পারিভাষিক শব্দ, পারিভাষিক শব্দের সংজ্ঞা, ইতিহাস এবং পরিভাষা নির্মাণের উপায়

পারিভাষিক শব্দ
আজকের আলোচনার বিষয় পারিভাষিক শব্দ  

পারিভাষিক শব্দ

পারিভাষিক শব্দ যেকোনাে ভাষার সৃমদ্ধি ও প্রকাশ ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য অত্যাবশ্যক। যে ভাষায় যত বেশি পারিভাষিক শব্দ রয়েছে, সে ভাষা তত বিেশ সমৃদ্ধ। ইংরেজি ভাষা প্রচুর পরিভাষা গ্রহণ করে সমৃদ্ধ হয়েছে। ইংরেজি Terminology শব্দের পারিভাষিক শব্দ ‘পরিভাষা'। 'পরি' একটি উপসর্গ যা ‘বিশেষ অর্থে ব্যবহৃত হয়। ভাষা’ শব্দের পূর্বে ‘পরি’ উপসর্গ যােগে ‘পরিভাষা’ শব্দটি গঠিত হয়েছে। তাই এর আক্ষরিক অর্থ- ‘বিশেষ ভাষা’ । অর্থাৎ পারিভাষিক শব্দের অর্থ হলাে কোনাে ভাষার মধ্যে বিশেষ অর্থে। ব্যবহারযােগ্য শব্দ। অনুবাদের ক্ষেত্রে যথাযথ শব্দের দুপ্রাপ্যতা নিরসনে পরিভাষা মাতৃভাষার ক্ষেত্রে একটি সর্বজনীন সহায়ক উপাদান। সুতরাং একথা অনস্বীকার্য যে, যেকোনাে ভাষায় পরিভাষার গুরুত্ব অপরিসীম। পরিভাষা কী তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বিখ্যাত বাংলা অভিধান ‘চলন্তিকা’-র সংকলক রাজশেখর বসু বলেছেন, অভিধানে পরিভাষা অর্থ। সংক্ষেপার্থ শব্দ। অথাৎ যে শব্দ দ্বারা সংক্ষেপে কোনাে বিষয় সুনির্দিষ্টভাবে ব্যক্ত করা যায় তা পরিভাষা। যে শব্দের অনেক অর্থ, সে শব্দও যদি প্রসঙ্গ বিশেষে নির্দিষ্ট অর্থে প্রযুক্ত হয় তবে তা পরিভাষাস্থানীয় । সাধারণত ‘পরিভাষা’ বললে এমন শব্দ বা শব্দাবলি বােঝায় যার অর্থ পণ্ডিতগণের সম্মতিতে স্থিরীকৃত হয়েছে এবং যা দর্শন, বিজ্ঞান প্রভৃতি আলােচনায় প্রয়ােগ করলে অর্থবােধ সংশয়। ঘটে না। বিদেশি ভাষা থেকে পরিভাষা গ্রহণ করা হয়। পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি ভাষা কোনাে না কোনােভাবে অন্য ভাষা থেকে উপাদান। গ্রহণ করে সমৃদ্ধ হয়। এই সংগৃহীত উপাদানগুলাের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য হলাে পরিভাষা। সাধারণভাবে বলা যায়, ইংরেজি শব্দের স্বাদ, গন্ধ, বৈশিষ্ট্য, চরিত্র, সম্পর্ক, অর্থ ইত্যাদি অনুসারে বাংলা ভাষার প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য অনুসারে শব্দের যে রূপ দেওয়া হয় তাকে পারিভাষিক শব্দ বলে। যেমন— File-নথি, Act—আইন, Farm-খামার ইত্যাদি।

পারিভাষিক শব্দের সংজ্ঞার্থ 

বাংলা ভাষায় প্রচলিত বিদেশি শব্দের ভাবানুবাদমূলক প্রতিশব্দকে পারিভাষিক শব্দ বলে। বস্তুত, মূলশব্দের মৌলিক অর্থ ও ভাবের সঙ্গে সংগতি রক্ষা করে এক ভাষার শব্দকে অন্য ভাষায় রূপান্তরিত করে যে রূপ দান করা হয় তাকেই ‘পরিভাষা' নামে অভিহিত করা যায় । অর্থাৎ বাংলা ভাষায় প্রচলিত বিদেশি শব্দের ভাবানুবাদমূলক প্রতিশব্দগুলােই পরিভাষা। সাধারণত বিজ্ঞান, দর্শন, অর্থনীতি, ধর্মতত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব প্রভৃতি শাস্ত্রীয় বিষয়ের শব্দের প্রয়ােজন হলে এ ধরনের পরিভাষা কোনাে ভাষায় সৃষ্টি এবং প্রয়ােগ করা হয়ে থাকে। অতএব, জ্ঞান-বিজ্ঞানের সুনির্দিষ্ট ক্ষেত্রে যেসব শব্দ সুনির্দিষ্ট বা বিশেষ অর্থে ব্যবহৃত হয় সেগুলােই পরিভাষা বা পারিভাষিক শব্দ।


পরিভাষা নির্মাণে লক্ষণীয় বিষয়ে তিনজন পণ্ডিতের অভিমত


সৈয়দ আলী আহসানের মতে, বাংলা ভাষার গতি প্রকৃতির দিকে এবং বােধগম্যতার দিকে লক্ষ রেখে আমাদের পরিভাষা নির্মাণ করতে হবে । যেখানে আরবি, ফারসির প্রয়ােগ সমীচীন সেখানে আরবি, ফারসি এবং যেখানে সংস্কৃতের প্রয়ােজন সেখানে সংস্কৃত এটাই আমাদের আদর্শ হওয়া উচিত। 

মুহম্মদ আবদুল হাইয়ের মতে, যতটা সম্ভব বাংলা ভাষার ধর্ম, তার শ্রুতিমাধুর্য এবং ব্যাবহারিক প্রয়ােজনের দিক লক্ষ রেখে সংস্কৃত ও আরবি ভাষার শব্দমূলের মধ্যে একটি ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে।

ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে, বাংলা গদ্যের সাহিত্যিক ব্যবহারের প্রারম্ভ থেকেই পরিভাষার জন্য সংস্কৃতের সাহায্য লওয়া হচ্ছে। আমি মনে করি যে, বাংলা ভাষার এই ঐতিহ্যের দিকে লক্ষ করে আমরা একদম সংস্কৃত বর্জন করতে পারি না। সেইরূপ রাষ্ট্রীয় । প্রয়ােজনের দিকে লক্ষ করে আরবি-ফারসিও আমরা অগ্রাহ্য করতে পারি না।

বাংলা পরিভাষা নির্মাণের ইতিহাস 

বাংলা ভাষায় পরিভাষা গ্রহণের ইতিহাস ব্রিটিশ শাসনামলে বিকশিত হতে শুরু করে। ১৭৭২ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ আগস্ট প্রাত জেলায় দেওয়ানি বিচারের জন্য মফস্বলে দেওয়ানি আদালত স্থাপিত হয়। ১৭৭৫ খ্রিষ্টাব্দে স্থাপিত হয় কলকাতায় সুপ্রিম কোট। ১৭৯০ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট আইন প্রণয়ন করেন। ওই আইনের রেগুলেশন যেন সরকার ইচ্ছামতাে পারবতন না করতে পারে সে ব্যাপারে নির্দেশ থাকে। প্রতিটি রেগুলেশন মদিত এবং দেশি ভাষায় অনুদিত হওয়ারও নির্দেশনা দেওয়া হয়। এই আবশি অনুবাদের মাধ্যমে এদেশে আইনের অনবাদ শুরু হয়। ফলে ১৭৭৬ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৭৯৭-৯৮ খ্রিষ্টাব্দ পথত জেও কোড, অর্ডিন অভমনু, এ ডাইজেস্ট অব হিন্দু ল (১৭৭৬-১৭৯৮) প্রণয়নে সংস্কৃত থেকে ইংরেজি পরিভাষা নির্মাণের সূচনা ঘটে। বাংলায় পরিভাষা নির্মাণের গােড়াপত্তন হয় ১৭৮৪ খ্রিষ্টাব্দে। ১৭৮৪ খ্রিষ্টাব্দে জনাথন ডানকানের বাংলা হরফ প্রকাশ হওয়ার মধ্য দিয়েই বাংলা পরিভাষার সূচনা হয়। এ ধারা ১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। ১৮৯৪ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের উদ্যোগে এটি পরিণতরূপ লাভ করে। বিগত দুশ বছরে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের পাশাপাশি ব্যক্তিগত উদ্যোগে পরিভাষা নির্মাণে যারা গুরুত্বপূর্ণ। অবদান রেখেছেন, তাঁদের মধ্যে ফেলিকস কেরি, জনমেক, উইলসন, পিয়ারসন ব্রিটন প্রমুখ উল্লেখযােগ্য। এছাড়া যে সকল বাংলাভাষী পরিভাষা নির্মাণে অনবদ্য অবদান রেখেছেন তাদের মধ্যে- অক্ষয়কুমার দত্ত, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বিপিনবিহারী দাস, রাজেন্দ্রলাল মিত্র, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, যােগেশচন্দ্র, ড. রঘুবীর, বি এন শাল, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, রাজশেখর বসু, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত উল্লেখযােগ্য।

বাংলাদেশের পরিভাষার ইতিহাস 

১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ভাষাসংকট সৃষ্টি হয়। ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে রাষ্ট্রভাষা নিয়ে জিন্নাহর অদূরদর্শী ঘােষণা বাংলাভাষীদের মর্মাহত করে, যার পরিণতি ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে রক্তাক্ত মহান ভাষা-আন্দোলন। অনেক রক্তের বিনিময়ে ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দে। শাসকগােষ্ঠী বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়। বাংলা অক্ষর, ভাষা ও ব্যাকরণকে সহজ করার জন্য বাঙালিরা ২টি সংস্থার জন্ম দেয়। বাংলা ভাষা পরিকল্পনায় এ দুটি প্রতিষ্ঠানই মুখ্য ভূমিকা রাখে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, শিক্ষাবোের্ড, টেকস্টবুক বাের্ড। তখনাে বিকশিত হয়ে ওঠেনি। তবু এসব প্রতিষ্ঠান নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রয়ােজনমতাে পরিভাষা প্রণয়নে ভূমিকা রাখে । ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা একাডেমি ও ১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা উন্নয়ন বাের্ড গঠিত হয়। এ সংস্থা দুটির মাধ্যমে বাংলাদেশে পরিভাষা সম্পর্কিত ধারণার সূচনা ঘটে। ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত মুহম্মদ আবদুল হাই-এর 'আমাদের পরিভাষা সমস্যায় সংস্কৃতের স্থান এবং ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর ‘আমাদের পরিভাষা সমস্যা প্রবন্ধ দুটি পরিভাষার বিকাশসাধনে উল্লেখযােগ্য ভূমিকা রাখে । বাংলাদেশে পরিভাষা প্রণয়নে যে তিন জন মনীষীর নাম স্মরণযােগ্য, তাঁরা হলেন : মুহম্মদ আবদুল হাই, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ও সৈয়দ আলী আহসান। পরিভাষার বৈশিষ্ট্য চারটি । যথা :

    ১. সর্বজনস্বীকৃত 
২. স্বাভাবিকতা
        ৩. বিশিষ্টার্থ প্রয়ােগ 
     ৪. আড়ষ্টত্বহীনতা

পরিভাষা নির্মাণের উপায় 

নিম্নবর্ণিত ৪টি উপায়ে পরিভাষা নির্মাণ করা যায়। যেমন—

১. পূর্ব ব্যবহৃত শব্দ ও শব্দাংশ জুড়ে। যেমন- উপাচার্য (Vice Chancellor)।
২. পূর্ব ব্যবহৃত শব্দের অর্থের পরিবর্তন ঘটিয়ে। যেমন- বর্ণ (রং) > কিন্তু ব্যাকরণে ধ্বনি-সংকেত।
৩. অন্য ভাষা থেকে শব্দ ধার করে। যেমন- Green> সবুজ (ফারসি)-এর বাংলা নাই ।
৪. সােজাসুজি নতুন শব্দ নির্মাণ করে। যেমন- Circle> চক্র।

পারিভাষিক শব্দের প্রয়ােজনীয়তা 

যে কোনাে ভাষার প্রয়ােজনে নানা বিষয়ের উন্নয়ন দরকার হয়। অনেক সময় মনের ভাব প্রকাশ করতে বিদেশি ভাষার শব্দ অনুবাদ। করে কিংবা সরাসরি গ্রহণ করে পারিভাষিক শব্দের মাধ্যমে বক্তব্যকে স্পষ্ট করা হয়। তাই বাংলা ভাষায় পারিভাষিক শব্দের । প্রয়ােজনীয়তা অপরিসীম। কেবল বাংলায় নয়, যেকোনাে ভাষায়ই পরিভাষার প্রয়ােজনীয়তা অপরিহার্য । যেমন—

১. পারিভাষিক শব্দ সংযােজিত হলে ভাযা অধিকতর সমৃদ্ধ হয়। 


২. পরিভাষা ভাষার সৌন্দর্য বৃদ্ধি এবং গতিশীলতায় সহায়ক ভূমিকা পালন করে। 

৩. পারিভাষিক শব্দ বিদেশি শব্দের যথাযথ প্রতিশব্দ সৃষ্টি করে ভাষাকে ঋদ্ধ করে এবং প্রকাশের শ্রীবৃদ্ধি ঘটায়। 

৪. বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত বহু বিদেশি শব্দের যথাযথ প্রতিশব্দ না থাকায় সেসব বিদেশি শব্দ অনুধাবনের জন্য পরিভাষার প্রয়ােজন অনিবার্য। 

৫. অফিস, আদালত ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ প্রাত্যহিক কর্মকাণ্ডের নানা ক্ষেত্রে বাংলা ভাষা ও বাংলা শব্দের ব্যাপক ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য পারিভাষিক শব্দ আবশ্যক। 

৬. বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যাপক অগ্রগতির ফলে নতুন ধ্যান-ধারণা ও সেই সঙ্গে নতুন নতুন শব্দের উৎপত্তি ঘটেছে। বাংলা ভাষায় সেই শব্দগুলাে পারিভাষিক শব্দ হিসাবে গ্রহণ করা গেলে বাংলা ভাষার শব্দভান্ডার অধিকতর সমৃদ্ধ হবে।

৭. অনুবাদের ক্ষেত্রে যথাযথ শব্দের দুপ্রাপ্যতা নিরসনে পরিভাষা মাতৃভাষার ক্ষেত্রে একটি সর্বজনীন সহায়ক উপাদান। সুতরাং একথা অনস্বীকার্য যে, যেকোনাে ভাষায় পরিভাষার গুরুত্ব অপরিসীম।

পরিভাষা ও শব্দের পার্থক্য

Next Post Previous Post