প্রবন্ধ রচনা : রূপসি বাংলাদেশ

রূপসি বাংলাদেশ

ভূমিকা : প্রকৃতির এক অপরূপ লীলাভূমি বাংলাদেশ। প্রকৃতি তার অকৃপণ উদারতায় তিল তিল করে সাজিয়েছে এই মনোলোভা দেশটিকে। বিস্তীর্ণ সমভূমি, রূপালি নদীনালা, শ্যামল পাহাড়-টিলা, সবুজ বন-বনানী আর তরঙ্গমুখর সাগর বিচিত্ররূপের অপরূপ সমারোহে বাংলাদেশ হয়ে উঠেছে প্রকৃতির রূপসি কন্যা। বাংলাদেশের অনাবিল সৌন্দর্যে আপ্লুত হয়ে কবি আবেগমথিত উচ্চারণে বলেছেন ‘রূপসি বাংলা' ।

বাংলাদেশের ভূ-প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য : পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপ বাংলাদেশ। এর উত্তরে হিমালয়, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। উত্তরের পাহাড় বেয়ে নেমে আসা পলি জমে জমে সাগরের বুক থেকে জেগে উঠেছে এ দেশ। এর গায়ে জড়িয়ে আছে হাজারো নদীর জাল। এর সমতল ভূমি দিগন্ত থেকে দিগন্তে প্রসারিত। শুকনো মৌসুমে সবুজ ফসলের মাঠে ঢেউ তোলে দখিনা বাতাস, আবার বর্ষাকালে সেই মাঠেই দেখা যায় নদী উপচানো পানির তরঙ্গমালা। ফসলের মাঠের দিকে তাকালে মনে হয় সবুজ কাপড় গায়ে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশ নামের প্রকৃতি-কন্যা। উত্তর, পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব দিকে মাথায় সবুজ টোপর পড়ে ধ্যানমগ্ন ঋষির মতো নিশ্চল দাঁড়িয়ে আছে ছোট-বড় অসংখ্য পাহাড়। পাহাড়ের কোল জুড়ে সাজানো রয়েছে চা বাগান। বিচিত্র গাছপালা আর জীবজন্তুতে পরিপূর্ণ এ পাহাড়ি বনাঞ্চল। পাহাড়ি ঝরনা আর জলপ্রপাত স্বপ্নাবেশ তৈরি করে সৌন্দর্যপ্রেমী মানুষের মনে। উত্তরে রয়েছে গেরুয়া রঙের মাটির ভাওয়াল ও মধুপুরের গড়, যেখানে সৈনিকের মতো দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি গজারি গাছ। পশ্চিমে রয়েছে অবারিত প্রান্তরের ধুলিধূসর রুক্ষতা। তবে সেখানেও আছে মাঠের পর মাঠ আমের বাগান, পানের বরজ আর আখের ক্ষেতের সবুজ গালিচা। দক্ষিণে বাংলাদেশের পা চুমু দিয়ে শুয়ে আছে বঙ্গোপসাগর; আর সাগরের সঙ্গে মিতালি স্থাপন করে উপকূল জুড়ে গড়ে উঠেছে পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবন। বন জুড়ে সবুজ পাতার ঘন আস্তরণ এক অপরূপ নৈসর্গিক দৃশ্য সৃষ্টি করেছে। সেখানে বসতি গড়েছে ডোরাকাটা রয়েল বেঙ্গল টাইগার আর চিত্রল হরিণেরা। সুন্দরবনের ভিতর দিয়ে জালের মতো ছড়িয়ে থাকা নদীগুলোতে বাস করে ভয়ানক কুমির। সবকিছু মিলিয়ে ভয়াল সুন্দর এ বনভূমি সৌন্দর্যপিপাসু মানুষের চিত্তকে হরণ করে নেয়। নীল সাগরের বুকে জেগে ওঠা দ্বীপসমূহে তাল-নারকেল-সুপারির বাগান, বেত-শোলা-কেওড়ার বন আর প্রান্তর জোড়া ধানক্ষেত- সবুজে-নীলে মাখামাখি এ এক অপরূপ দৃষ্টিনন্দন দৃশ্য ।

রূপসি বাংলাদেশ

বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলে রয়েছে পৃথিবীর বৃহত্তম কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত। এখানে অবারিত জলরাশির শুভ্র-ফেনিল তরঙ্গমালার গর্জন এক অপূর্ব সুরাবেশ তৈরি করে। বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিন'স সমুদ্রমোহনায় অপরূপ শোভা নিয়ে অবস্থান করছে। ফয়'স লেকের নৈসর্গিক শোভা মনোলোভা। কুয়াকাটা সমুদ্রতটে দাঁড়িয়ে দেখা যায় সমুদ্রে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের নান্দনিক দৃশ্য ।

সবুজ শ্যামলিমা ছায়া সুনিবিড় গ্রামগুলোই বাংলাদেশের প্রাণ। কতিপয় শহর বাদ দিলে বাংলাদেশ তো ‘গ্রাম বাংলা’। প্রকৃতির নিটোল সৌন্দর্যে গর্বিত এই বাংলা। দিগন্ত প্রসারিত সবুজের অবগুণ্ঠন ভেদ করে উঁকি দেয় সোনালি শস্য। নদী- বিল-ঝিলের স্বচ্ছ পানিতে দোলে সাদা, লাল কিংবা গোলাপি শাপলা। অলস দুপুরে একটানা বিরহের সুর তোলে ঘুঘু। গরু চরানোর ফাঁকে গাছের গোড়ায় হেলান দিয়ে রাখাল বাঁশিতে তোলে করুণ রাগিণী। গোধূলি বেলায় আকাশে ধূলি উড়িয়ে গরুর পাল লয়ে তারা ঘরে ফেরে। আলো-আঁধারির ঐ সময়ে দল বেঁধে বলাকাদের উড়ে যাওয়া এক অপার্থিব দৃশ্যের সৃষ্টি করে। অন্ধকার নেমে না আসতেই বাঁশবাগানের মাথার ওপর জ্যোৎস্নার স্নিগ্ধতা নিয়ে উপস্থিত হয় চাঁদ; বন-বনানীর পাতায় পাতায় লাগে আলোর নাচন। বাংলার এমন সৌন্দর্যে বাঙালির মন হয় মাতোয়ারা; এই সর্ববিস্তারী সৌন্দর্য বাঙালির মনকে করেছে কোমল, শুভবোধে উদ্দীপ্ত।

ঋতুভেদে রূপের বৈচিত্র্য : ষড়ঋতুর দেশ বাংলাদেশ। ঋতুর পালাবদলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রকৃতিতে ঘটে বর্ণময় রূপবদল । প্রতিটি ঋতু আসে আপন স্বাতন্ত্র্যে, অপরূপ রূপসজ্জায়। প্রতিটি ঋতুর রয়েছে নিজস্ব রং ও সৌন্দর্য। বঙ্গঋতুর রঙ্গশালায় প্রথম ঋতু গ্রীষ্ম। দুই চোখে ক্রুদ্ধ বহ্নিজ্বালা নিয়ে তার আবির্ভাব। প্রচণ্ড অগ্নিবাণে এ সময় বাংলার বুক বিদীর্ণ হয়; চৌচির হয়ে যায় এর তৃষ্ণার্ত প্রান্তর। নিদারুণ দহন যন্ত্রণায় কাতর হয় পাখ-পাখালি, জন্তু-জানোয়ার। চারিদিকে তখন কেবল ধূলিময় ধূসরতা। এরই মধ্যে কাল-বোশেখী ধেয়ে আসে সবকিছুকে লণ্ডভণ্ড করে দিতে। এই রাগী ঋতুও মধুময় হয়ে ওঠে আম, জাম,লিচু, কাঁঠাল, আনারসের রসে।

দহন-কাতর প্রকৃতির করুণ প্রার্থনায় সাড়া দিয়ে ‘শ্যাম-গম্ভীর সরসা' রূপে নবযৌবনা বর্ষা দিগ্বিজয়ী যোদ্ধার ন্যায় মেঘের পিঠে সওয়ার হয়ে বাংলার প্রকৃতির কোলে আসন পাতে। রৌদ্রদগ্ধ তৃষাতুর ধরণী বর্ষার অমৃতরসে অবগাহন করে প্রাণ- প্রাচুর্যে মেতে ওঠে, শ্যাম-স্নিগ্ধ হয়ে ওঠে রুক্ষ ধরণী। প্রকৃতির বিষণ্ন অঙ্গ থেকে গ্রীষ্মের অবসাদ মুছে দিয়ে সজল বর্ষা প্রকৃতিতে জাগায় নবপ্রাণের শিহরণ। শস্য শিশুরা জেগে ওঠে মাটির বুক ভেদ করে; কদম, জুঁই, হাসনাহেনার সৌরভে মুখরিত হয় বাংলার প্রকৃতি। খেয়ালি বর্ষা বাংলার প্লাবনের ঢল নামায়, অবিশ্রান্ত বর্ষণে মাঠ-ঘাট, নদীনালা কানায় ভরে ওঠে; দূর দিগন্ত থেকে মাথায় মেঘের বোঝা নিয়ে দুরন্ত গতিতে উন্মত্তের মতো ধেয়ে আসে ‘বাদল দিনের পাগলা হাওয়া' । প্রবল ক্রোধে যেন দুমড়ে-মুচড়ে দিতে চায় বাড়িঘর, গাছপালা। কখনো গভীর প্রশান্তিতে আকাশ থেকে ঝরে প্রবল মুষলধারা। নদীতে স্রোতের বান ডাকে; মত্ত স্রোত ঘরবাড়ি, গবাদি পশু, ফসল, রাস্তাঘাট সবকিছু ভাসিয়ে নেওয়ার প্রমত্ত খেলায় মেতে ওঠে। আবার কখনো বর্ষার কৃপণতা গ্রীষ্মের চণ্ডতাকেও হার মানাতে চায়। বাংলার ঋতুবলয়ে বর্ষাই প্রধানতম ঋতু; বাংলার শ্যামল প্রকৃতিতে আর কৃষি-নির্ভর অর্থনীতিতে এই ঋতুর সুগভীর প্রভাব। বাংলার প্রধানতম কবি রবীন্দ্রনাথের কবিতা-গানে-গল্পে কেবলি বর্ষা-প্রকৃতির বন্দনা :

“নীল নব ঘনে আষাঢ় গগনে তিল ঠাঁই আর নাহিরে ।
ওগো আজ তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে ।
বাদলের ধারা ঝরে ঝরঝর
আউশের ক্ষেত জলে ভরভর
কালিমাখা মেঘে ওপারে আঁধার ঘনায়েছে দেখ চাহিরে
ওগো আজ তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে।”

প্রকৃতিকে ধুয়ে-মুছে শুচি-স্নিগ্ধ কোমলতা দিয়ে বাংলার শ্যামল অঙ্গনে উপস্থিত হয় শরৎকাল। বর্ষার ঘন মেঘ ধীরে ধীরে হালকা হয়ে আসে, অলস মন্দ্র-মন্থর গতিতে আকাশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ঘুরে বেড়ায় ‘সাদা মেঘের ভেলা' । কোমল রোদের স্নিগ্ধ আভায় ঝলমল করে ওঠে প্রকৃতি। কাশফুলের শুভ্রতা প্রকৃতিতে শান্তির পরশ বুলিয়ে দেয়; শিউলি ফুলের সৌরভে মন যায় উদাস হয়ে। শরতের সকালে কচি ঘাসের ডগায় মুক্তো দানার মতো শিশির ঝলমল করে ওঠে শারদ শোভায় মোহিত কবি তাই আপন মনে গেয়ে উঠেন —

“আজিকে তোমার মধুর মুরতি হেরিনু শারদ প্রভাতে
হে মাতঃ বঙ্গ শ্যামল অঙ্গ
ঝলিছে অমল শোভাতে।”

অমল ধবল শরতের পেছনে পেছনে প্রকৃতিকে সোনার রঙে রাঙিয়ে বাংলার রূপময় মঞ্চে আবির্ভূত হয় হিমের চাদর গায়ে- মোড়ানো হেমন্ত। ধান কাটার ধুম পড়ে যায় মাঠে মাঠে। ধান কাটা শেষ হলে প্রকৃতিতে যেন ছড়িয়ে থাকে বৈরাগ্যের বিষণ্ণতা। ইতোমধ্যে অবশ্য মাথা তুলে দাঁড়াতে শুরু করে দেয় শীতের সবজির কচি পাতা। ঘরে ঘরে তখন নবান্নের উৎসব। আবহমান বাংলার মানুষের কাছে এটিই সবচেয়ে সুখের সময়।

পিঠার গন্ধ পেয়েই যেন বাংলার প্রকৃতিতে হাজির হয় শীতের হিমবুড়ি। খেজুরের রসে বাঙালির পিঠা-উৎসব পূর্ণতা পায় এ সময় । শীতের কুয়াশায় ঢেকে যায় সকালের সূর্য। শীতের তীব্রতায় মানুষ জবুথবু হয়ে যায়, কাপড়ের ওপর কাপড় জড়িয়ে মানুষ শীত নিবারণের চেষ্টা চালায়। দরিদ্র মানুষেরা কাপড়ের অভাবে কষ্ট পায়। শীতের প্রকোপে গাছে গাছে চলে পাতা ঝরার পালা। গাছগুলো যেন নিজেদের মৃত ঘোষণা করে দেয়। তবে শীতকালে সবজির বিপুল সমারোহ ঘটে। গাঁদা, গোলাপ— এমনি সব বাহারি ফুলে নিষ্প্রাণ প্রকৃতিও রঙিন হয়ে ওঠে ।

শীতের তীব্রতা কমতেই আড়মোড়া দিয়ে জেগে ওঠে প্রকৃতি, মৃতবৎ গাছগুলোর নিষ্পত্র শাখাগুলো রাতারাতি পত্রপুষ্পে মঞ্জুরিত হয়ে ওঠে। ঋতুমঞ্চে আগমন ঘটে মহারাজ বসন্তের। দখিনা মৃদুমন্দ বাতাসের সঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে ফুষ্পের সৌরভ, অলিকুলের গুঞ্জরণে আর উদাস দুপুরে কোকিলের কুহুতানে মন মাতোয়ারা হয়ে ওঠে। বসন্ত-প্রকৃতির রূপে মুগ্ধ কবি তাই গেয়ে ওঠেন—

“ওগো দখিনা মলয়, আজি তব পরশনে,
কার কথা পড়ে মনে ৷
মধূপ হয়েছে আজি পাগল পারা
কুসুমে কুসুমে তাই জেগেছে সাড়া।”

উপসংহার : রূপের বৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ বাংলাদেশ যেন কোনো এক রূপদক্ষ শিল্পীর আঁকা এক অসাধারণ শিল্প-প্রতিমা; শিল্পীর তুলির আঁচড়ে শিল্পীর মনোভূমির নির্যাস থেকে যেন গড়ে উঠেছে এই রূপময় বাংলাদেশ। তাই মুগ্ধ কবি বাংলার গর্বিত পরিচয় তুলে ধরেন এভাবে—

“এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি,
সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি।”
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url