বাংলা রচনা : কাব্য পাঠের আনন্দ

কাব্য পাঠের আনন্দ
কাব্য পাঠের আনন্দ 

কাব্য পাঠের আনন্দ
অথবা, কবিতা পাঠের আনন্দ 


[ সংকেত : ভূমিকা; কবিতা; পাঠকের মন। ]

ভূমিকা : নিজের কথা, পরের কথা বা বাহ্য জগতের কথা সাহিত্যিকের মনােবীণায় যে সুরে ঝংকৃত হয়, তার শিল্পসংগত প্রকাশই। সাহিত্য। সুতরাং সাহিত্যের সঙ্গে মানবমনের সম্পর্ক নিবিড়। সাহিত্যের সাধারণ উদ্দেশ্য আনন্দ দান করা । সাহিত্য জগৎ ও জীবনকে সুন্দর করে এবং সত্যকে আমাদের সামনে তুলে ধরে আনন্দ দান করে। তাই সাহিত্য চিরকাল মানুষের কাছে আনন্দের উৎস। কাব্য হলাে সাহিত্যের একটি শক্তিশালী শাখা । সাহিত্যের সকল শাখা মানুষকে আনন্দ দিলেও কাব্য পাঠের আনন্দকেই মানুষ সবার উপরে স্থান দিতে বাধ্য হয়েছে। কেননা কাব্যের মধ্যে মানুষ তার অন্তরের কথা যেভাবে পায় তা আর কোনাে সাহিত্যাঙ্গিকে পায় না। তাছাড়া কবিও তার মনের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, অনুভূতিকে কবিতায় যেভাবে প্রকাশ করতে পারেন তা অন্য কোনাে সাহিত্য শাখায় সম্ভব নয়। তাই বিশ্বের সব সাহিত্যই কাব্যের মাধ্যমে যাত্রা শুরু করেছে এবং সাহিত্যের অন্যান্য শাখা যেমন- গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ ইত্যাদি এসেছে পরবর্তীকালে । কাজেই কাব্য হলাে পৃথিবীর সব সাহিত্যের একটি শ্রেষ্ঠ শাখা এবং এই। কাব্যই যুগে যুগে, কালে কালে, দেশে দেশে মানুষের মনের কথা বলে দিয়ে মানুষকে আনন্দ দান করে আসছে ।

কবিতা : কবিতায় কবির নিজের এবং মানবমনের অন্তরঙ্গ পরিচয়টি ফুটে ওঠে। কবিতার মূল স্তম্ভ হলাে শব্দ। অর্থাৎ কবিতা। সর্বক্ষেত্রেই শব্দের ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। কবিতার শব্দ কবির অভিজ্ঞতা ও অনুভূতির প্রতীক এবং অর্থ ব্যঞ্জনার বাহন। কাজেই কবিতা বা কাব্য পাঠের আনন্দ উপভােগ করতে হলে শব্দ সম্বন্ধে জ্ঞান থাকতে হবে। নারী যেমন আকার-ইঙ্গিতে, সাজসজ্জায়, বিলাসে-প্রসাধনে আপনাকে মনােরমা করে তােলে তেমনি কবিতাও শব্দে, সংগীতে, উপমায়, চিত্রকল্পে ও অনুভূতির নিবিড়তায় নিজেকে প্রকাশ করে। অর্থাৎ বলা যেতে পারে, মানবমনের ভাবনা-কল্পনা যখন অনুভূতি রঞ্জিত যথাবিহিত শব্দসম্ভারে বাস্ত ব সুষমামণ্ডিত চিত্ৰাত্মক ও ছন্দময় রূপ লাভ করে তখনই তার নাম কবিতা। সৃষ্টির প্রথম থেকেই নারী যেমন তার সৌন্দর্য দিয়ে, মাধুর্য দিয়ে, প্রেম ও সেবা দিয়ে মানুষকে আনন্দ দিয়ে আসছে তেমনি কবিতাও চিরকাল ঐতিহ্য সম্পন্ন অনুভূতিদীপ্ত শব্দের মাধ্যমে, উপমা, রূপক ও চিত্রকল্পের মাধ্যমে, ছন্দের ঝংকারের মাধ্যমে সর্বোপরি প্রেমের মাধ্যমে মানুষকে আনন্দ দিয়ে আসছে। এদিক থেকে কবিতাকে নারীর সাথে তুলনা করলে অত্যুক্তি হবে না। কবিতায় সমগ্র মানবমনের বিচিত্র অনুভূতির প্রকাশ ঘটে। কবিতায় সমগ্র মানুষের মনােভাবের প্রকাশ ঘটে বলে এর আবেদন। সর্বজনীন। কবিতা পাঠের আনন্দও তাই সর্বজনীন। কবিতা তাই সকল কাব্যপ্রেমিক বা রসিকজনের কাছে সমানভাবে সমাদৃত হয় । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন- 'গােলাপের সৌন্দর্য আমি যে উপভােগ করছি তা এমন করে প্রকাশ করতে হয়, যাতে তােমার মনেও সৌন্দর্য ভাবের উদ্রেক হয়।' এরূপ প্রকাশই কবিতা। আবার সময় বিশেষে কোনাে কবির আত্মানুভূতি বা ব্যক্তিগত কল্পনা-বাসনা, আনন্দ-বেদনা ও সুখ-দুঃখ সহজ ও সাবলীল গতিতে অখণ্ড ভাবমূর্তিতে যখন আত্মপ্রকাশ করে তখনই তার নাম কবিতা । এই কবিতা তখনই শেষ এবং সার্থক কবিতা হবে যখন কবির ব্যক্ত অনুভূতি অন্যের অনুভূতির সাথে মিলে যায় । অন্যের হৃদয়-মনকে নাড়া দেয়। আর এ ধরনের কবিতাই সর্বজনীন। পাঠক যখন কবিতার মধ্যে তার মনের ছবি দেখতে পান, তখনই তিনি আনন্দ পান। এবং একাত্ম হয়ে যান কবিতার সাথে। কবিতার জন্মকথা ও উদ্দেশ্য নির্দেশ করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন —

অন্তর হতে আহরি বচন
আনন্দ লােক করি বিরচন
গীত রসধারা করি সিঞ্চন
সংসার ধূলি জালে। 

কবি সংসারের অভাব, অভিযােগ, দুঃখ, দৈন্য প্রভৃতির ওপর গীতরস সিঞ্চন করেন। ফলে —

সুখ হাসি আরাে হবে উজ্জ্বল
সুন্দর হবে নয়নের জল ।
স্নেহ সুধা মাখা বাসগৃহতল
আরাে আপনার হবে। 


কবি আমাদের জীবনকে এক নতুন রূপ দান করেন বলে আমাদের জীবনে আনন্দের রূপ নতুনভাবে অনুভূত হয়। আমরা কবিতা পড়তে ভালােবাসি, কারণ একটি উদ্ধৃষ্ট কবিতায় আমরা আমাদের জীবনকে নতুনরূপে আস্বাদন করি । কবিরা সৌন্দর্যের চরম উৎকর্ষ সুজনের দ্বারা জগতের চিত্তশুদ্ধি বিধান করেন। আর তাই কবিতা পাঠে আমাদের চিত্তের জ্বালা-যন্ত্রণা ক্ষণকালের জন্য কেটে যায়। মানুষমাত্রই প্রয়ােজন বাস্তব জীবনের দুঃখ-দুর্দশা, জ্বালা-যন্ত্রণা, গ্লানি থেকে মুক্তির জন্য একান্ত রমণীয় শীতল আশ্রয় ।

পাঠকের মন : কবিতা পাঠ করতে হলে পাঠকেরও কবিদৃষ্টি থাকা চাই। কবিতার রস গ্রহণ করতে হলে পাঠকেরও কবির মতাে মন থাকা চাই। কবিতার মধ্যে যারা তত্ত্ব খোঁজেন তারা তত্ত্ব এবং আনন্দ দুটো থেকেই বঞ্চিত হন। কেননা একটি ক্ষুদ্র প্রেমের কবিতায় কোনাে তত্ত্বই নেই অথচ কবিতাটিই যুগ যুগ ধরে মানবপ্রকৃতির তথা মানবহৃদয়ের বহিঃপ্রকাশ। সুতরাং এক্ষেত্রে বলা যায়, প্রেমের কবিতা পড়তে হলে পাঠকের হৃদয়েও প্রেম থাকা চাই। তাহলেই পাওয়া যাবে সত্যিকার আনন্দ। কবিতা পাঠের আনন্দকে অমৃতের আস্বাদনের সাথে তুলনা করা হয়ে থাকে। কবিতা অমৃত, কবিরা অমর। কবির রচিত অমৃতরূপ কবিতা কালে কালে, যুগে যুগে। মানুষকে আনন্দ দেয় । কবিতার মাধ্যমে আমরা এক স্বতন্ত্র আনন্দ জগতের সন্ধান পাই । কবি যখন বলেন —

চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য;...


তখন আমাদের চোখের সামনে যেন এক স্বপ্নময় জগৎ ভেসে ওঠে। বিদিশা, শ্রাবস্তী শব্দগুলাে যেন আমাদের অতীতের রাজ্যে নিয়ে। যায়। কবিতা আমাদেরকে কখনাে কখনাে স্বপ্নময় জগতে নিয়ে যায়। আমরা তখন বাস্তবতাকে ক্ষণিকের জন্য ভুলে গিয়ে কবিতার বাস্তবতার সাথে মিশে যাই এবং আনন্দে উদ্‌বেলিত হয়ে উঠি। সাহিত্যের অন্যান্য শাখাও আমাদের আনন্দ দেয়, কিন্তু কবিতা পাঠের যে আনন্দ তা ভিন্নধর্মী এবং তুলনাহীন। কবিতা চিরদিন ধরে মানবহৃদয়ের গভীরে আনন্দ সৃষ্টি করে আসছে। কবিতা তাই মানুষের অতি প্রিয় এবং সাথে সাথে কবিও।
Next Post Previous Post