বাংলা রচনা : বইমেলা

বইমেলা
 বইমেলা

গ্রন্থমেলা
অথবা, বইমেলা

[ সংকেত: ভূমকা; একুশে বইমেলার ইতিহাস; বইমেলার তাৎপর্য বা উদ্দেশ্য; বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য; আন্তর্জাতিক বইমেলা; অমর একুশে বইমেলা; ঢাকা বইমেলা; উপসংহার । ]

ভূমিকা : গ্রন্থমেলা লেখক-পাঠক প্রকাশকের মিলন কেন্দ্র। এমনকি বিশ্বের সভ্য জাতিগুলাের আত্মিক মিলনস্থলও গ্রন্থমেলা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন জাতির মানুষ নানা ভাষায় বই প্রকাশ করে নিজেদের চিন্তাধারা, দর্শন ও বিজ্ঞান ভাবনাকে প্রকাশ করেন। সেগুলাে ইংরেজিতে অনূদিত হয়ে তা সারা বিশ্বের সকল ভাষাভাষী মানুষের কাছে পৌছে যায়। এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে বইমেলা বা গ্রন্থমেলা। যেকোনাে শিক্ষিত লােক বইমেলায় গিয়ে নানা দিক থেকে লাভবান হতে পারেন। লেখক ও প্রকাশকের সাথে পরিচিত হতে পারেন। বইমেলা ঘুরে অজস্র ভালাে বইয়ের সন্ধান লাভ করতে পারেন। প্রয়ােজনীয় বইপত্র সংগ্রহ করতে পারেন। গ্রন্থমেলায় জাতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে দেশের মানুষের নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলতে সহায়তা করে।

একুশে বইমেলার ইতিহাস : স্বাধীনতার পর ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশে অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রথম বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়। প্রথমে মক্তধারা নামক প্রকাশনা সংস্থা এ মেলার আয়ােজন করে। পরে আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান এতে অংশ নেয়। ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত এ মেলা অনুষ্ঠিত হতাে মাত্র সাতদিনব্যাপী। এতে প্রকাশক ও পাঠকের বিপুল অংশগ্রহণ ও উৎসাহ-উদ্দীপনা লক্ষ করা যায় । আশাতীত সাফল্যের সাথে ১৯৭৮ সালে এটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে। মূলত এর উদ্যোগ গ্রহণ করে বাংলা একাডেমি। এরপর বইমেলা অনুষ্ঠিত হয় বাংলা একাডেমি এবং বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির যৌথ সহযােগিতায়। ১৯৮৫ সালে বইমেলার নামকরণ করা হয় 'অমর একুশে গ্রন্থমেলা'। ১৯৮৫ সালের অমর একুশে বইমেলাটি প্রথমবারের মতাে পূর্ণাঙ্গ আয়ােজনে সম্পন্ন। হয়। বাংলা একাডেমি এবং বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির যৌথ আয়ােজনে এ মেলাটি অত্যন্ত প্রাণবন্ত পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়। এ মেলায় প্রায় ১৫০টি প্রতিষ্ঠানের স্টল স্থান লাভ করে। এর আগে সর্বোচ্চ ৭০/৮০টি স্টল বসত। ধীরে ধীরে অমর একুশে বইমেলার আয়তনও উপস্থিতি দুইই বেড়ে চলেছে।

বইমেলার তাৎপর্য বা উদ্দেশ্য : বই জ্ঞানের প্রতীক, আনন্দের প্রতীক। খ্যাতি, মান, সম্মান, অর্থ, শক্তি সবকিছুরই ক্ষয় আছে । কিন্তু বই মানুষের জ্ঞানের তপস্যা, আশা-আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে তাকে অক্ষয়, অমর করে রাখে । বই জাতিকে সঠিক পথের সন্ধান দেয়। দেশে সুনাগরিক গড়ে তােলার সবচেয়ে উত্তম উপায় হলাে সুলিখিত, সৃষ্টিশীল ও মননশীল বই। আর এ সকল বইয়ের সমাহার হলাে বইমেলা। বইমেলা হলাে জ্ঞানের ভান্ডার। জাতিকে সুশিক্ষিত করে গড়ে তুলতে বইমেলার ভূমিকা অপরিসীম। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, মানুষ বই দিয়ে অতীত ও ভবিষ্যতের মধ্যে সাঁকো বেঁধে দিয়েছে। কাজেই বইমেলা যুগের সেতুবন্ধন । বইমেলা বর্তমান বিশ্বে অত্যন্ত প্রয়ােজনীয় একটি মিলন কেন্দ্র। বইমেলার মূল উদ্দেশ্য হলাে সাধারণ মানুষের মধ্যে সংস্কৃতি ও সাহিত্য সম্পর্কে ধারণা সৃষ্টি করা । দেশের শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রসার ও সমৃদ্ধিতে বইমেলার উল্লেখযােগ্য ভূমিকা রয়েছে। বইমেলার আরেকটি উদ্দেশ্য হলাে পাঠককে শুধু বই পড়া নয়, পাশাপাশি বই কেনার প্রতিও আগ্রহী করে গড়ে তােলা।

বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য : বইমেলার মহৎ উদ্দেশ্যসমূহের পাশাপাশি একটি বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যও থাকে। বই প্রকাশ করা একটি ব্যয়বহুল শৌখিন ব্যবসায়। লেখক বই লেখেন তার অর্জিত জ্ঞান, তার অব্যক্ত কথা পাঠককে জানাবার জন্য। প্রকাশক লেখকের সেই ইচ্ছা। পূরণ করেন। প্রকাশকের উদ্দেশ্য পাঠক বইটি কিনবেন । বইমেলায় প্রকাশকেরা অংশগ্রহণ করেন বই বিক্রির আশায়। এমনকি বই। রপ্তানি করাও তাদের উদ্দেশ্য। তাই যে বই পাঠক বেশি কেনেন, সে বইই প্রকাশক বেশি প্রকাশ করতে আগ্রহী। প্রকাশকদের কাছে। বই একটি পণ্য এবং এটি বাজারজাত করে প্রকাশক লাভবান হতে চান। বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক সরদার জয়েন উদ্দিনের ভাষায় বলা যায়, বইয়ের ব্যবসায় লাভজনক নয় জেনেও যারা ব্যবসায় করেন তারা সত্যিই মহৎ।

আন্তর্জাতিক বইমেলা : সারা বিশ্বের বিভিন্ন ভাষার বইয়ের মেলাকেই বলা হয় আন্তর্জাতিক বইমেলা। এ ধরনের মেলার অভিজ্ঞতা বড়াই আকর্ষণীয়। এ ধরনের মেলায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের লেখকেরা অংশগ্রহণ করেন। কর্তৃপক্ষ প্রত্যেক দেশ থেকে অতিথি। নির্বাচন করে তাদেরকে মেলায় আমন্ত্রণ জানান। আন্তর্জাতিক বইমেলা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে হয়ে থাকে । আমেরিকা, জার্মানি, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, জাপান, চীন, ভারতসহ আরও অনেক দেশেই আন্তর্জাতিক মানের বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়। এগুলাের মধ্যে জার্মানির ফ্রাংকফোর্ট বইমেলা পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ বইমেলা হিসেবে স্বীকৃত । আমাদের দেশ থেকে হুমায়ূন আহমেদ, কবীর চৌধুরী, আলাউদ্দিন আল আজাদসহ অনেকেই বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বইমেলায় অংশগ্রহণের জন্য আমন্ত্রিত হতেন এবং এখনাে অনেকে আমন্ত্রিত হয়ে বিভিন্ন দেশের বইমেলায় যােগদান করেন। পশ্চিমবঙ্গের বিখ্যাত কয়েকজন সাহিত্যিকও এ ধরনের মেলায় অংশগ্রহণ করেন। প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ফ্রাংকফোর্ট বইমেলায় অংশগ্রহণের বিচিত্র অভিজ্ঞতা বর্ণনা প্রসঙ্গে তার একটি নিবন্ধে বলেছেন, ‘এত বৃহৎ বিশ্ব বইমেলায় ভারতের স্থান নগণ্য। বাংলাদেশ এ মেলায় অংশগ্রহণ করে না, ফলে বাংলা বইয়ের উপস্থিতি নিতান্ত অকিঞ্চিৎকর বলা যেতে পারে। যদিও বাংলা সারা পৃথিবীর সপ্তম প্রধান ভাষা। এই বইমেলায় পশ্চিমা দেশগুলাের বই ব্যবসাই প্রধান। এখানে বইয়ের খুচরা বিক্রি হয় না। হােল সেল বিক্রির চুক্তি এবং অনুবাদের শর্ত বিনিময় হয়। বাংলা বইয়ের ক্ষেত্রে সে রকম কিছু ঘটেছে বলে শুনিনি। এজন্যই আমাদের সাহিত্যের মান ও পরিচিতি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পৌছাতে পারছে না।

অমর একুশে বইমেলাপ্রতিবছর ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম তারিখ থেকে মাসব্যাপী অমর একুশে গ্রন্থমেলা অনুষ্ঠিত হয়। বাংলা একাডেমির উদ্যোগে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে এ মেলা বসে। তবে দিন দিন দর্শক সমাগম ও স্টল সংখ্যা বাড়ার কারণে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে আর সব স্টলের জায়গা হয় না। মেলার স্থান সংকুলান না হওয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে ২০১৪ সাল থেকে মেলার স্থান বর্ধিত করা হয়েছে। ফলে এরপর থেকে প্রতিবছর বাংলা একাডেমির সামনের দিকে সােহরাওয়ার্দী উদ্যানের কিছু অংশ জুড়েও অমর একুশে গ্রন্থমেলার স্টল বসে।

ঢাকা বইমেলা : তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ১৯৯৪ সালে ঢাকা বইমেলার উদ্বোধন করার সময় তাঁর ভাষণে বলেন, প্রতি বছর ১-১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত ঢাকা বইমেলা চলবে । ফলে ১৯৯৫ সালে অত্যন্ত জাঁকজমকের সাথে বিরাট এলাকা জুড়ে আন্তর্জাতিক মানের বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়। শেরে বাংলা নগরে অনুষ্ঠিত ঢাকা বইমেলায় প্রতিবেশী দেশ ভারত ও অন্যান্য কয়েকটি দেশ অংশ নেয়। এ মেলার আয়ােজন করে জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্র। জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্র ঢাকা বইমেলার পাশাপাশি সারা দেশের প্রতিটি জেলায় সপ্তাহ বা ১৫ দিনের বইমেলার আয়ােজন করে । বই কেনার প্রতি আগ্রহ বাড়ানাের জন্য জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্র ভ্রাম্যমাণ বইমেলাসহ দেশব্যাপী বইমেলার আয়ােজন করেছে বিভিন্ন সময় । ১৯৯৫ সালের ঢাকা বইমেলার আয়ােজন বইমেলা সম্পর্কে আমাদের প্রচলিত ধারণা বদলে দিয়েছে। ঢাকা বইমেলায় লেখকদের জন্য আলাদা প্যাভিলিয়ন ছিল। প্রতিটি প্রকাশক শুধু নিজেদের প্রকাশিত বই বিক্রি করে।

উপসংহার : মাত্র ১৫ দিনের ব্যবধানে দুটি বইমেলার আয়ােজন সম্পর্কে কর্তৃপক্ষকে ভাবতে হবে। অমর একুশে বইমেলার সময়সীমা বদলানাে সম্ভব নয় কিন্তু ঢাকা বইমেলার সময়সীমা বছরের মাঝামাঝি করলেই ভালাে হয়। কারণ বই কেনেন বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণি। এদের পকেটে পয়সা জমিয়ে বই কিনতে হয়। বইমেলায় নিয়ম-শৃঙ্খলা বজায় রাখা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। এ ব্যাপারে আমাদের সচেতন থাকতে হবে। বইমেলা যেন বারােয়ারি মেলায় পরিণত না হয়, সেদিকেও লক্ষ রাখা উচিত। অমর একুশে বইমেলা আন্তর্জাতিক মানের বইমেলায় রূপান্তরিত হােক। বইমেলা আমাদের গ্রন্থমনস্ক করে তুলুক। বই মানুষের বিবেকের নিত্যসঙ্গী। বই জ্ঞানের আধার, আত্মার খােরাক। বই হােক আমাদের সকল সময়ের বন্ধু।
Next Post Previous Post