বাংলা রচনা : সমুদ্র সৈকতে একদিন

সমুদ্র সৈকতে একদিন
সমুদ্র সৈকতে একদিন

সমুদ্রসৈকতে একদিন

[ সংকেত: ভূমিকা; আমার কল্পনায় সমুদ্রসৈকত; কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত; আমার সমুদ্রসৈকতে যাবার আগ্রহ; সমুদ্রসৈকতে যাবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ; কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের উদ্দেশে যাত্রা; প্রাতঃকালীন সমুদ্রসৈকত; দ্বি-প্রহরে সমুদ্রসৈকতে; বিকেলবেলায়। সমুদ্রসৈকতে; সূর্যাস্তের দৃশ্য; সমুদ্রসৈকত থেকে প্রস্থান; উপসংহার। ]

ভূমিকা : স্রষ্টার এক অপরূপ সৃষ্টি সমুদ্র। সমুদ্র প্রকৃতিতে আনে বৈচিত্র্য । সমুদ্রের বিশাল জলরাশি দেখে মনে হয় এর অতল গহ্বরে লুকিয়ে আছে কত না অজানা রহস্য। সমুদ্রের বুকভরা জলরাশি কখনাে কখনাে চঞ্চল গতিতে ছুটে চলে, কখনাে বা আবার শান্তরূপ ধারণ করে। সব মিলিয়ে সমুদ্র তার অপরূপ সৌন্দর্যে সবাইকে আকর্ষণ করে। তাই মানুষ প্রতিনিয়ত ছুটে চলে সমুদ্রসৈকতে। 

আমার কল্পনায় সমুদ্রসৈকত : ছােটোবেলা থেকে বাবা-মা, বড়াে ভাই-বােনদের মুখে সমুদ্রসৈকতের অপরূপ সৌন্দর্যের বর্ণনা । শুনেছি । বড়াে আপুর সমুদ্রসৈকতে তােলা ছবি দেখে অভিভূত হয়েছি। তখন থেকেই সমুদ্রসৈকতের সৌন্দর্য নিয়ে আমার কল্পনায় এ এক আবেশ সৃষ্টি হয়েছে। যখন স্কুল-কলেজে পড়ি তখন বই-পত্র পড়ে, বন্ধু-বান্ধব ও শিক্ষকদের কাছ থেকে সমুদ্রসৈকতের বর্ণনা। শুনে আমার কল্পনার সৈকতে আরও নতুন মাত্রা যােগ হয়। আমার কল্পনার সমুদ্রসৈকত ছিল বিশাল। যেখানে ছিল পানি আর । ঢেউয়ের এক অদ্ভুত সুন্দর তরঙ্গ, ছিল বিস্তীর্ণ বালুচর, তীরে আছড়ে পড়া রাশি রাশি ঢেউ। আমার কল্পনার সমুদ্রসৈকত আমাকে ভাবুক করে তুলত। 

কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত : বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মধ্যে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত অন্যতম। এ সমুদ্রসৈকত শুধু বাংলাদেশ। নয়, পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত। এর দৈর্ঘ্য ১৫৫ কিলােমিটার। এর চেয়ে বৃহৎ সমুদ্রসৈকত পৃথিবীর আর কোথাও নেই । কক্সবাজার জেলায় বঙ্গোপসাগরের তীর ঘেঁষে এ সমুদ্রসৈকত অবস্থিত। আমার সমুদ্রসৈকতে যাবার আগ্রহ : যখন থেকে সমুদ্রসৈকতের বর্ণনা শুনেছি তখন থেকেই সমুদ্রসৈকতে যাবার জন্য আমার মন উদগ্রীব হয়ে থাকত। সবসময়ে মনে মনে স্বপ্ন লালন করতাম যে, কবে সমুদ্রসৈকতে বেড়াতে যেতে পারব । মনে হতাে এখনই উড়ালপঙ্খির মতাে চলে যাই। কতবার বন্ধু-বান্ধবদের সাথে কলেজ থেকে যাবার চেষ্টা করলাম, যেতে পারলাম না। কলেজ থেকেও একবার শিক্ষা সফরে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে নিয়ে যাবার পরিকল্পনা হয়েছিল। অবশেষে তাও বাতিল হয়ে যান। তখন ভেবেছিলাম হয়ত আর ভবিষ্যতেও যাওয়া হবে না ।এভাবেই আমার স্বপ্ন প্রতিনিয়ত ভেঙে যাবে। 

সমুদ্রসৈকতে যাবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ : আমার এইচএসসি পরীক্ষার পর আমার বড়াে ভাই একদিন আমাকে ডেকে বলল, তাে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে বেড়াতে যাব । কেমন হবে? আমি তো এমন অপ্রত্যাশিত প্রস্তাবে আকাশ থেকে পড়লাম। বিস্ময়ে আমার চোখ-মুখ লাল হয়ে উঠল। আমার এতদিনের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হতে চলেছে, একথা ভেবে আমি যেন খুশিতে আত্মহারা হয়ে পড়লাম। হাসতে হাসতে ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করলাম, শুধু কি আমরা দুজনেই যাব? তখন ভাইয়া আমাকে চমক দিল যে, আমরা মামাতােচাচাতাে সব ভাইবােন মিলে যাব। আমি তাে মহাখুশি হয়ে গেলাম। আগে কখনাে কল্পনাও করতে পারিনি যে, সবাই একসাথে গিয়ে এভাবে মজা করতে পারব। 

কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের উদ্দেশে যাত্রা : গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসের দশ তারিখ সকালবেলা আমরা ঢাকা থেকে কক্সবাজারের উদ্দেশে রওয়ানা হলাম। অবশ্য আগের দিনই আমাদের প্রয়ােজনীয় জিনিসপত্র সবই গুছানাে ছিল এবং ভাইয়া বড়ােসড়াে একটা মাইক্রোবাস রিজার্ভ করে রেখেছিলেন। তাই নির্ধারিত সময়ে রওয়ানা হতে আমাদের কোনাে অসুবিধা হয়নি। সাথে করে আমরা কিছু খাবার ও পানীয় নিয়েছিলাম । গাড়ি দুরন্ত বেগে সামনের দিকে চলতে শুরু করল। আমি রাস্তার পাশের প্রকৃতির নয়নাভিরাম সৌন্দর্য উপভােগ করলাম। যাওয়ার পথে দুই জায়গায় বিশ মিনিট করে বিরতি নিয়ে চা-কফি খেয়ে আমরা বিকেল পাঁচটার মধ্যে কক্সবাজার পৌঁছালাম। সেদিন আর আমরা ঘুরতে না বেরিয়ে পূর্বনির্ধারিত হােটেলের রুমে গিয়ে বিশ্রাম নিলাম। পরদিন সকাল সকাল বের হবাে বলে প্রয়ােজনীয় জিনিসপত্র প্রস্তুত করে ঘুমিয়ে পড়লাম। 

প্রাতঃকালীন সমুদ্রসৈকত : খুব ভােরে আমরা ঘুম থেকে উঠে নাস্তা করলাম। তারপর সবাই তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে সমুদ্রসৈকতের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লাম। সমুদ্রসৈকতে পৌঁছে আমরা সবাই মিলে নীল দিগন্তে সূর্যোদয়ের দৃশ্য দেখছিলাম । আমার কল্পনার চিত্রপটের সাথে বাস্তবের এত মিল দেখে আমি বিস্ময়াভিভূত হয়ে গেলাম। আমি নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, সমুদ্রসৈকতের দৃশ্য এত নয়নাভিরাম। প্রাতঃকালীন সমুদ্রসৈকত তেমন কোলাহলপূর্ণ ছিল না। প্রকৃতির নির্মলতা আর সমুদ্রের বিশালতায় নিজেকে যেন কোথায় হারিয়ে ফেললাম। 

দ্বি-প্রহরে সমুদ্রসৈকতে : সৈকতে ঘুরতে ঘুরতে আমরা সবাই অনেক ছবি তুলি। শামুক-ঝিনুক কুড়ানাে, বালির ওপর আলপনা আঁকা। এসব নিয়ে আমরা অনেক ব্যস্ত হয়ে পড়লাম । ঘুরতে ঘুরতে কখন যে দুপুর পেরিয়ে যাচ্ছে তা কেউই খেয়াল করতে পারিনি । সবাই এদিক-ওদিক ছােটোছুটি করে বেড়াচ্ছে। হঠাৎ ভাইয়া সবাইকে ডেকে খাওয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন। তখন ঠিকই ক্ষুধা-তৃষ্ণা অনুভব করলাম। ভাইয়া আমাদের তখন সৈকতের নিকটবর্তী একটা হােটেলে নিয়ে গেলেন। বাসমতি চালের ভাত, সামুদ্রিক মাছ ও বিভিন্ন দেশীয় সবজি ও ভর্তাসহ মুখরােচক তরকারি দিয়ে আমরা তৃপ্তিসহকারে দ্বিপ্রহরের আহার সম্পন্ন করলাম। খাওয়ার পর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আবার সৈকতে ঘুরতে আরম্ভ করলাম । দ্বিপ্রহরে সৈকতে ও তার আশপাশের হােটেলগুলােতে মানুষের ভিড় বেড়ে যায়।। 

বিকেলবেলায় সমুদ্রসৈকতে ; সমুদ্রসৈকতের বিকেলের দৃশ্য সত্যিই মনােরম। এসময় সৈকতের চারপাশ মানুষে সরগরম হয়ে থাকে। চারপাশে মানুষের কলরব আর সমুদ্রের ঢেউয়ের কলকল শব্দে প্রকৃতি যেন মুখরিত। দর্শনার্থীরা মনের আনন্দে ঘুরে বেড়ায়। কেউ ছবি তােলে, আবার কেউ কেউ শামুক-ঝিনুক কুড়ায়, আবার অনেকে দল বেঁধে পানিতে সাতার কাটে । আমরা সমুদ্রের জলে নেমে সাঁতার কেটেছি। মনের উচ্ছ্বাসে আমি পানিতে নেমে পড়লাম । আমার সাথে সাথে আমার সব ভাই-বােনেরাও নেমে পড়ল । বিকেলে সমুদ্রসৈকতের মনােরম পরিবেশে দেখা যায় কপােত-কপােতীরা বিচরণ করে অন্তরঙ্গ আলাপচারিতায়। প্রেমিক-প্রেমিকারা ভাবাবেগে হৃদয়ের সবটুকু ভালােবাসা পরস্পরকে উজাড় করে দিতে চায়। মােটকথা বিকেলের সমুদ্রসৈকতের অপূর্ব দৃশ্যাবলি আমার হৃদয়-মনকে রােমাঞ্চিত করেছে। 

সূর্যাস্তের দৃশ্য : সমুদ্রসৈকতের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দৃশ্য হলাে সূর্যাস্তের দৃশ্য। পড়ন্ত বিকেলে পশ্চিমাকাশের রক্তিম সূর্যকে দেখে। মনে হয় যেন সমুদ্রের জলে তলিয়ে যাচ্ছে। এ দৃশ্য যে কত সুন্দর, নিজের চোখে না দেখলে তা কল্পনা করা যাবে না। এই অপরূপ দৃশ্য দেখে আমি নিজেকে যেন কোথায় হারিয়ে ফেললাম। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে পর্যটনকারীরা কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের অপূর্ব রূপ-মাধুর্য অবলােকন করতে আসে।

সমুদ্রসৈকত থেকে প্রস্থান : সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সৈকতের দৃশ্য অবলােকন করে আমরা হােটেলে ফিরলাম। তারপর রাতের। খাওয়া শেষ করে ঘুমাতে গেলাম। ঘুমের ঘােরে আমি যেন আবার সমুদ্রসৈকতে বিচরণ করতে লাগলাম। খুব ভােরে ঘুম থেকে। উঠেই আমরা বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। সেখান থেকে আসতে আমার মন কোনােভাবেই সায় দিচ্ছিল না। তবও আসতে হলাে। 

উপসংহার : ককবাজার সমুদ্রসৈকত দেখতে খুবই সুন্দর। সমুদ্রের ঢেউগুলাে পাড়ে এসে আছড়ে পড়ার দৃশ্য খুবই মনােরম লাগে । আকাশ আর সমদের বিশাল সমুদ্রসৈকতে গেলেই শুধু দেখা যায়। কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত আমাদের দেশের পর্যটন শিল্প হিসেবে গড়ে ওঠেছে। এর রক্ষণাবেক্ষণে আমাদের সকলের এগিয়ে আসা উচিত।
Next Post Previous Post