৎপন্ন পাটের শতকরা ৮০ ভাগই বাংলাদেশে জন্মাত এবং এই পাট-সূত্র থেকে বিপুল অর্থ অর্জিত হতাে বলেই একে ‘স্বর্ণসূত্র’ বা সােনালি আঁশ বলা হতাে। বর্তমানে পাটের পরিপূরক অনেক দ্রব্য রয়েছে। ফলে পাটের চাহিদা কমে যাওয়াতে বাংলাদেশে পাট শিল্পের অবস্থা শােচনীয় আকার ধারণ করেছে। তাই পাট উৎপাদনে বাংলাদেশের কৃষক আগ্রহ হারাচ্ছে; তবু যে। পরিমাণে পাট বর্তমানে উৎপন্ন হয় তা রপ্তানি করে দেশে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়। আর তাতেই পাটের সােনালি আঁশের। সুখ্যাতি আজও কোনােরকমে টিকে আছে।

আকৃতি, প্রকৃতি ও প্রকার : পাট এক প্রকার তৃণ জাতীয় উদ্ভিদ। এ উদ্ভিদ সাধারণত চার থেকে সাত-আট হাত লম্বা এবং অর্ধ ইঞ্চি পরিমাণে মােটা হয় । ডালপালাহীন এ গাছ শুধু শীর্ষে এক গুচ্ছ পাতা নিয়ে সােজা হয়ে দাড়িয়ে থাকে। এ গাছের রং সবুজ বর্ণের। আবার অনেক সময় তা লাল বা খয়েরি রঙেরও হয়ে থাকে। পাট গাছের ছালকেই পাট বলা হয়। পাট গাছের রং সবুজ হলেও প্রক্রিয়াকৃত পাটের আঁশের রং সাদা ও লালচে হয়ে থাকে। আমাদের দেশে সুতি, বগি ও মেস্তা— এ তিন শ্রেণির পাট উৎপন্ন হয়। সুতি পাটের আঁশ মােটা, এটি জলা ও নিম্ন জমিতে জন্মে। বগি পাটের আঁশ মসৃণ ও শক্ত, এটি উঁচু জমিতে জন্মে। মেস্তা পাটের আঁশ মসৃণ কিন্তু শক্ত নয়, এটিও উঁচু জমিতে ভালাে ফলে।

উৎপত্তি স্থান : বাংলাদেশ মৌসুমি বায়ু প্রবাহিত অঞ্চল। তাই এখানকার জলবায়ু নাতিশীতােষ্ণ। আর এ জলবায়ু পাট চাষের জন্য। খুবই উপযােগী। বাংলাদেশের প্রায় সব জেলাতেই কম-বেশি পাট উৎপন্ন হয়। তবে উৎকৃষ্টমানের পাট পাওয়া যায় ঢাকা, ময়মনসিংহ, জামালপুর, টাঙ্গাইল, কুমিল্লা প্রভৃতি জেলায়। বাংলাদেশ ছাড়া ভারতের আসাম, বিহার, উড়িষ্যা, মাদ্রাজে অল্প-বিস্তর পাটের চাষ হয় বটে, কিন্তু তার পরিমাণ খুবই সামান্য এবং মানেও নিকৃষ্ট। বর্তমানে আমেরিকা ও মিশরে কিছু কিছু পাট উৎপন্ন। হচ্ছে; যা প্রয়ােজনের তুলনায় খুবই সামান্য। বাংলাদেশের পাটের মতাে উৎকৃষ্টমানের পাট পৃথিবীর অন্য কোনাে দেশে জন্মে না। বাংলাদেশের ময়মনসিংহ, ঢাকা, কুমিল্লা, ফরিদপর পাবনা রংপুর ও রাজশাহী জেলায় অধিক পাট জন্মালেও সবচেয়ে উৎকৃষ্টমানের পাট জন্মে ময়মনাসংহ জেলায়। বাংলাদেশের প্রায় ৬০ লক্ষ বিঘা জমিতে পাট চাষ হয়ে থাকে। প্রতি বছর বাংলাদেশে প্রায় দুই লক্ষ কোটি মণ পাট উৎপন্ন হয়।


পাট চাষের পদ্ধতি : পাট চাষ খুবই কষ্টসাধ্য এবং ব্যয়সাপেক্ষ। সাধারণত বাংলাদেশে ফাল্লন ও চৈত্র মাসে জমিতে পাটের বাজ যশ ফা হয়। পাট চাষের উপযােগী জমিকে ভালােভাবে চাষ করতে হয়, যাতে সহজেই পাট গাছ বেড়ে উঠতে পারে । মই দিয়ে পাটের জমিকে সমান করা হয়। জমিতে পরিমাণমতাে সার প্রয়ােগ করা হয়, যাতে জমির উর্বরতা বাড়ে এবং পাটের ফলন বৃথা। পায়। বীজ বপনের কয়েক দিনের মধ্যেই পাটের চারা বের হয় এবং ধীরে ধীরে গাছ বড়াে হতে থাকে। এ সময় বৃষ্টির পানি পেলে পাট গাছ আতদ্রুত বেড়ে ওঠে। তবে পাটের ভালাে ফলনের জন্য রােদের প্রয়ােজন রয়েছে । গাছ একটু বড়াে হলে আগাছা পরিষ্কার। করে দিতে হয় এবং গাছগুলাে ঘন হলে মাঝে মাঝে কিছু গাছ তুলে ফেলে পাতলা করে দিতে হয়। তাতে গাছ সহজেই মােটা ও উচ হয়। এবণ ও ভাদ্র মাস পাট কাটার সময়। চাষিরা পাট কেটে আঁটি বাঁধে এবং আঁটিগুলাে পানিতে ডুবিয়ে রাখে। একে ‘জাগ’ দেওয়া বলে। এই জাগ দেওয়া পাটকে ২০-২৫ দিন পর্যন্ত জলে ডুবিয়ে রাখা হলে পাট গাছ পচে যায়। এরপর গাছগুলাে থেকে আ হাড়িয়ে পিরষ্কার জলে ধুয়ে নিয়ে রােদে শুকাতে হয়। শুকনাে এসব আঁশকেই পাট বলে । ছাল ছাড়িয়ে নেওয়ার পর যে কাণ্ডটি থাকে তাকে পাহাড় বা পাটকাঠি বলে । এগুলাে জ্বালানি, কাগজের মন্ড ও পার্টিকেল বাের্ড তৈরিসহ অন্যান্য কাজে ব্যবহৃত হয়। 

পাটের নানাবিধ ব্যবহার:  পাট একটি অতি প্রয়ােজনীয় সম্পদ। এটি বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। পাটের উপকারিতার কথা। বলে বে করা যাবে না। উৎকৃষ্ট পাটের আঁশগুলাে যেমন লম্বা তেমনি সুক্ষ্ম এবং রেশমের মতাে উজ্জ্বল । পাট হতে চমৎকার কাপড়। হয়। ২৬, জামান প্রভৃতি দেশে পাট হতে উত্তম বস্ত্র তৈরি করা হয়। তাছাড়া পাট হতে কার্পেটও তৈরি হয়ে থাকে। দৈনন্দিন। কালে আমরা পাড়ের থলে ব্যবহার করি। এছাড়া পাট হতে চট, সুতা, দড়ি, কাছি প্রভৃতি জিনিস তৈরি হয়। গৃহস্থের ঘর বাধতে, গােয় চরাতে, জানসপত্র বাধতে পাটের প্রয়ােজন রয়েছে। যুদ্ধের সময় পাটের চাহিদা অত্যন্ত বেড়ে যায়। বােমারু বিমানের। আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষা করার জন্য বালির বস্তার প্রাচীর সষ্টি করা হয়। এজন্য কোটি কোটি টাকার পাটের থলে প্রয়ােজন। পাট হতে মাধু, Iশকা, কাছ ও শিল্পকর্ম সমন্বিত রকমারি পছন্দসই জিনিসও তৈরি হয়ে থাকে । রবারের সঙ্গে পাট মিশিয়ে নানা ধরনের। শিপ্ৰব্য অৰ্ত্তত হয়। পাটখড়ি জ্বালানি ছাড়াও দরিদ্র লােকের ঘরের বেড়া হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশের গবেষকগণের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় সবুজ কাচা পাট থেকে উন্নতমানের কাগজের মণ্ড প্রস্তুত করা সম্ভব হয়েছে। এই মণ্ড থেকে হাজার। হাজার ৮ন হণ্ডাস্ট্রিয়াল পেপার প্রস্তুত করা সম্ভব হয়। এতে দেশের কোটি কোটি ডলারের বৈদেশিক মদ্রার সাশ্রয় হবে। বস্তুত পাটের বহুমুখী ব্যবহারের মাধ্যমে আমাদের দেশে কৃষি ও পাটজাত শিল্প-উন্নয়নে এক চমৎকার সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়েছে। 

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে পাটের স্থান : যুগ যুগ ধরে পাট বেচা-কেনা একটি লাভজনক ব্যবসায় হিসেবে আমাদের দেশে বহুল। প্রচলিত। বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর কোটি কোটি টাকার পাট বিদেশে রপ্তানি হয়ে থাকে, যা বাংলাদেশের অর্থনীতিকে বহুলাংশে। ঋদ্ধ করেছে। আমাদের দেশে পূর্বে পাট হতে চট করার মতাে কোনাে ব্যবস্থা ছিল না। সেজন্য অধিকাংশ পাট বিদেশে রপ্তানি হতাে। বর্তমানে অনেক পাটকল প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় এসব মিলে উত্তম চট, ম্যানিব্যাগ, থলে ইত্যাদি তৈরি হচ্ছে। পূর্বে আমাদের অপেক্ষাকৃত কম মূল্যে পাট রপ্তানি করে পুনরায় বহুগুণ বেশি মূল্য দিয়ে বিদেশ থেকে পাটজাত দ্রব্য আমদানি করতে হতাে। এতে জাতীয় অর্থের অপচয় ঘটত। বর্তমানে এর প্রয়ােজন হচ্ছে না বলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে রপ্তানির আয়ই শুধু যুক্ত হচ্ছে, যা জাতীয় উন্নতিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। 

পাটশিল্প ও পাটজাত দ্রব্যের রপ্তানি : বাংলাদেশের পাট শিল্প গড়ে ওঠার পেছনে যেসব কারণ রয়েছে সেগুলাে হলাে— নাতিশীতােষ্ণ জলবায়ু, সমতল ভূপ্রকৃতি, উর্বর মৃত্তিকা, পর্যাপ্ত কাঁচামাল প্রাপ্তি, দক্ষ ও সুলভ শ্রমিক, বাজার, মূলধন, উন্নত পরিবহন ও যােগাযােগ ব্যবস্থা, সরকারের শিল্পনীতি ইত্যাদি। ১৯৫১ সালে ১০০০ তাঁত নিয়ে নারায়ণগঞ্জের আদমজী নগরে প্রথম পাটকল প্রতিষ্ঠিত হয় । এটি পৃথিবীর বৃহত্তম পাটকল । কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলাে বছরের পর বছর লােকসানের ফলে ২০০২ সালে পৃথিবীর এই বৃহত্তম পাটকলটি বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমানে এদেশে মােট ৭২টি পাটকল চালু রয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের প্রায় ২০% পাটজাত দ্রব্যের মাধ্যমে অর্জিত হয় । বাংলাদেশের পাট আমদানিকারক দেশগুলাের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, মিশর, রাশিয়া, পােল্যান্ড, বুলগেরিয়া প্রভৃতি অন্যতম।

বর্তমান অবস্থা : বর্তমানে বাংলাদেশে নানা কারণে পাটের মূল্য হ্রাস পেতে থাকায় চাষিদের জন্য পাট চাষ তেমন লাভজনক নয় । সাম্প্রতিক বিশ্ববাজারে পাটের পরিবর্তে কৃত্রিম তন্তু দিয়ে প্রস্তুত পলিথিনের ব্যাগ, নাইলনের জাল, রশি ইত্যাদি প্রচলনের ফলে বাংলাদেশের পাটের উৎপাদন ৩০ ভাগে নেমে এসেছে। বস্তুত, একদিকে পাটের রপ্তানি চাহিদা হ্রাস পাওয়া, অন্যদিকে দেশের অভ্যন্তরে অধিকাংশ পাটকল বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে বর্তমানে পাটশিল্পের উন্নয়ন চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। তবে আশার কথা হলাে, বর্তমান সরকার বন্ধ হওয়া পাটকলগুলাে পুনরায় চালু করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। তাছাড়া কৃত্রিম তন্তুর তৈরি দ্রব্যাদি পচনশীল না হওয়ায় পরিবেশের ওপর ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। ফলে এসব ক্ষতিকর দ্রব্যাদি ব্যবহারের পরিবর্তে পাটজাত সামগ্রী ব্যবহারের দিকে পুনরায় বিশ্বব্যাপী ঝোঁক দেখা দিয়েছে । যদি তাই হয় তাহলে পাটের কদর পূর্বের ন্যায় বেড়ে যাবে; রমরমা হয়ে উঠবে পাটের বাজার এবং পাটশিল্প ফিরে পাবে তার হারানাে গৌরব । 

উপসংহার : আমাদের প্রধান খাদ্যশস্য যেমন ধান, তেমনি আমাদের প্রধান অর্থকরী ফসল হলাে 
পাট । বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ কৃষক পাট চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করে। ইদানীং দেখা যাচ্ছে যে, পাট চাষিরা পাটের ন্যায্য মূল্য পাচ্ছে না বলে পাট চাষে নিরুৎসাহিত হয়ে পড়ছে। কারণ, পাট চাষে যে পরিমাণ খরচ হয়, উৎপাদিত পাট বিক্রি করে সেই তুলনায় লাভ হয় না। কাজেই সরকারের উচিত পাট চাষে ভর্তুকি প্রদান করে চাষিদের উৎসাহিত করে তােলা এবং অনতিবিলম্বে দেশের পাটকলগুলােকে সচল করা। সরকারের সুদৃষ্টি ও সদিচ্ছা থাকলে বাংলাদেশের পাট শিল্প উন্নত হবে; স্বর্ণসূত্র ফিরে পাবে তার সােনালি অতীত একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় । বাংলাদেশের উন্নতি ও অগ্রগতির লক্ষ্যে পাটশিল্প উত্তরােত্তর সমৃদ্ধ হয়ে উঠুক এটাই আমাদের মাঙ্গলিক প্রত্যাশা।
Next Post Previous Post