বাংলা রচনা : একটি নির্জন দুপুর

একটি নির্জন দুপুর

একটি নির্জন দুপুর

ভূমিকা : চব্বিশ ঘণ্টার সমন্বয়ে যে একটি পূর্ণাঙ্গ দিন, তার মধ্যে 'দুপুর' বা 'মধ্যাহ্ন' একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য দাবি করে বাংলাদেশের দুপুরগুলো রৌদ্রদগ্ধ, স্তব্ধ ও নিবিড়। এ সময় সাধারণত আকাশ থাকে মেঘমুক্ত। এ মেঘমুক্ত আকাশ উত্তপ্ত, রৌদ্র-ধৃধ প্রান্তর। সেই প্রান্তরে সূর্যের প্রখর তাপ নিক্ষিপ্ত হয়ে সৃষ্টি করে জ্বালাময় দীপ্তি। দুপুরের অলস-ক্লান্ত রৌদ্র যেন তার অলস-অবসন্ন দেহখানি এলিয়ে দিয়ে বিশ্রামে রত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘যেতে নাহি দিব' কবিতার সূত্র ধরে বলতে হয়, 'বসুমাতা যেন রৌদ্র পোহাচ্ছেন অলস দেহে।' দুপুরের এ তপ্ত-দাহনে প্রয়োজন অবিচ্ছিন্ন বিশ্রাম।

নির্জন দুপুরের গ্রাম : নির্জন দুপুরে পল্লিপ্রান্তও যেন ধূধূ অভিব্যক্তিতে নিমগ্ন থাকে। অন্তর্হিত হয় তার স্নিগ্ধ ছায়া-ঘেরা অপরূপ শ্যামলিমা। রাত্রির নিঝুম নিস্তব্ধতা পেয়ে বসে বাংলাদেশের গ্রামগুলোকে। সেগুলোও যেন মানুষের মতো হয়ে ওঠে তন্দ্ৰামগ্ন। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত কর্মক্লান্ত মানুষের ন্যায় গ্রামীণ প্রকৃতিও থাকে বিশ্রামরত। এমনকি, যে বাতাস স্নিগ্ধ পরশ বুলায় মানুষের দেহ ও মনে, সে বাতাসও নির্জন দুপুরে হয়ে পড়ে নিঃঝুম, নিস্তব্ধ ও মন্থর। যেন বাতাসের গায়েও লাগে মধ্যাহ্নের এক অদ্ভুত তন্দ্রা- বিজড়িত অবসাদ। তবে বাতাসের সে তন্দ্রা হঠাৎ হঠাৎ ভেঙে গিয়ে গাছের শাখাগুলোকে একটুখানি নাড়া দিয়ে যায়, দুলে ওঠে গাছের শাখাগুলো। যেন একটুখানি স্নিগ্ধ হাসি ছড়িয়ে দেয় প্রকৃতিতে। স্বাভাবিক অবস্থায় বাতাস তার দুরন্তপনায় শুকনো পাতাগুলোকে উড়িয়ে নিয়ে যায়, যেন খেলা করে তাদের সাথে, কিন্তু নির্জন দুপুরে বাতাসের সেই দুরন্তপনা কোথায় যেন হারিয়ে যায়। সে হয়ে পড়ে অলস ও স্থবির। তার বিষাদময় হাহাকার দীর্ঘশ্বাসের মতো ছড়িয়ে পড়ে সারা গ্রামে। বাতাসের করুণ রাগিণী মধ্যাহ্ন-প্রকৃতিতে মিশে হয়ে ওঠে বিষাদক্লান্ত।

নির্জন দুপুরে প্রাণিকুল : নির্জন দুপুরে মানুষের মতো প্রাণিকুলও থাকে অবসাদগ্রস্ত ও বিশ্রামরত। গবাদিপশু দুপুরের আহারাদি সেরে গাছের ছায়ায় বসে জাবর কাটে, সময় কাটায় অলসভাবে। সকাল থেকে হয়তো কৃষকের জমিতে কাজ করে ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত। তাই দুপুরের এই বিশ্রাম। হাঁস-মুরগিগুলোও ঝিমুতে থাকে ছায়ায় বসে। পাখিগুলো গাছের শাখায় বসে থাকে চুপচাপ। মালিকহীন পথের কুকুরগুলো অনাবশ্যক ছুটাছুটি বাদ দিয়ে লেজ গুটিয়ে বসে থাকে কোনো গাছের গোড়ায় অথবা ঘরের ছায়ায়।

রীতি মানুষের অবস্থা নির্জন দুপুরে : এ সময় গ্রামবাংলার কুটিরে কুটিরে দ্বারগুলো থাকে রুদ্ধ। শ্রান্ত কৃষক তার ক্ষেত্রের কাজ শেষ করে দুপুরের আহার সম্পন্ন করে ঘরে বা ঘরের সামনের মাচায় শুয়ে বসে একটুখানি বিশ্রাম গ্রহণ করে । খেয়াঘাটে নৌকা বেঁধে মাঝি চলে যায় নিজ নিজ গৃহে। কারিগর বা কর্মজীবী মানুষেরা তাদের কর্মক্ষেত্রেই একটুখানি বিশ্রাম নেয়। বলতে গেলে নির্জন মধ্যাহ্ন মানুষের কর্মব্যস্ত জীবনে নিয়ে আসে বিশ্রামের আহ্বান । বয়স্ক ও প্রবীণরা হাতে পাখা নিয়ে বসে থাকেন খোলানের মাচায়। 

এর প্রকৃতিজগৎ : নির্জন দুপুরে তাপদগ্ধ গাছের পাতাগুলো হয়ে ওঠে ধূসর ও বিবর্ণ। প্রকৃতির রূপ-রস-গন্ধ-শ্যামলিমা হারিয়ে যায় কোন সুদূরে, শুকিয়ে যায় প্রকৃতির প্রাণরস । প্রকৃতির সৌন্দর্য পাখির ডাক শোনা যায় না এ সময়। দু'একটা কাকের কর্কশ ধ্বনি আর্তনাদের মতো থেমে থেমে ভেসে আসে তপ্ত মধ্যাহ্নে। ঘুঘুর ডাক শোনা যায়। কিন্তু সে ডাকে প্রাণের উল্লাস থাকে না, থাকে ক্লান্তির অবসাদ। দূর কোনো মাঠের প্রান্ত থেকে রাখালিয়া বাঁশির সুর হয়তো ভেসে আসে, কিন্তু তাতেও থাকে বিষাদ ও হতাশার করুণ সুর। 

ভাবুক মনের স্মৃতিচারণ : ভাবুক মনের অধিকারী মানুষেরা নির্জন দুপুরে স্বপ্নের জাল বুনেন কোনো মুক্ত বাতায়নপাশে বসে। তাদের মনের দুয়ারে এসে বাসা বাঁধে অনাগত বা অধিগত দিনের স্মৃতি। তারা নিজেদের মগ্ন রাখেন কল্পলোকের স্বপ্নময় জগতে। 

গ্রাম্যবধূ : গ্রামের নদী ও পুকুরগুলোও এ সময় থাকে উষ্ণ, তপ্ত ও স্তব্ধ। গ্রাম্যবধূ গায়ে গামছা বা চাদর জড়িয়ে এ সময় যায় পুকুরে বা নদীতে গোসল করতে। তাদের আসা-যাওয়ার পথে যে অশ্বত্থ, জারুল, কড়ই বা বাঁশ বাগান পড়ে, তার রৌদ্রকরোজ্জ্বল আবেশে থাকে উষ্ণ শ্বাস। দূরের কোনো পাখি হয়তো ডেকে ওঠে ‘জলকে চল’ । অবগুণ্ঠনবতী গ্রাম্যবধূ সেই ডাকে চমকে ওঠে এদিক সেদিক দৃষ্টি ছড়িয়ে দেয়। কিন্তু তপ্ত-নিদাঘ দুপুরের সেই নিষ্করুণ প্রহরে তার সেই দৃষ্টি বিবর্ণ হয়ে ফিরে আসে ।

উপসংহার : এক সময় নির্জন দুপুরের সেই স্তব্ধতা কেটে যায়। সূর্য হেলে পড়ে পশ্চিমাকাশে। পশ্চিমের ছায়া হয় দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর। সহসা মাথার ওপর নিস্তব্ধতার অচলায়তন ভেঙে ডেকে ওঠে কোনো শঙ্খচিল। বকুল গাছের ডালে উড়ে এসে বসে কোনো কোকিল, দোয়েল বা ঘুঘু পাখি । গ্রামের পথে বেরিয়ে পড়ে বিশ্রাম শেষ করা কৃষক; হেঁটে চলে হাটের পথে, গঞ্জের পথে। ধীরে ধীরে মধ্যাহ্নের জড়তা ছিন্নভিন্ন করে আবার ছড়িয়ে পড়ে গ্রামের সমস্ত চঞ্চলতা। বস্তুত সকাল, সন্ধ্যা এবং জ্যোৎস্নার যেমন আলাদা সৌন্দর্য থাকে তেমনি নির্জন দুপুরেরও রয়েছে স্বতন্ত্র সৌন্দর্য। এ সৌন্দর্য তন্দ্রা ও মদালসায় মাধুর্যপূর্ণ।

Previous Post