বাংলা রচনা : বাংলাদেশের সাহিত্য ও সংস্কৃতি

বাংলাদেশের সাহিত্য ও সংস্কৃতি
বাংলাদেশের সাহিত্য ও সংস্কৃতি

সাহিত্য ও সমাজ
অথবা, বাংলাদেশের সাহিত্য ও সংস্কৃতি

[ সংকেত: ভূমিকা; প্রাচীন সাহিত্যে সমাজ-জীবন; মধ্যযুগের সাহিত্যে প্রতিফলিত সমাজ-জীবন; আধুনিক যুগের সাহিত্যে সমাজবাস্তবতা; গীতিকবিতায় বিধৃত সমাজ; কথাসাহিত্যে সমাজ-বাস্তবতা; সাহিত্যে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত সমাজ; পূর্ব বাংলার সমাজ ও সাহিত্য-সংস্কৃতি; মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সাহিত্যে সমাজ-বাস্তবতার চিত্র; আধুনিক সমাজ ও সাহিত্য; সাহিত্যে সমাজ-চেতনার স্বরূপ; উপসংহার। ]

ভূমিকা : সাহিত্য সমাজের দর্পণস্বরূপ। আর মানুষ স্বভাবতই সামাজিক জীব। তাই সাহিত্যের মধ্যে আনন্দ-বেদনা, আশা-নিরাশা, পাওয়া না-পাওয়া, সুখ-দুঃখ, ভালােবাসা-ঘৃণা, সফলতা-ব্যর্থতা প্রভৃতি জীবনের যে প্রতিবিম্ব অঙ্কিত হয় তা সমাজ-বাস্তবতারই। প্রতিচ্ছবি । সুতরাং সাহিত্যের সঙ্গে জীবন তথা সমাজের এক নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে । 

প্রাচীন সাহিত্যে সমাজ-জীবন : যে কোনাে সাহিত্যের সূচনা পর্বে সমাজের চিত্র অনুপস্থিত ছিল । কেননা সেখানে মানুষের চেয়ে বড়াে হয়ে দেখা দিয়েছিল দেব-দেবী, পৌরাণিক কাহিনি কিংবা ধর্ম-চেতনার বিষয়াদি; কিন্তু সাহিত্যে যখন মানুষের কথা আসল, জীবনের কথা আসল অর্থাৎ সমাজের প্রেক্ষাপট উপস্থাপিত হলাে তখনই সাহিত্য তার সার্থকতা খুঁজে পেল । পথিবীর অন্যান্য সাহিত্যের মতাে আমাদের বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন নিদর্শন চর্যাপদ ধর্মীয়-চেতনা সমৃদ্ধ হলেও এর গভীরে মানুষের সমাজ-জীবনের। যে চিত্র রয়েছে তা সাহিত্য শিল্পের দৃষ্টিতে নয় শুধু; মানব ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সৃষ্টি করেছে। সাধারণত বৌদ্ধ সহজিয়া সম্প্রদায়ের সাধনসংগীত, যা সাংকেতিক ভাষায় রচিত হলেও এখানে ধর্মকে ছাপিয়ে মানুষের প্রসঙ্গ এসেছে এবং সমাজবাস্তবতার ছবিও উদ্ভাসিত হয়েছে। তাই আবহমান বাংলার দারিদ্রপীড়িত সমাজ জীবনের পরিচয়ও চর্যাপদে নিহিত রয়েছে। চর্যাপদের সাধনসংগীতের অন্তরালে বাঙালির একান্ত আটপৌঢ়ে দুঃখ-দৈন্যের কথা এভাবে বলা হয়েছে—

টালত মাের ঘর নাহি পড়বেশী
হাঁড়িতে ভাত নাহি নিতি আবেসী ।

অর্থাৎ প্রতিবেশীহীন এক টিলার ওপর ঘর, হাঁড়িতে ভাত নেই অথচ নিত্যদিন প্রতিবেশীর আগমন ঘটেই। এই পদের অংশটুকুতে সাধনসংগীতের যে ব্যাখ্যা বা তাৎপর্য থাকুক না; এখানে জীবনের কথা, তৎকালীন সমাজ-বাস্তবতার কথা নিখুঁতভাবে পাওয়া যায় । এছাড়াও সমাজ-জীবনে শ্রেণিবৈষম্য তথা বর্ণবৈষম্যের দৃষ্টান্তও চর্যাপদে স্পষ্টত পাওয়া যায়—

নগর বাহিরি রে ডােম্বি তােহােরি কুড়িআ
ছােই ছােই জাসি সাে বাহণ নাড়িআ । 

এখানে ভােম্বি' শ্রেণি অন্যদিকে ব্রাহ্মণ শ্রেণির কথা উদ্ধত হয়েছে। কাহ্নপার এ পদ থেকে সহজেই বােঝা যায় যে, সে সমাজেও উঁচু-নীচু ভেদাভেদ বিদ্যমান ছিল। এভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করলে চর্যাপদগুলােতে সমাজ-জীবনের বাস্তবচিত্র যথেষ্ট পাওয়া যায়। 

মধ্যযুগের সাহিত্যে প্রতিফলিত সমাজ-জীবন : প্রসঙ্গত উল্লেখ করা প্রয়ােজন যে, এ আলােচনাতে বাংলা সাহিত্যের যুগ-বিভাগকেই সর্বাধিক প্রাধান্য দেওয়া সমীচীন। তাই মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের বিষয়-বৈশিষ্ট্য সমাজ-জীবনে কতটুকু প্রভাব ফেলতে পারে তারই। বিশেষণ যুক্তিযুক্ত। ১২০০ থেকে ১৩৫০ সাল পর্যন্ত সময়কেই বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগ হিসেবে গণ্য করা হয়। এ কালপর্বেই। বাংলাদেশে মুসলিম শাসন ছিল। এই যুগের কোনাে সাহিত্যিক নিদর্শন পাওয়া যায়নি। কারণ হিসেবে গবেষকেরা অনুমান করেছেন, তুকি বিজয়ের ফলে প্রায় দেড়শ বছর পর্যন্ত বাংলাদেশে নানা বিশৃঙ্খলা, যুদ্ধ-বিগ্রহ প্রভৃতির কারণে সামাজিক কিংবা রাষ্ট্রীয় জীবনে। যদিও কিছু সাহিত্য-শিল্পের সৃষ্টি হয়েছিল তা ধ্বংস হতে বাধ্য। ফলে এই সুদীর্ঘ সময়ে সমাজ-জীবনের কোনাে দৃষ্টান্ত উদ্ধার করাও সম্ভব হয়নি। মধ্যযুগে বাংলা সাহিত্যের অমর রচনা শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'। এছাড়াও এ যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ ঘটনা হলাে চৈতন্যদেবের আবির্ভাব। (১৪৮৬-১৫৫৩)। আমরা নিবিষ্ট দৃষ্টিতে দেখতে পাই যে, দেবতা কৃষ্ণ আর রাধার হৃদয়-ঘটিত ব্যাপারটি ধর্মের আবরণে যাই থাকুক না কেন- মানব সমাজে এটির রূপায়ণ সমাজের আর দশটা ঘটনার মতােই প্রবাহিত হয়েছে । দেব-দেবীর স্থলে গ্রামীণ সমাজের সাধারণ নর-নারীর এক গভীর প্রেমের চিত্রই এখানে মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। আবার চৈতন্যদেবের আবির্ভাবের ফলে রাধাকৃষ্ণের এরূপ প্রেমলীলাও সমাজের সহজ প্রেমের প্রতিচ্ছবিতে পরিণত হয়। তাই তাঁর সহজ উচ্চারণে পাওয়া যায়—

শত কোটি গােপীর সঙ্গে, কৃষ্ণ-প্রেম রসঙ্গে। 

এছাড়াও মধ্যযুগের আরও নানা ধরনের সাহিত্য-শিল্পের বিকাশ ঘটে। যেখানে মানব-জীবন ও সমাজের দৃষ্টান্ত বিরল নয়। মধ্যযুগের অনবদ্য রচনা ‘মঙ্গলকাব্য। এর মধ্যে 'অন্নদামঙ্গল কাব্যটি উল্লেখযােগ্য। অন্নদামঙ্গল কাব্যে সাধারণ মানুষের আকুতি বিশেষ করে দেবীর কাছে ‘ঈশ্বরী পাটনী’র প্রার্থনা—

আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে । 

সত্যি সাধারণ মানুষের প্রতিনিধি হিসেবে পাটনীর এই সহজ-সরল চাওয়া শাশ্বত বাঙালি সমাজের মৌল আকাঙ্ক্ষাকে উপস্থাপিত করেছে। এছাড়াও চণ্ডীদাসের সেই সুপরিচিত উদ্ধৃতি ‘সবার উপরে মানুষ সত্য। অর্থাৎ মধ্যযুগের সাহিত্যের মধ্যে দেব-দেবীর কথা থাকলেও এগুলাের অন্তরালে মানুষের কথা, সমাজের কথাও সমান্তরাল ধারায় প্রবাহিত । তাই আজ যে আধুনিক সাহিত্যের উৎকর্ষের দাবি করা হয় তার ভিত্তি-ভূমিও হতে পারে মধ্যযুগের সাহিত্য। 

আধুনিক যুগের সাহিত্যে সমাজ-বাস্তবতা : মধ্যযুগের ধারার শেষ কবি ভারতচন্দ্রের মৃত্যু হয় ১৭৬০ খ্রিষ্টাব্দে। আর এর পূর্বেই ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার শাসনভার গ্রহণের সুযােগ লাভ করে। এ সময় থেকেই বাঙালির জীবনের সঙ্গে ইউরােপীয়দের প্রত্যক্ষ সংযােগ ঘটে। ১৭৭৮ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা ছাপাখানা, ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠা, রামমােহন রায়ের বেদান্তগ্রন্থ প্রকাশ প্রভৃতির মধ্য দিয়ে একথা বলা যায় যে, ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দ থেকেই বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগ শুরু হয়। আর তখন থেকেই সমাজ জীবনের বাস্তবতা সাহিত্যের মূল উপজীব্য হয়ে ওঠে। সাহিত্যও প্রবাহিত হতে থাকে নানা ধারায় বহুবিধ মাত্রায়। 

গীতিকবিতায় বিধূত সমাজ ; উনিশ শতকের এক অমর সৃষ্টি গীতিকবিতা। বলা হয়ে থাকে, এ কবিতায় ব্যক্তির একান্ত অনুভূতি আর উপলব্ধিই প্রধান বিষয় । সামন্ততান্ত্রিক শােষণ আর শাসনের বেড়াজালে ব্যক্তির যে স্বাধীনতা চরমভাবে ব্যাহত হয় তাই যেন কবিতায় মুক্তজীবনের স্বাদ পেয়ে অবারিত ধারায় প্রবাহিত হয়। আধুনিকতার এ পর্বে তাই ব্যক্তির স্বাতন্ত্র্যবােধ জাগ্রত হয়; ফলে সমাজ-জীবনেও নানা পরিবর্তনের সূচনা হয়। তাই ব্যক্তির সামাজিক জীবন অভিজ্ঞতাই বাংলা গীতিকবিতার আলােচ্য বিষয় হয়ে ওঠে। এছাড়া আধুনিক যুগের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি উপন্যাসে সমাজ-জীবনের বাস্তবতাও সাহিত্যকে স্বতন্ত্র মাত্রা দান করেছে। 

কথা সাহিত্যে সমাজ-বাস্তবতা : উপন্যাসের মধ্য দিয়ে সাহিত্যে গণতন্ত্রায়ন ঘটে; ফলে মানুষের জীবন-দর্শন, সমাজের নানাবিধ। সুবিধা-অসুবিধাসহ প্রাত্যহিক দিনের কথা উপন্যাসকে ঘিরে রচিত হয়। সুতরাং উপন্যাসই হলাে আধুনিক সাহিত্যের আকর। তাই লেখক বা ঔপন্যাসিক একদিকে যেমন তাঁর সৃষ্টিকর্মে জীবনের সুকোমল দিকগুলােকে প্রাধান্য দেন, অন্যদিকে জীবনে যে দুঃখবেদনা, কান্না-হাসি দ্বন্দ-অন্তর্দ্বন্দ্ব থাকে; তাকেও নিপুণভাবে উপস্থাপন করে সমাজ-বাস্তবতার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেন। অবশ্য শিল্প। বিপ্লবের পর থেকে পৃথিবীব্যাপী নগরায়ণের সূচনা হয়, তাতে গ্রামীণ জীবন ভেঙে যেমন শহুরে জীবন গঠিত হয় তেমনি দেখা যায় নানা শাসন-শােষণৰ পয়ভারা। স্পষ্টত পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার উদ্ভব যখন ঘটে- সীমাহীন শােষণে নিঃস্ব মানুষের জীবনকথাই তখন উপন্যাসের বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়। এ অবস্থায় জন্ম নেয় শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের জীবনের চিত্র, যা উপন্যাস এবং ছােটোগলেও স্থান করে নেয়। এ প্রসঙ্গে উল্লেখযােগ্য- মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মানদীর মাঝি', তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'হাসুলি। বাকের উপকথা' ইত্যাদি উপন্যাস। অন্যদিকে, গ্রামীণজীবনের নানা অসংগতি ছােটোগল্পে ও উপন্যাসে গভীরভাবে রেখাপাত করে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছােটোগল্প এবং উপন্যাস এক্ষেত্রে উল্লেখের দাবি রাখে। অন্যদিকে, তৎকালীন সমাজ নষ্ঠভাবে তলে ধরা হয়। সর্বোপরি কথাসাহিত্যে সমাজের ভালােবাসা, দুঃখ-বেদনার ছবি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাসে বলিষ্ঠভাবে তুলে ধরা হয়। সর্বোপরি বিষয়বস্তুই বেশি প্রাধান্য পায় ।

সাহিত্যে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত সমাজ : সমাজে যে মধ্যবিত্তের জীবন-কথা তা মলত নিমবিত্ত মানুষেরই জীবনালেখ্য। তাই আধুনিক কবিতায়, গল্পে, উপন্যাসে ও নাটকে মধ্যবিত্ত তথা নিম্নবিত্ত মানুষের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার কথা বাে”। তারা যায়। যাণ। বৈষম্যে সমাজে দুটি শ্রেণির আবির্ভাব ঘটে— একটি উচ্চবিত্ত, অন্যটি নিম্নবিত্ত । আবার এ সমাজে সম্পদের অসম বণ্টনে জন্ম নেয়। মধ্যবিত্ত শ্রেণি; যারা সচেতন, শিক্ষিত এবং আধুনিক চেতনায় অগ্রসর; কিন্তু জীবনের স্বপ্ন-সাধ পূরণে এরা বরাবরই পরাজিত । মধ্যবিত্ত সমাজের স্বপ্নচারিতা আর স্বপ্নভঙ্গের বেদনাকে অবশেষে অনিচ্ছা সত্তেও গ্রহণ করতে হয়। তাদের চাওয়া আর পাওয়ার মধ্যে একটি বড়াে ব্যবধান সৃষ্টি হয়। তাই আধুনিক কবি জীবনানন্দ দাশ হয়তাে এভাবেই মধ্যবিত্তের চাওয়া-পাওয়ার দেওয়ালকে তুলে ধরেন—

সব পাখী ঘরে আসে- সব নদী ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন
থাকে শুধু অন্ধকার, মুখােমুখি বসিবার বনলতা সেন। 

সুতরাং সাহিত্যে সমাজের নিম্নবিত্তের নিষ্ঠুর কশাঘাত-জর্জরিত জীবন; অন্যদিকে মধ্যবিত্তের হতাশা, নিরাশাপূর্ণ এক ব্যথ জীবনের প্রতিচ্ছবিই প্রকাশ পায়। এরূপ প্রেক্ষাপটে বিষ্ণু দে, বুদ্ধদেব বসু কিংবা সমরেশ বসুর কথাসাহিত্য উল্লেখযােগ্য। 

পূর্ব বাংলার সমাজ ও সাহিত্য-সংস্কৃতি : অপেক্ষাকতভাবে পূর্ব বাংলায় সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে সমাজ-জীবনের চিত্র একটু দেরিতে উপস্থাপিত হতে থাকে। কেননা ১৮৫৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে সেখানে যেমন মধ্যবিত্ত সমাজের সৃষ্টি হয়; তেমনি তৎকালীন সাহিত্য-সংস্কৃতিতে এর প্রভাব লক্ষ করা যায়। অন্যদিকে, ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে পূর্ব বাংলায় মধ্যবিত্ত শ্রেণির জীবন-সমাজও সাহিত্যে স্থান করে নেয়। কেউ কেউ মনে করেন, এ সময়ের সাহিত্যে মধ্যবিত্ত জীবনের। অবক্ষয়, হতাশার চিত্র খুব একটা দেখা যায় না । কিন্তু একটু যত্নবান হলেই বােঝা যায় তৎকালীন সমাজে ব্যাপক ধর্মান্ধতা, অনিয়ম। ও নিরাশা মানুষকে চরমভাবে পর্যদস্ত করে। আবার রাজনৈতিক পালাবদলে দেশভাগের পর চরম বৈষম্য, ধর্মান্ধতা, হতাশা সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘লালসালু’ উল্লেখযােগ্য। আবার পাকিস্তানি স্বৈরশাসনের কবলে পূর্ব বাংলার সমাজ-জীবনে জন্ম দিতে থাকে নানাবিধ শাসন-শােষণ আর সীমাহীন অত্যাচারের ইতিকথা। আর এ অত্যাচারে প্রত্যক্ষ প্রতিবাদের সাহস না পেয়ে হয়তাে সাহিত্যের ভাষা স্বভাবতই প্রতীকাশ্রয়ী হতেই বাধ্য হয়েছিল । তাই স্বাধীনতার পূর্ব পর্যন্ত অধিকাংশ ক্ষেত্রে রূপকের আড়ালেই সাহিত্যকর্মের সৃষ্টি হয়েছে। যেমন- ‘বিদ্রোহী কৈবর্ত’ প্রভৃতি উপন্যাস । এরপর আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। এদেশের অগণিত লেখক, কবি, শিল্পী মুক্তিযুদ্ধকে নানা মাত্রায়, নানা বিশ্লেষণে প্রতিভাত করেছেন । 

মুক্তি যুদ্ধ ভিত্তিক সাহিত্যে সমাজ-বাস্তবতার চিত্র : যেকোনাে জাতির জীবনে স্বাধীনতা একটি অমূল্য সম্পদ। অনেক ত্যাগ, সংগ্রাম আর রক্তের বিনিময়ে পাওয়া স্বাধীনতা যেকোনাে প্রতিভাধর শিল্পীর মূল উপজীব্য বিষয়। অন্যদিকে, সমাজ-বাস্তবতা এর মূল বিষয় না হলেও এ ধরনের বিষয়কে উপেক্ষা করে কোনাে সাহিত্যই রচিত হতে পারে না। তাই মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সাহিত্যে রয়েছে সমাজের কথা, আশা-নিরাশার কথা, আছে বিশ্বাসঘাতকতার কথাও। পাকিস্তানি বাহিনী রাজাকারদের সহযােগিতায় যেভাবে লক্ষ লক্ষ নারীকে লাঞ্ছিত করেছে তা মুক্তিযুদ্ধের করুণ অধ্যায় । দেশমাতৃকার মতােই তারাও হয়েছে ধর্ষিতা-ছিন্নভিন্ন। অথচ এ রাজাকার বাহিনী আমাদের সমাজের অতি নিকটজন, কাছের প্রিয় মানুষ; তবুও বিশ্বাসঘাতকতার এক ন্যাক্কারজনক দৃষ্টান্ত এরাই সৃষ্টি করেছে। তাই কবি হাসান হাফিজুর রহমান তাঁর একটি কবিতায় নারীদের যন্ত্রণার করুণ চিত্র এভাবেই তুলে ধরেছেন—

তােমাদের ঠোটে দানবের থুথু, 
স্তনে নখরের দাগ, সর্বাঙ্গে দাতালের ক্ষত চিহ্ন প্রাণান্ত গ্লানির
লুট হয়ে গেছে তােমাদের নারীত্বের মহার্ঘ্য মসজিদ। 

এছাড়া শওকত ওসমানের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাসের মধ্যে জাহান্নাম হইতে বিদায় উল্লেখযােগ্য। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বরতায় অসহায় সমাজের মানুষ এবং তাদের প্রতিবাদের তীব্র লড়াই বিষয়টি এখানে প্রাধান্য পেয়েছে । সেলিনা হােসেন রচিত হাঙর নদী গ্রেনেড’- উপন্যাসে একাত্তরে গ্রামীণ সমাজজীবনে মুক্তিযুদ্ধকালীন আলােড়ন, আকাঙ্ক্ষা, সংগ্রাম ও প্রিয়জন হারানাের করুণ কাহিনি উঠে এসেছে। এছাড়াও মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নাটক, প্রবন্ধসহ অন্যান্য বিষয়ে যুদ্ধ সংগ্রামের পাশাপাশি জীবন ও সমাজের কথা আছে। আবার কাল-পরিক্রমায় জীবন ও সমাজ পরিবর্তিত হয়, ফলে সাহিত্যেও আধুনিকতার ছোঁয়া পড়তে বাধ্য। 

আধুনিক সমাজ ও সাহিত্য : বিশ্বায়নের প্রভাবে পৃথিবীব্যাপী সমাজ-জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়। পুঁজিবাদের উলঙ্গ বিকাশে মানুষ ক্রমশ নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে । আর নতুন শৌর্য-বীর্য নিয়ে আবির্ভূত হচ্ছে পুঁজিওয়ালারা । ফলে বিশ্বে সর্বহারা মানুষের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে। সমাজে জন্ম নিচ্ছে নানা ধরনের অসংগতি, ক্ষোভ আর হতাশা । এরূপ প্রেক্ষাপটে বিশ্বসাহিত্যে প্রকাশবাদী, প্রতীকবাদী এবং অতিবাস্তববাদী কিংবা শূন্যতাবাদী আন্দোলনও স্থান করে নেয়। এক্ষেত্রে বাংলা সাহিত্যে এ আন্দোলন। পরিলক্ষিত হয়। আধুনিক কবি জীবনানন্দ দাশের বহু কবিতায় পরাবাস্তবতার ব্যবহার লক্ষ করা যায়। এছাড়া সস উপন্যাস, গল্পে ও নাটকে প্রতীকীবাদী এবং শূন্যতাবাদীর যে ব্যবহার তা সমাজ-বাস্তবতারই প্ৰকই দায়। এছাড়াও উত্তর আধুনিকতাবাদে সমাজের অন্তনিহিত পরিবর্তনও সাহিত্যে ধরা পড়েছে। তাই যান্ত্রিক সভ্যতায় পরাস্ত মানবতার হাহাকার এবং ব্যক্তি নিঃসঙ্গতা অন্যান্য সাহিত্যের মতাে বাংলা সাহিত্যে ও সমাজেও বিদ্যমান। 

সাহিত্যে সমাজ-চেতনার স্বরূপ : প্রথম মহাযুদ্ধের সময় বিশ্বসাহিত্যে রণদামামা বেজে উঠল । তার ঢেউ এসে আছড়ে পড়ল বাংলার শ্যামল শান্ত তটে। অস্থিরতা, আর্থনীতিক অনিশ্চয়তা বেড়ে গেল। সমাজ-দেহেও দেখা দেয় প্রকট যুগ-লক্ষণ। মানুষের সুখ-দুখ, পাপ-পুণ্য, সংশয় আর টানাপােড়েন নিয়ে রচিত হলাে অসংখ্য সাহিত্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে সাহিত্যে আবারও | নতন আন্দোলন যােগ হলাে সামাজিক অস্থিরতা, দঃখ-বেদনা-হতাশাই শেষ পর্যন্ত উপজীব্য হয়ে দাড়ায়। এ ধারাবাহিকতায় দেশবিভাগ থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত সমাজ-জীবনের চিত্র বিস্তৃতভাবে সাহিত্যের নানা শাখায় প্রতিফলিত হয়। সুতরাং সাহিত্য প্রকারান্তরে মানব-সমাজের এক জীবন্ত দলিলে পরিণত হয়। 

উপসংহার : সমাজ-জীবন থেকেই সাহিত্য তার রসদ সংগ্রহ করে। তাই সমাজ-বাস্তবতাই সাহিত্যের উৎকর্ষ কিংবা অপকর্ষ নির্ণয়ের মাপকাঠি। অর্থাৎ সাহিত্য সমাজ-জীবনের প্রতিচ্ছবি।
Next Post Previous Post