প্রুফ-সংশোধন, প্রুফ-সংশোধনের নিয়ম,এবং এর প্রয়োজনীয়তা

প্রুফ-সংশোধন, প্রুফ-সংশোধনের নিয়ম,এবং এর প্রয়োজনীয়তা
প্রুফ-সংশোধন, প্রুফ-সংশোধনের নিয়ম,এবং এর প্রয়োজনীয়তা

প্রুফ-সংশোধন 

প্রুফ ইংরেজি শব্দ। এর অর্থ সংশােধন। গ্রন্থ, পুস্তিকা, পত্রিকা, ম্যাগাজিন বা যেকোনাে কম্পােজে বা লেখায় বিদ্যমান ত্রুটি দূর করে লেখানির্ভুল করাকে প্রুফ বলে। প্রুফ-সংশােধন করতে হলে লেখাটি পড়তে হয় এবং প্রমিত বা মান ভাষা সম্পর্কে সম্যক অবগত থাকতে হয়। 

গ্রন্থ রচনা, প্রকাশনা বা কম্পিউটারের ব্যাপক ব্যবহারের ফলে যারা কম্পােজের সঙ্গে যুক্ত, প্রুফ-সংশােধন তাদের জন্য একটি অত্যাবশ্যক বিষয়। প্রুফ-সংশােধনের সময় আধুনিক প্রমিত বানানরীতি ও শব্দচয়ন সম্পর্কে ধারণা না থাকলে প্রুফরিডিং বা সংশােধনের উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়ে যায়। কম্পােজার অথবা যিনি প্রুফ-সংশােধন করেন উভয়ের কাছে ত্রুটিমুক্ত বা প্রমিত শব্দ বা বানান সম্পর্কে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। ফলে মুদ্রিত গ্রন্থ বা copy-টি অসংখ্য ভুলে ভর্তি হয়ে পাঠকের হাতে যায়। পাঠক এমন লেখা পড়ে লেখক, প্রকাশক, প্রুফ-সংশােধক সবার প্রতি ভুল ধারণা নিয়ে বসে থাকে। অক্ষরে ছাপা লেখার অনেক ভুল ও ত্রুটিযুক্ত বিষয় ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। সে কারণেই লেখক, প্রকাশক, কম্পােজার এবং যিনি প্রুফ দেখবেন— সকলেরই প্রফ দেখার নিয়ম সম্পর্কে যথার্থ ধারণা থাকতে হবে। 

পৃথিবীর প্রায় সব দেশে একই নিয়মে প্রুফ-সংশােধনের কাজ করা হয়। ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দে Indian Standards Institution প্রকাশনার সুবিধার্থে প্রুফ-সংশােধনের নিয়মাবলি নির্ধারণের জন্য একটি কমিটি গঠন করে। ওই কমিটি প্রুফ' বা লেখা সংশােধনে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের নিয়মকানুন বিচার-বিশ্লেষণ করে আধুনিক ও যুগােপযােগী একটি সর্বভারতীয় নিয়মাবলি (Proof Corrections for Printers and Authors) প্রণয়ন করেন। আমাদের দেশেও বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় সামান্য কিছু রদবদল করে সর্বভারতীয় নিয়মকেই অনুসরণ করা হয়। 

মুদ্রিত কোনাে কিছু (যেমন- খবরের কাগজ, পত্র-পত্রিকা, বই, অভিধান, গল্প, উপন্যাস, নাটক, কবিতা ইত্যাদি) কারও সামনে উপস্থাপন করার পূর্বে তা প্রেসে বা কম্পিউটারে ছাপিয়ে নিতে হয়। প্রেসের কম্পােজিটর (বর্তমানে কম্পিউটার অপারেটর) মেশিনের অক্ষরে তা আবার লেখেন। লেখার পর কাগজে ছাপ তােলেন। এ ছাপ তােলার কাগজটিই হলাে প্রুফ। অর্থাৎ লেখকের লেখার একটি প্রমাণ বা প্রফ (Proof) । কম্পােজিটর মেশিনে লেখার সময় লেখকের লেখা হুবহু লিখেছেন কি না তা লেখকের লেখার সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে হয়। তখন যদি লক্ষ করা যায় কম্পােজিটর কিছু অংশ বাদ দিয়েছেন, কিংবা বানানে ভুল করেছেন, অথবা হস্তাক্ষর না বুঝতে পেরে অন্য শব্দ কম্পােজ করেছেন, তখন ওই সব ত্রুটি সংশােধন করাই প্রফ-সংশােধনের কাজ। প্রকাশক মহলে Proofএর বাংলা ‘মুদ্রণিকা’ যা থেকে মুদ্রণ করা হয়। সুতরাং প্রুফ-সংশােধন অর্থ- মুদ্রণিকা সংশােধন । 

শুধু কম্পােজিটরই ভুল করেন না, পাণ্ডুলিপিতে লেখকও তথ্য, বানান ইত্যাদিতে অনেক ভুল করতে পারেন। কাজেই Proof-readerকে শুধু কম্পােজিটরের ভুল সংশােধন করলেই চলে না, সেই সঙ্গে লেখকের তত্ত্ব, তথ্য, বাক্য, শব্দ-বিন্যাস ইত্যাদিতে ত্রুটি থাকলে তাও ঠিক করতে হয়। সমাস-সন্ধি, ণত্ববিধান, ষত্ববিধান ইত্যাদি সংশ্লিষ্ট সমস্যাও নিরসন করতে হয় ।

প্রুফ-সংশোধনের প্রয়োজনীয়তা 

প্রুফ সংশােধনের প্রয়ােজনীয়তা অনেক। গ্রন্থে যদি তত্ত্ব, তথ্য, বানান ইত্যাদিতে ভুল থাকে তাহলে পাঠক ভুল বুঝবে, জ্ঞানলাভে ত্রুটি থাকবে । কাজেই নির্ভুল জ্ঞানলাভের জন্য নির্ভুল গ্রন্থ প্রকাশ করা অতীব জরুরি। আর নির্ভুল বই ছাপার পূর্বশর্ত হলাে প্রুফ কপির মধ্যে কোনাে ভুল না থাকা।

অন্যদিকে যদিও কোন লেখকের পাণ্ডুলিপির যথাযথ কম্পােজ হওয়া/না-হওয়া যাচাই করাই গ্রুফ সংশােধন, তবু আরও কথা আছে- বই হােক বা পত্রিকাই হােক, মুদ্রিত কোনাে লেখা জনসাধারণ্যে প্রকাশ পেলে প্রশাসনিক, সামাজিক, ধর্মীয় বহু ক্ষেত্রে তার বিস্তৃতি ঘটে এবং ত্রুটি-বিচ্যুতির জন্য ছাপাখানা আইন (Press Act)-এর আমলযােগ্য অপরাধের আওতাভুক্ত হতে পারে। কাজেই প্রুফ-সংশােধন কাজটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

প্রুফ-সংশোধনের সময় যেসব বিষয় খেয়াল রাখতে হয়

প্রুফ-সংশােধনের সময় সংশােধকের সাবধান হওয়া একান্ত দরকার। লেখকের সম্পর্কে বলা হয়- ‘কালি-কলম-মন লেখে তিনজন। কিন্তু প্রুফ-সংশােধকের বেলায় চোখ ও মনের সংযােগ, সেই সঙ্গে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা একান্ত প্রয়ােজন। কোনাে শব্দের ওপর নজর পড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে বানানটি ঠিক কি না, এ বাক্যে শব্দটির প্রয়ােগ যথার্থ হয়েছে কি না ইত্যাদি। প্রুফসংশােধকের আর একটি বৈশিষ্ট্য থাকতে হবে। একজন প্রুফ-সংশােধক যা পড়বেন (বই, খবরের কাগজ যেটিই হােক), সেখানে কয়টা ভুল হয়েছে তা যেন তার চোখ এড়িয়ে না যায়।

প্রুফ-সংশোধনের নিয়ম

প্রুফ-সংশােধনের সময় ভুলকে চিহ্নিত করা এবং সেটি সংশােধন করাই আসল কাজ; তবে জানার ঘাটতির জন্য অনেক সময় শুদ্ধটাও সংশােধিত হয়ে অশুদ্ধ হয়ে যেতে পারে । কম্পােজের সময় কোনাে জায়গায় অতিরিক্ত বর্ণ, শব্দ, বাক্য কম্পােজ হয়। আবার কখনাে বর্ণ, শব্দ, বাক্য বাদও পড়ে যায়। বানানের ভুল তাে থাকেই। কিছু সাংকেতিক চিহ্ন আছে যা ব্যবহার করে সংশােধনের নির্দেশ দেওয়া হয়। সাংকেতিক চিহ্ন না জানলে ভুলটি অন্যত্র শুদ্ধ করে লিখে টেনে দিলেও কাজ চলে ।

পাণ্ডুলিপি

প্রুফ-সংশােধনের নিয়মবলি-নির্ধারক কমিটি সূচনা থেকেই পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত বিষয়ে কিছু নির্দেশনা বা প্রস্তাব রাখেন । প্রস্তাবগুলাে ছিল : 

১. পাণ্ডুলিপির বাম দিকে কমপক্ষে তিন সেন্টিমিটার মার্জিন রাখতে হবে।
২. পরবর্তীকালে মূল পাণ্ডুলিপির কোনাে পরিবর্তন বা পরিমার্জন নিয়ে যাতে কোনাে সংশয় বা জটিলতা সৃষ্টি না হয়, সেজন্য প্রথম পাণ্ডুলিপি বা কপি সযত্নে পরিমার্জন করে প্রেসে পাঠাতে হবে। 
৩. কোনাে নকশা বা Diagram, Illustration বা ছবি থাকলে তা নির্দেশনাসহ পৃথকভাবে পাঠাতে হবে । 
৪. ফুটনােট যথাসম্ভব বর্জিত হবে। আবশ্যক ফুটনােট পাণ্ডুলিপির যথাস্থানে দুটি সমান্তরাল রেখার মধ্যে লিখে দিতে হবে। তবে ফুটনােট বেশি হলে তা পৃথক কাগজে লিখে দিতে হবে। 
৫. লেখক/সম্পাদক ইচ্ছে করলে পাণ্ডুলিপির মার্জিনে কোথায় কেমন টাইপ হবে তার নির্দেশনা দিতে পারেন। 
৬. লেখক যেকোনাে সময় পাণ্ডুলিপি ছাপানাের পূর্বে সংশােধনী দিতে পারেন। তবে ছাপার পরও সংশােধনী দেওয়া সম্ভব। এক্ষেত্রে তা কীভাবে হবে তা লেখক ও প্রকাশক নির্ধারণ করবেন।

প্রুফরিডারের দায়িত্ব 

কোনাে গ্রন্থ বা কপি নির্ভুল ছাপানাের জন্য কম্পােজারের যে রকম দায়িত্ব, প্রুফরিডারের দায়িত্ব তার চেয়ে কম নয়; বরং অনেক বেশি। কারণ কম্পােজার যা কম্পােজ করেন, তার ভুল ধরা হলাে প্রুফরিডারের দায়িত্ব। অন্যদিকে সাধারণ কম্পােজারের চেয়ে প্রুফরিডারকে অনেক দক্ষ ও অভিজ্ঞ মনে করা হয়। একজন দক্ষ প্রুফরিডারের সার্বিক দিকনির্দেশনায় একটি গ্রন্থ বা কপি নির্ভুল মুদ্রিত হতে পারে। তাই প্রুফরিডারকে অবশ্যই প্রমিত বানান, ত্রুটিমুক্ত শব্দচয়ন এবং আধুনিক বাংলা ভাষার পর্যায়ক্রমিক গঠন পরিবর্তন সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা থাকতে হবে। প্রুফরিডারকে অবশ্যই হতে হবে ধৈর্যশীল ও তীক্ষদর্শী । বর্তমান সময়ে প্রফেশনাল প্রুফরিডার ছাড়াও অনেক গ্রন্থকার নিজের গ্রন্থের প্রুফ সংশােধনের কাজ নিজেই করে থাকেন। গ্রন্থকার নিজের গ্রন্থের প্রুফ দেখলে মুদ্রিত গ্রন্থটি বহুলাংশে নির্ভুল হয় । লেখক বা প্রফেশনাল প্রুফরিডার যিনিই প্রফ-সংশােধনের কাজ করবেন, তাকে কতকগুলাে নিয়ম মেনে চলতে হবে। যেমন-

১. প্রফ হাতে আসার সাথে সাথে সংশােধন কাজ শুরু করা, যাতে সংশােধিত প্রুফ ফেরত পাঠাতে বিলম্ব না হয় । 
২. প্রফ-সংশােধনের সময় মূল পাঠের কোনাে পরিবর্তন বা সংযােজন বাঞ্ছনীয় নয়। 
৩. লেখার কোনাে অংশ যাতে পাণ্ডুলিপি হতে বাদ না পড়ে, সেজন্য মূল পাণ্ডুলিপির সাথে মিলিয়ে প্রুফ-সংশােধনের কাজ করতে হবে। 
৪. সংশােধনের কাজটি নির্ভুলভাবে সম্পন্ন করার জন্য একজন সহকারী নেওয়া যেতে পারে, যিনি পাণ্ডুলিপি পড়বেন এবং সাথে। সাথে প্রুফরিডার প্রতিটি লাইন মিলিয়ে প্রয়ােজনীয় সংশােধন করবেন। 
৫. প্রুফ-সংশােধনের সংকেত চিহ্নগুলাে প্রুফ-শিটের স্ব স্ব লাইনের বাঁ-দিকের মার্জিনে পরপর লিখতে হবে। প্রয়ােজনে ডান দিকেও লেখা যাবে । 
৬. মার্জিনে পৃথক বােঝাতে প্রত্যেক সংকেত চিহ্নের পরে একটা হেলানাে স্ট্রোক (/) দিতে হবে।
৭. বিভাগ ও উপবিভাগের শীর্ষকগুলাের জন্য নির্দেশিত মাপের হরফ ব্যবহার করা হয়েছে কি না সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে।
৮. মূল পাঠের প্রত্যেক অনুচ্ছেদ, উদ্ধৃতি ও উদাহরণ যথাযথ বিন্যস্ত আছে কি না, সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে ।
৯. সংখ্যা, পরিসংখ্যান ও তারিখ নির্ভুল রয়েছে কি না, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে।
১০. সংযুক্ত চিত্র, চিত্রের নম্বর (যদি থাকে), সরণির পরিচয় ও ক্রমিক সংখ্যা ঠিক আছে কি না, সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে।

বাংলা প্রুফ সংশোধন এর উদাহরণ : 

বাংলা প্রুফ সংশোধন উদাহরণ
Next Post Previous Post