বাংলা রচনা : অধ্যবসায়

বাংলা রচনা : অধ্যবসায়
অধ্যবসায়

অধ্যবসায়
অথবা, ছাত্রজীবনে অধ্যবসায়ের প্রয়ােজনীয়তা 


[ সংকেত : ভূমিকা; অধ্যবসায়ের প্রয়ােজনীয়তা; ব্যক্তিজীবনে অধ্যবসায়ের গুরুত্ব; ছাত্রজীবনে অধ্যবসায়ের গুরুত্ব; জাতীয় জীবনে অধ্যবসায়ের গুরুত্ব; অধ্যবসায়ের প্রতিবন্ধকতা; অধ্যবসায়ই সাফল্যের চাবিকাঠি; উপসংহার। ]


ভূমিকা : কোনাে কাজে একবার ব্যর্থ হলে তাতে সফলতা লাভ করার জন্য বারবার চেষ্টা বা সাধনা করার নামই অধ্যবসায়। মূলত অধ্যবসায় হলাে কতিপয় গুণের সমষ্টি। পরিশ্রম, ধৈর্য, আন্তরিকতা ইত্যাদি গুণের সমন্বয়ে অধ্যবসায় পূর্ণতা লাভ করে। আবার মনের আস্থা ও বিশ্বাসকে বাস্তবে রূপদানের জন্য সুদৃঢ় সংকল্প নিয়ে পরিশ্রম করাকে ও চেষ্টার পুনরাবৃত্তিকে অধ্যবসায় বলে । সুখদুঃখ, উত্থান-পতন, ব্যর্থতা-সফলতা এগুলাে সাপেক্ষ পদ। অর্থাৎ একটি অপরটির ওপর নির্ভরশীল। বাস্তব জীবনে ব্যর্থতা ও সফলতা পাশাপাশি অবস্থান করে এবং একটির পর অপরটি ক্রমান্বয়ে আসে। তাই কোনাে কাজে বিফল হলে তাঁতে হাল না ছেড়ে সংগ্রাম অব্যাহত রাখতে হবে। কারণ, 'Life means struggle' আর অধ্যবসায়ের মাধ্যমেই একদিন সফলতার চরম শিখরে আরােহণ করা সম্ভব হয়। এ প্রসঙ্গে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছেন



কোনাে কাজ ধরে যদি উত্তম সে জন।
হউক সহস্র বিঘ্ন ছাড়ে না কখন। 


অধ্যবসায় সফলতার চাবিকাঠি। অধ্যবসায় ছাড়া মানবজীবনে উন্নতির আশা কল্পনা মাত্র । তাই জীবনে বড়ো হতে হলে আমাদের সবাইকে অধ্যবসায়ী হতে হবে। 


অধ্যবসায়ের প্রয়ােজনীয়তা : মানবসভ্যতার মূলে অধ্যবসায়ের এক বিরাট মহিমা রয়েছে। মানবজীবনের যেকোনাে কাজে ব্যর্থতা আসতে পারে, কিন্তু সে বাধাকে ভয় পেয়ে বসে থাকলে চলবে না। কারণ জীবনের সমস্যাকে এড়িয়ে যাবার অর্থ হলাে, জীবনকে অস্বীকার করা। রাতের আঁধার পেরিয়ে যেমন দিনের আলাে এসে দেখা দেয় তেমনি কাজের ক্ষেত্রেও ব্যর্থতার পরে আসে সফলতা । সকল ধর্মগ্রন্থে অধ্যবসায়কে অন্যতম চারিত্রিক গুণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। যথার্থ অধ্যবসায় না থাকলে বা এর যথার্থ প্রয়ােগ না হলে বিশ্বাস, মেধা বা সুযােগ কোনােকিছুই চূড়ান্ত সার্থকতা এনে দিতে পারে না। মানুষকে জীবনে অনেক বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে নানা প্রতিকূলতা মােকাবিলা করে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌছাতে হয়। মানুষের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানাের জন্য প্রয়ােজন অধ্যবসায় । তাছাড়া নিজেকে সত্যিকার মানুষ হিসেবে গড়ে তােলার জন্য অধ্যবসায়ের কোনাে বিকল্প নেই। যে ব্যক্তি অধ্যবসায়ী নয় সে মনের দিক থেকে পঙ্গু। ফলে তার দ্বারা সমাজের কোনাে উন্নতি হয় না। প্রকৃতপক্ষে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই অধ্যবসায়ের গুরুত্ব অপরিসীম। নৈরাশ্য ও ব্যর্থতাকে জয় করার প্রধান উপায় হচ্ছে অধ্যবসায়। কথায় আছে 'Failure is the pillar of success'. বিশ্ববিখ্যাত মিথ লেখক আলবেয়ার কামু তাঁর ‘মিথ অফ সিসিফাস' গ্রন্থে দেখিয়েছেন, নায়ক একটি ভারী পাথর পাহাড়ের উপরে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু পাথরটি বারবার শত শত ফিট নিচে পড়ে যাচ্ছে। আবার তাকে সেই পাথর উপরে তুলতে হচ্ছে। এই ছিল তার নির্ধারিত শাস্তি । কিন্তু তারপরও সে দমে যায়নি। পাথরখণ্ডটি যতবার নিচে পড়ে যাচ্ছে, পুনরায় তা উপরে তুলে নিয়ে যাচ্ছে । একথা সত্য যে, সফলতাহীন কাজে কোনাে সুখ নেই, আনন্দ নেই। কিন্তু নায়ক পরাজয়কে স্বীকার না করে, যতবার পড়ে যায় ততবারই পাথরখণ্ডটি টেনে তােলে। এরূপ অধ্যবসায় ও সাধনা যার মধ্যে আছে সে কখনাে হারতে পারে না। তেমনি পৃথিবীর মানুষ এমন। অদম্য ও অবিরাম অব্যাহত প্রয়াসকেই বেছে নিয়েছে। প্রবল অধ্যবসায়ের বলেই তাদের সফল হতে হবে । 


ব্যক্তিজীবনে অধ্যবসায়ের গুরুত্ব : অধ্যবসায় ব্যক্তিজীবনেও সফলতা এনে দিতে পারে। ব্যক্তিজীবনের পূর্ণাঙ্গ বিকাশের জন্য বুদ্ধির বিকাশ, সুদৃঢ় সংকল্প ও কাজের প্রতি আগ্রহ থাকা প্রয়ােজন। এগুলাে ছাড়া জীবনে কোনাে কিছুই অর্জন করা সহজ নয়। তাই জীবনকে সুখময় ও সুনিয়ন্ত্রিত করার জন্য অধ্যবসায়ের গুরুত্ব রয়েছে। অধ্যবসায়ের মাধ্যমে ব্যক্তি তার জীবনের ঈপ্সিত ফল পেতে পারে। 


ছাত্রজীবনে অধ্যবসায়ের গুরুত্ব : ছাত্রজীবনে যে অধ্যবসায়ের প্রয়ােজন রয়েছে, এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। যেখানেই সফলতা চাই, সেখানেই অধ্যবসায়কে খোঁজ করতে হবে। যে ছাত্র একবার পরীক্ষায় ফেল করে দ্বিতীয়বার আর ফেলের ভয়ে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে না, অধ্যবসায়ী হওয়ার চেষ্টা করে না, সে জীবনে কখনাে সফলতা লাভ করতে পারে না। ছাত্রদের জানা উচিত ছাত্ৰনং অধ্যয়নং তপঃ। তাদের আরও জানা উচিত 'Diligence is the mother of good luck' (Franklin)। অনেকে মনে। করেন যারা জীবনে বড়াে হয়েছে তারা অত্যন্ত মেধাবী ও অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। ধারণাটি সম্পূর্ণ ভুল। প্রতিভা কারও একচেটিয়া অধিকার নয়। তা সকলেরই থাকে, তবে একে যথাযথ কাজে লাগাতে হয়। এ সম্পর্কে ডাল্টনের কথা স্মরণযােগ্য, ‘লােকে আমাকে প্রতিভাবান বলে, কিন্তু আমি পরিশ্রম ছাড়া কিছুই জানি না। আবার ভলতেয়ার বলেছেন, প্রতিভা বলে কিছু নেই। পরিশ্রম ও সাধনা করে যাও তাহলে প্রতিভাকে অগ্রাহ্য করতে পারবে।' জীবন যুদ্ধে সফলতার মূল চাবি যে অধ্যবসায় তা ইতিহাসের পাতা উলটালে সহজেই প্রতীয়মান হয়। বিজ্ঞানী নিউটন বলেন, 'আমি সারা জীবন শুধু সমুদ্র তীরের বালু নুড়ি নিয়েই খেলা করেছি, সমুদ্রের বিশাল জলরাশি আর দেখা হয়নি।' উক্তিটি থেকে প্রমাণিত হয় যে, তাঁর অধ্যবসায়ের দৌড় কতটুকু ছিল । নেপােলিয়ান জীবনে অসম্ভব বলে কিছু জানতেন না। তাই তিনি দৃঢ়কণ্ঠে বলেছিলেন, 'Impossible is a word found in the dictionary of the fools', তার সেদিনের সে উক্তি ও সফলতা তার অদম্য অধ্যবসায়ের ফসল। আর এরকম দৃষ্টান্ত ইতিহাসের পাতায় অসংখ্য। তাই বােঝা যায়, জীবনে সফল হতে হলে অধ্যবসায়ী হওয়া একান্তভাবে আবশ্যক। 


জাতীয় জীবনে অধ্যবসায়ের গুরুত্ত্ব : জাতির উন্নয়নের জন্য সকল জনগণকে অধ্যবসায়ী হতে হবে । সকলের সমন্বিত প্রচেষ্টাই একটি জাতিকে উন্নতির দ্বারে এগিয়ে নিতে পারে। বর্তমানে যেসব জাতি উন্নতির শিখরে অবস্থান করছে, তা সম্ভব হয়েছে কেবল অধ্যবসায় ও পরিশ্রমের কারণে। পূর্বের ইতিহাস তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ। তাই দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য অধ্যবসায়ী হওয়া বাঞ্ছনীয়। 


অধ্যবসায়ের প্রতিবন্ধকতা : অধ্যবসায়ের মূল প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে আলস্য। এছাড়াও সৎসাহস ও মনােসংযােগের অভাব অধ্যবসায়ের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। আলস্য, সৎসাহস ও মনােসংযােগের অভাবে মানুষ সাধনায় নিমগ্ন হতে পারে না। অধ্যবসায়ের ক্ষেত্রে ইচ্ছাশক্তি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কেননা ইচ্ছা থাকলেই কোনাে না কোনাে উপায় বের হয়ে আসে। কেবল ইচ্ছাশক্তির মাধ্যমেই মানুষ প্রতিকূল পরিবেশকে অনুকূলে আনতে পারে । 

অধ্যবসায়ই সাফল্যের চাবিকাঠি : যেকোনাে কাজে সফলতা অর্জনের জন্য চাই অধ্যবসায়। অধ্যবসায় ছাড়া কোনাে কাজে সফল হওয়া যায় না। ইতিহাসের পাতায় যারা আজও অমর হয়ে আছেন, তারা অধ্যবসায়ের মাধ্যমেই সফল হতে পেরেছিলেন। তারা ব্যর্থতাকে জয় করে কঠোর পরিশ্রম ও অধ্যবসায়কেই জীবনের একমাত্র অনুষঙ্গ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। স্কটল্যান্ডের রাজা রবার্ট ব্রুস ইংল্যান্ডের রাজা এডওয়ার্ডের সাথে ছয়বার যুদ্ধে পরাস্ত হয়ে বিষন্ন মনে বন-জঙ্গলে ঘুরছিলেন। তখন একদিন এক গুহায় একটি মাকড়সাকে সাতবার চেষ্টা করে সুতা জড়াতে দেখে তিনি অদম্য উৎসাহ নিয়ে সপ্তমবারের মতাে শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে দেশকে স্বাধীন করেন। আবার মহাকবি ফেরদৌসী দীর্ঘ তিরিশ বছর সাধনা করে রচনা করেন অমর মহাকাব্য ‘শাহানামা’ । তেমনি আমরা। দেখি মহানাব হজরত মুহম্মদ (সা.) ইসলাম ধর্ম প্রচার করতে গিয়ে বহুবার বাধাপ্রাপ্ত হয়েছেন। এমনকি রক্তাক্ত পর্যন্ত হয়েছেন। তারপরও তিনি নতুন উদ্যমে ধর্মপ্রচার করে বিপথগামীদের ধর্মের পথে ফিরিয়ে এনেছেন। তাই বলা যায়, একমাত্র অধ্যবসায়ই মানবজীবনে সােনালি অধ্যায়ের সূচনা করতে পারে এবং অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারে। 


উপসংহার : অধ্যবসায়ের মাধ্যমে জীবনে জয়ী হওয়া যায় । তাই সাফল্য নামক সােনার হরিণের জন্য আমাদের সকলকে অধ্যবসায়ী হতে হবে। জীবনে একবার সফলতা আসলে আর পিছ পা হতে হয় না। এ সম্পর্কে : Nicolas Chamfort -এর উক্তিটি স্মরণীয় 'Success makes success or money makes money.' ইতিহাস থেকে জানা যায় পৃথিবীর অধিকাংশ জ্ঞানী-গুণী, দার্শনিক, বিজ্ঞানী ও পণ্ডিতরা ছিলেন চাষাভুষা, শ্রমিক, দর্জি, মুচি প্রমুখ গরিব লােকের সন্তান। তারা আজ এত বড়াে হয়েছেন, শুধু অধ্যবসায়ের। শক্তিতেই। তাদের মনে ছিল বড়াে সাহস ও জানার প্রচণ্ড আগ্রহ, অন্যকিছু নয়। তাই কবি তার কণ্ঠে উচ্চারণ করেছেন

পারিব না এ কথাটি বলিও না আর।
একবার না পারিলে দেখ শতবার। 

সুতরাং জীবনে সাফল্য আনতে হলে অধ্যবসায়ের কোনাে বিকল্প নেই।

Next Post Previous Post