বাংলা রচনা : বাংলাদেশের নারী

বাংলাদেশের নারী

বাংলাদেশের নারী

[ রচনা সংকেত : ভূমিকা, নারীর আর্থ-সামাজিক অবস্থা, নারী নির্যাতন, নারী মুক্তি আন্দোলন, নারীর ক্ষমতায়ন,উপসংহার । ]

ভূমিকা : বাংলাদেশের জনসংখ্যার অর্ধেকই নারী। অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে বিচ্ছিন্ন রেখে কোনো দেশের প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব নয়। বাংলাদেশের নারীরা পরিপূর্ণ মর্যাদা হতে বঞ্চিত। অতীতকাল হতেই আমাদের দেশের নারীরা নির্যাতিত, নিপীড়িত ও বঞ্চিত। নারী সমাজ দেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সন্তান জন্মদান থেকে শুরু করে ঘরে-বাইরের অনেক কাজই নারীকে সামলাতে হয়। এখন পুরুষের পাশাপাশি নারীকেও কঠিন কর্তব্য সম্পাদনে ও দায়িত্ব পালনে অংশগ্রহণ করতে দেখা যাচ্ছে। পুরুষের অর্ধাঙ্গিনী হিসেবে তাদের সমপর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে নারীরা। অর্ধেক জনশক্তির প্রতিনিধি হিসেবে নারী তার পূর্ণ অধিকারের দাবিদার।

নারীর আর্থ-সামাজিক অবস্থা : বাংলাদেশে পুরুষ ও নারীর অনুপাত ১০৬ : ১০০। মোট জনসংখ্যার অর্ধেক হওয়া সত্ত্বেও নারীরা আজ বৈষম্যের শিকার। আমাদের দেশের প্রচলিত সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনুশাসনের জালে আবদ্ধ নারীসমাজ। এ দেশের আর্থ-সামাজিক পরিবেশে গোঁড়ামি, ধর্মীয় ফতোয়া প্রবল, ফলে নারী অধিকার হয় লঙ্ঘিত। সমাজে নারীকে মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করা হয় না। সন্তানহীনতার সম্পূর্ণ দোষ নারীর, অধিক সন্তান জন্মানোর দায়ভার নারীর, জন্মনিয়ন্ত্রণে নারীকেই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়। নারী অধিকার রক্ষা আইন রক্ষাকারী শক্তি হচ্ছে পুরুষের হাতে, ফলে পুরুষ তার আপন স্বার্থ রক্ষা করে সর্বত্র। তবে, বাঙালি নারীদের ক্ষেত্রে উন্নয়নের ছোঁয়া লাগতে শুরু হয়েছে। নারীরা আজ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছে। নারীরা এখন শিক্ষক, আইনজীবী, বিচারক, প্রশাসক, ডাক্তার, প্রকৌশলী, অর্থনীতিবিদ হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে সমর্থ হয়েছে। এক্ষেত্রে শহরের নারীরা গ্রাম্য নারীদের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে। গ্রাম্য নারীরা এখনও তেমনভাবে চার দেয়ালের বাইরে বের হতে পারেনি। তারা স্বামীর সংসারে মুখবুজে সব যন্ত্রণা সহ্য করে। শিক্ষাক্ষেত্রে এখনও আমাদের দেশের নারীদের মধ্যে গোঁড়ামি রয়েছে। পোশাক শিল্পের শ্রমিক হিসেবে নারীরা নতুন করে বাঁচার প্রেরণা পাচ্ছে। প্রায় দশ লক্ষ নারী শ্রমিক তাদের ভাগ্যের পরিবর্তনের জন্য এ শিল্পে নিয়োজিত। নারীদের একটি অংশ তাদের ভাগ্য পরিবর্তনে বদ্ধপরিকর। পরীক্ষার মেধা তালিকায় চোখ বুলালে দেখা যায় মেয়েদের প্রাধান্য। তারপরও সমাজে নারীকে যথাযথ মূল্যায়ন করা হয় না। চলার প্রতিটি পদক্ষেপেই নারী অসাম্যের মুখোমুখি হয়। বাবার সম্পত্তিতে ছেলে ও মেয়ের অসম অধিকার, পারিবারিক আইনে নারীর অসম অধিকার, যে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীকে উপেক্ষা-রাষ্ট্রের আয়নায় এখনও নারীর অমর্যাদার প্রতিচ্ছবিই তুলে ধরে।

নারী নির্যাতন : নারী নির্যাতন বাংলাদেশের অন্যতম সমস্যা। প্রতিদিন খবরের কাগজ খুললেই চোখে পড়ে নারী নির্যাতনের সংবাদ। নারী নির্যাতন আমাদের দেশে যেন নিয়মিত বিষয়ে পরিণত হয়েছে। অসংখ্য নারী প্রতিনিয়ত নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। পল্লী এলাকার নারীরা বেশি নির্যাতনের শিকার। স্বামীর আসনে আসীন পুরুষেরাই শুধু এদের নির্যাতন করে না। অনেক সময় শ্বশুর, দেবর কর্তৃকও তারা অত্যাচারের শিকার হয়। মজার ব্যাপার হলো, মাঝে মাঝে নারী কর্তৃক নারী নির্যাতন লক্ষ করা যায়। অনেক সময় শাশুড়ি, ননদ নামক মানুষেরা তাদের ছেলেবৌ বা ভাবীর ওপর নির্যাতন চালায়। বাংলাদেশের নারীদের একটি অংশ গৃহপরিচারিকার কাজ করে। অনেক সময় তাদের ওপর নেমে আসে অমানুষিক নির্যাতন। অনেক মেয়েদের গৃহকর্ত্রীর হাতে নিহত হতে দেখা যায়। বাংলাদেশের নারী নির্যাতনের মূলে রয়েছে অশিক্ষা। এদেশের নারীরা তেমন শিক্ষিত ও সচেতন নয়। তাই তারা তাদের অধিকার সম্বন্ধে অজ্ঞ। এ অজ্ঞতার সুযোগ নিয়েই পুরুষ শাসিত সমাজ তাদের ওপর নির্যাতন চালায়। অনেক শিক্ষিত নারীও নির্যাতনের শিকার হন। প্রতিবাদ করলে ব্যাপারটি প্রকাশ পেতে পারে, এ লজ্জায় তারা মুখ খুলতে চান না। যৌতুক সমাজের অন্যতম ব্যাধি। যৌতুক দিতে ব্যর্থ হওয়ায় অনেক নারীর জীবনে নেমে আসে দুর্বিষহ অন্ধকার। অনেক সময় যৌতুকের দাবি মেটানোর পরেও নির্যাতনের শিকার হতে হয় এ হতভাগী নারীদের। বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের নারীদের প্রতি ব্যাপক হারে এসিড নিক্ষিপ্ত হচ্ছে। এসিড নিক্ষেপ করে, ঝলসে দেয়া হচ্ছে নারীর শরীর। এসব নারীদের জীবন অকালেই ধ্বংস করে দিচ্ছে এক শ্রেণীর বখাটে যুবক। অর্থাৎ, নারী নির্যাতন বাংলাদেশে সামগ্রিক উন্নয়নে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

নারী মুক্তি আন্দোলন : অতীতের নারীদের তুলনায় বর্তমানে আমাদের দেশের নারীরা সচেতন। এককালে বাংলাদেশের নারীরা ঘরের বাইরে বের হতে পারত না। তারা ছিল চার দেয়ালের মধ্যে বন্দি। এখন সবক্ষেত্রেই নারীদের পদচারণা বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশের নারীদের প্রথম মুক্তির পথ দেখিয়েছেন একজন মহীয়সী নারী। এ মহীয়সী নারী বেগম রোকেয়া। তিনিই প্রথম নারীদের মধ্যে সচেতনতা আনতে চেষ্টা করেন। তাঁর লেখার মাধ্যমেই পরবর্তীতে নারী মুক্তি আন্দোলন সূচিত হয়। তিনি নারীদেরকে লেখনীর সাহায্যে বোঝাতে সক্ষম হন যে, অর্ধ মানবগোষ্ঠীরও পুরুষের পাশাপাশি বেঁচে থাকার অধিকার রয়েছে। নারী মুক্তি আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ কবি বেগম সুফিয়া কামাল। তিনি নারীর বন্ধনমুক্তি ও ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন। বাংলাদেশে অনেক নারী নেত্রী নারীদের মুক্তির লক্ষে কাজ করে যাচ্ছেন। এদেশে অনেক নারী সংগঠন গড়ে উঠেছে। নারীদের অধিকার সম্বন্ধে এসব সংগঠন অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। মানবাধিকার কর্মীরা নারী মুক্তির লক্ষে নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। যেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে সেখানেই তারা এগিয়ে যাচ্ছেন। নারীদের মুক্তি তাদের সচেতনতার ওপর নির্ভর করে। তারা যদি তাদের অধিকার সম্বন্ধে সচেতন না তাহলে এ আন্দোলন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে বাধ্য। নারীদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে। একমাত্র শিক্ষিত নারীই নিজ অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হতে পারে। নারী জাতি যদি সমাজকে বোঝাতে সক্ষম হয় যে, এ সমাজে সমানভাবে বেঁচে থাকার অধিকার তাদেরও রয়েছে, তাহলেই নারী আন্দোলন সফলতার মুখ দেখবে। অবশ্য বাংলাদেশের নারীরা তাদের অধিকার অনেকটা আদায় করে নিতে সক্ষম হয়েছে।

নারীর ক্ষমতায়ন : নারীর ক্ষমতায়ন বলতে বোঝায় নারী স্বাধীনতা এবং সব ক্ষেত্রে অধিকার প্রতিষ্ঠা, বিশেষ করে ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা। নারীর ক্ষমতায়নের অর্থ হলো, সমাজের প্রতিটি স্তরে এমন একটি সুস্থ পরিবেশ থাকবে যেখানে নারী আপন মহিমায় স্বাধীন ও মর্যাদার অধিকারী হয়ে উঠবে। নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্য নির্যাতক ও শোষকের অবস্থান থেকে পুরুষকে মুক্ত করা। বিদ্যমান সমাজে পুরুষের দায়িত্বের পাশাপাশি নারীর দায়িত্ব প্রতিষ্ঠা, পুরুষের অধিকারের পাশাপাশি নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা। সমঅধিকার ও দায়িত্বের ভিত্তিতে পুরুষরা গৃহস্থালি ও সন্তান লালন-পালনে সমানভাবে অংশগ্রহণ করবে। পাশাপাশি নারীরাও পুরুষের দায়িত্ব পালনে সমানভাবে অংশ নেবে। নারীর ক্ষমতায়ন বলতে দেশের জনসংখ্যার শতকরা ৫০ ভাগ যে নারী তাদের সঠিক ক্ষমতায়নকে বোঝায়। সমাজে প্রচলিত মূল্যবোধ নারীকে পুরুষের অধস্তন করে রাখে। প্রচলিত আইনও পুরোপুরি নারীর পক্ষে নয়। যৌতুক, মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন, ধর্ষণ, এসিড নিক্ষেপ প্রভৃতি অপরাধে শাস্তির বিধান থাকলেও আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে যায় অপরাধী। আজও গ্রামবাংলার বহু নারী রক্ষণশীল ধর্মীয় মনোভাবাপন্ন কিছু লোকের ফতোয়ার শিকার। এটি নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে একটি বড় বাধা। নারীর ক্ষমতায়নে সরকারসহ সাধারণ লোকদের উদার মানসিকতা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের সমাজ যতদিন না হীন মনমানসিকতার ঊর্ধ্বে উঠতে পারবে, ততদিনে নারীর প্রকৃত ক্ষমতায়ন সম্ভব নয়। নারীর ক্ষমতায়নে কিছু বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। নারীর স্বার্থ রক্ষাকারী আইন প্রবর্তন, শিক্ষার ব্যাপক সুযোগ ও রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ, প্রচার মাধ্যমগুলোতে নারীকে সম্মানজনকভাবে উপস্থাপন, নারীর কাজের স্বীকৃতি, রক্ষণশীল মানসিকতার পরিবর্তন ইত্যাদি ইতিবাচক পদক্ষেপের মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়ন সম্ভব। সম্প্রতি সরকারি আদেশবলে বাবার নামের পাশাপাশি মায়ের নাম লেখার বিধান চালু হয়েছে। এটি নারীর ক্ষমতায়নে একটি বাস্তবমুখী সরকারি পদক্ষেপ।

উপসংহার : বাংলাদেশের নারীরা আমাদেরই মাতা, আমাদেরই ভগিনী, আমাদেরই কন্যা। তাদের অযত্নে, অবহেলায় রাখা আমাদের দায়িত্ব হতে পারে না। দেশের মোট জনগোষ্ঠীর অর্ধেককে আলাদা করে কোনো দেশ উন্নত হতে পারে না। বাংলাদেশের নারীরা আজ পদে পদে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। এ নির্যাতন বন্ধ হওয়া দরকার। নারী ও পুরুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি না করে সবাইকে মানুষ হিসেবে গণ্য করা উচিত। বাংলাদেশের নারীরা তাদের মেধা ও মননশীলতা দিয়ে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে; তারা গড়ে তুলতে পারে একটি আদর্শ বাসভূমি। একবিংশ শতাব্দীর সূচনালগ্নে নারীকে হতে হবে আত্মপ্রত্যয়ী, হতে হবে সচেতন। বাংলাদেশের নারীরা পুরুষের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে গড়ে তুলবে এক স্বপ্নের বাংলাদেশ, যে বাংলাদেশের স্বপ্ন বাঙালি জাতি তার মানসলোকে লালন করছে ।
Next Post Previous Post