নজরুল জন্ম শতবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে একটি ভাষণ রচনা কর

নজরুল জন্ম শতবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে একটি ভাষণ রচনা কর

নজরুল জন্ম শতবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে একটি ভাষণ রচনা কর।

সম্মানিত সভাপতি, আমন্ত্রিত সুধীবৃন্দ এবং প্রিয় দর্শক-শ্রোতা

যুগস্রষ্টা কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম শতবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে আয়োজিত এই মহতী সভায় কিছু বলার সুযোগ পেয়ে, নিজেকে ধন্য মনে করছি। নজরুল আমাদের জাতীয় কবি, বিদ্রোহী কবি, সাম্যের কবি। বাংলার গণমানুষের প্রিয় কবি নজরুল। তাঁর সমস্ত জীবনই সংগ্রামের খতিয়ান। শৈশবেই তিনি পিতাকে হারান। তারপর সংসারের দায়-দায়িত্ব তাঁর স্কন্ধেই অর্পিত হয়। বালক নজরুলকে তাই মাজারের খাদেম হতে হয়, মসজিদের ইমাম হতে হয়। একদিন এসব ফেলে তিনি যোগ দেন লেটো দলে। সেখানে তিনি গান লিখতেন, গান গাইতেন। এতে করে সামান্য কিছু পয়সাও তিনি পেতেন। কিন্তু একদিন লেটো দল ফেলে চলে আসেন আসানসোলে। সেখানে এক রুটির দোকানে তিনি চাকরি নেন। সেই দোকানে চা খেতে যেতেন ময়মনসিংহ নিবাসী পুলিশ অফিসার রফিজুল্লাহ। চটপটে কিশোর নজরুলকে দেখে তাঁর ভালো লেগে যায়। তিনি নজরুলকে এনে ভর্তি করে দেন ত্রিশালের দরিরামপুর হাই স্কুলে। এখান থেকেই শুরু হয় নজরুলের নতুন জীবন। কিন্তু বাউণ্ডেলে নজরুল নবম শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় ত্রিশাল ছেড়ে চলে যান। তবুও লেখাপড়ায় তাঁর তখনো ছেদ ঘটেনি। পরে তিনি পশ্চিমবঙ্গের এক বিদ্যালয় থেকে যখন এন্ট্রান্স পরীক্ষা দেয়ার জন্য তৈরি হচ্ছেন, তখন অকস্মাৎ পরীক্ষা ফেলে যুদ্ধে চলে যান। কলম আর বাঁশি ফেলে তিনি হাতে তুলে নেন বন্দুক। যুদ্ধ শেষে তিনি চলে আসেন হাবিলদার মেজর বেশে। কিন্তু সত্যিকার অর্থে তাঁর কলম কখনো থেমে থাকেনি। যুদ্ধের শিবিরেও তিনি লিখেছেন অসংখ্য কবিতা, গান, গল্প। যুদ্ধ ফেরত সৈনিক কবি পরে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নেন। মোহাম্মদ নাসিরুদ্দিনের ‘সওগাত' পত্রিকায় তিনি চাকরি নেন। সে সময় তাঁর কবিতা বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে। এভাবে তিনি দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করেন। তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘বিদ্রোহী' যখন প্রকাশিত হয় তখন তাঁর সুনাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এই কবিতার জন্য তিনি ব্রিটিশ শাসকদের রুদ্ররোষের শিকার হন। পরিণামে তাকে জেল খাটতে হয়। কিন্তু জেলের অন্ধ শেলে বসেও তিনি রচনা করেন, ‘শিকল পরা ছল মোদের এই শিকল পরা ছল/এই শিকল পরেই শিকল তোদের করবোরে বিকল।

নজরুলের লেখা ‘অগ্নিবীণা, ‘বিষের বাঁশী’, ‘ভাঙার গানদোলন চাপা’, ‘ছায়ানট’, ‘সিন্ধু হিল্লোল ইত্যাদি কাব্যগ্রন্থ হতাশায় নিমগ্ন বাঙালি জাতির বুকে নতুন আশার সঞ্চার করে। দিকভ্রষ্ট জাতিকে তিনিই দেখান পথের সন্ধান। জাতিতে জাতিতে বিদ্বেষ, হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গা তাঁকে আহত এবং পীড়িত করে। তিনি তাই উগ্র ধর্মান্ধতা আর ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে জানান তীব্র প্রতিবাদ। এজন্য তিনি হিন্দু এবং মুসলমান উভয় জাতির কাছেই নিন্দিত হয়েছিলেন। গোঁড়া মুসলমানরা তাঁকে কাফের আখ্যা দিয়েছিল। কিন্তু তিনি কাউকে পরওয়া করেননি। সত্য, সুন্দর এবং সাম্যের বাণী তিনি উচ্চকণ্ঠে উচ্চারণ করেছেন। সবার ঊর্ধ্বে তিনি মানুষকে ঠাঁই দিয়েছেন। তাইতো তিনি লিখেছেন, ‘গাহি সাম্যের গান, মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই নহে কিছু মহীয়ান।' সমাজে ধনী-গরীবের যে ব্যবধান, উঁচু-নিচুর যে ভেদাভেদ তা তাকে মর্মাহত করেছে। তাই তিনি প্রবল আক্রোশে ফেটে পড়েছেন বারবার। জ্বালাময়ী ভাষায় তিনি লিখেছেন, “তোমরা রহিবে তেতালার পর আমরা রহিব নিচে/ অথচ তোমাকে দেবতা বলিব সে ভরসা আজ মিছে।' সমাজের নির্যাতিত, নিপীড়িত, অবহেলিত মানুষের প্রতি নজরুলের যে প্রচণ্ড সমবেদনা ছিল, তা আমরা তাঁর কবিতার চরণে চরণে দেখতে পাই। তাঁর বিখ্যাত 'কুলি-মজুর' কবিতায় তিনি লিখেছেন —

‘সেদিন দেখিনু রেলে
কুলি বলে এক বাবুসাব, তারে ঠেলে দিল নিচে ফেলে । চোখ ফেটে এলো জল,
এমনি করে কি জগৎ জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল?’

যে নজরুলকে আমরা সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে দেখেছি, শোষক শ্রেণীর বিরুদ্ধে জ্বলে উঠতে দেখেছি, শাসকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে দেখেছি, সেই নজরুলকে প্রেমের কোমল স্পর্শে শিশুর মতো সরল হতেও দেখেছি। কড়ি ও কোমলের অপূর্ব মিশ্রণ ছিল তাঁর চরিত্রে। নজরুল নিজেই তাই স্বীকার করেছেন,
‘আমি ইন্দ্ৰানী সূত হাতে চাঁদ ভালে সূর্য
মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরি আর হাতে রণতূর্য।

কবি নজরুল যেসব কবিতা লিখেছেন, তাতে কেবল জাগরণের বাণী ছিল তা নয়। শিল্প সুষমা, ছন্দ, উপমা, উৎপ্রেক্ষার দিক থেকেও এসব কবিতা অত্যন্ত উঁচুমানের। শুধু ভারতীয় মিথ নয় সারা পৃথিবীর মিথ সম্পর্কে তাঁর ভালো ধারণা ছিল। তিনি প্রথম বাংলা সাহিত্যে ভারতীয় পুরাণের সঙ্গে পশ্চিম এশিয়ার ইতিহাস ঐতিহ্যের মিশ্রণ ঘটিয়েছিলেন। তিনি ফারসি ভাষাতেও পাণ্ডিত্য অর্জন করেছিলেন। তাঁর কবিতায় আমরা তাই বিভিন্ন ভাষার অপূর্ব সমাহার দেখতে পাই। তাঁর কবিতায় ইংরেজি শব্দের ব্যবহারও ছিল অপূর্ব। যেমন—

‘আনকোরা যত নন ভায়োলেন্ট
ননকোর দল নন খুশি,
ভায়োলেন্সের ভায়োলিন নাকি আমি
এটা বিপ্লবী মন তুষি।’

নারী-পুরুষের যে ভেদাভেদ, —তার বিরুদ্ধেও নজরুল ছিলেন সোচ্চার। নারী-পুরুষের পারস্পরিক সম্পর্ক, তাদের মিলনই যে পৃথিবীকে সুন্দর করতে পারে এই শাশ্বত বাণী তিনি উচ্চারণ করেছেন তার কবিতায়। কবি লিখেছেন—

‘এ বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি, চির কল্যাণকর। 
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর। 
তাজমহলের পাথর দেখেছ, দেখিয়াছ তার প্রাণ
ভিতরেতে তার মমতাজ নারী বাহিরেতে শাজাহান।

রবীন্দ্র বলয় থেকে মুক্ত হয়ে কাজী নজরুল ইসলাম এক নতুন ভুবন গড়ে তুলেছিলেন। তিনি লিখে গেছেন অসংখ্য গান। এই সব গানে তিনি নিজেই সুরারোপ করেছেন। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের নানান নান্দনিক ছলাকলাকে আয়ত্ত করে তিনি যে সুর লহরী সৃষ্টি করেছেন তা অনন্য এবং অসাধারণ। কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাইতো নজরুল সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘নজরুল গানের রাজা। গানের জন্যই নজরুল আজীবন বেঁচে থাকবেন।

আজ সারাদেশব্যাপী জাতীয়ভাবে নজরুল জন্ম শতবার্ষিকী উদ্যাপিত হচ্ছে। এটা অত্যন্ত সুখের কথা। তুলনামূলকভাবে নজরুলের কবিতা বিদেশি ভাষায় কম অনুদিত হয়েছে। আজ আমাদের দায়িত্ব এবং কর্তব্য নজরুলের কবিতাকে বিদেশি ভাষায় অনুবাদের ব্যবস্থা করা। তাঁর কবিতা বিদেশি ভাষায় বেশি বেশি অনুবাদ হলেই বিশ্বের মানুষ জানতে পারবে তিনি কত বড় কবি এবং কত উঁচু মাপের মানুষ ছিলেন। বাঙালি হিসেবে আমাদের দায়িত্ব নজরুলকে বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরা এবং তাঁর আদর্শকে অনুকরণ করা। এই মহান কবির বিদেহী আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আমি আমার বক্তব্য শেষ করছি। সবাইকে ধন্যবাদ। খোদা হাফেজ।
Next Post Previous Post