বাংলা রচনা : ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ

ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ

ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ


[ সংকেত : সূচনা; জন্ম ও বংশ পরিচয়; বাল্যকাল; শিক্ষাজীবন; কর্মজীবন; জ্ঞান-তাপস; সাহিত্যচর্চা; উপসংহার ।]

সূচনা : যাঁদের বিস্ময়কর অবদানে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিশেষভাবে সমৃদ্ধ হয়েছে তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ । বাংলা সাহিত্যে তাঁর মতো পণ্ডিত ব্যক্তি খুঁজে পাওয়া বিরল । মুহম্মদ শহীদুল্লাহ জ্ঞানের গভীরতা ও বিস্তৃতির কথা চিন্তা করলে সত্যিই অবাক হতে হয় । এজন্যই বিশিষ্ট ভাষাপণ্ডিত ও সুসাহিত্যিক ড. মুহম্মদ এনামুল হক তাঁকে ‘একটি চলিষ্ণু প্রাচ্যবিদ্যাকল্পদ্রুম' বলে আখ্যায়িত করেছেন ।

জন্ম ও বংশ পরিচয় : ১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দের ১০ জুলাই পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলার অন্তর্গত পেয়ারা গ্রামে এক ঐতিহ্যবাহী পরিবারে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ জন্মগ্রহণ করেন । তাঁর পিতা মুন্সী মফিজুদ্দিন আহমদ সাহেব আদর্শ চরিত্রের ধার্মিক পুরুষ ছিলেন। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সবসময় হাসি-খুশি থাকতেন বলে ছেলেবেলায় তাঁকে সবাই সদানন্দ বলে ডাকতো । তিনি অত্যন্ত সদালাপী এবং সদাচারী ছিলেন । এ কারণে তিনি সকলের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা লাভ করেছেন ।

বাল্যকাল : ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ছিলেন অত্যন্ত বুদ্ধিমান ও দূরদর্শী । ছেলেবেলার নানা কাজ-কর্মের মধ্যেও তাঁর বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পাওয়া যায় । তখন তিনি হাওড়া জেলা স্কুলের ছাত্র । বালক শহীদুল্লাহ্ যদিও বয়সের তুলনায় ছিলেন কিছুটা বেঁটে কিন্তু বরাবরই তিনি ছিলেন সুস্বাস্থ্যের অধিকারী । একবার কী কারণে একই ক্লাসের কয়েকটি ছেলেকে ধরে তিনি বেদম মারধর করেন । আর যায় কোথায়? তাঁর বিরুদ্ধে শিক্ষক মহোদয়ের কাছে নালিশ করা হলো।
পরদিন তিনি ক্লাসে ঢুকতেই ছেলেরা হইচই করে উঠল। ভীষণ কিম্ভূতকিমাকার দেখাচ্ছিল তাঁকে । একী পোশাক পরেছেন তিনি! এমনিতেই মোটাসোটা তার ওপর আবার অদ্ভুত বেশভূষা । সমস্ত শরীরে শাড়ি পেঁচিয়ে ইয়া লম্বা একটা কোট পরেছেন । শিক্ষক তাঁকে ডেকে পাঠান নির্দিষ্ট একটি কক্ষে— যেখানে তিনি বেত নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন। দুরু দুরু বক্ষে শহীদুল্লাহ্ ঘরে ঢুকলেন । শিক্ষক তাঁকে গত দিনের মারামারি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন। কিন্তু শহীদুল্লাহ মুখে টু-শব্দটি নেই। শেষে রেগে-মেগে শিক্ষক যেই তাঁকে কোট ধরে টান মারলেন অমনি বেরিয়ে পড়লো শাড়ি। শিক্ষক এসব দেখে তো অবাক । তিনি শহীদুল্লাহ বুদ্ধির তারিফ না করে পারলেন না। তিনি মুচকি হেসে বললেন, ‘বেতের ভয়েই এসব পরে আসা, না? মাথায় এত বুদ্ধি'! শিক্ষক তাঁকে কিছু উপদেশ দিয়ে ছেড়ে দিলেন।

শিক্ষাজীবন : হাওড়া জেলা স্কুল থেকে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ১৯০৪ খ্রিষ্টাব্দে এন্ট্রান্স পাশ করেন। তিনি কলকাতার প্রেসিডেন্সী কলেজ ও হুগলী কলেজের ছাত্র ছিলেন। মাঝখানে অল্প কিছুকাল তিনি যশোর জেলা স্কুলে শিক্ষকতা করেন। তিনি যখন কলকাতা . হলেন । ক্লাস থেকে শহীদুল্লাহকে বের করে দেওয়া হলো । পণ্ডিতের অনুদারতা ও সংকীর্ণতায় তখনকার দিনের প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃতে এমএ পড়তে যান তখন ঘটে এক মহাবিভ্রাট । একজন হিন্দু পণ্ডিত তাঁকে বেদের ক্লাসে দেখতে পেয়ে বিরক্ত সুরেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায় ক্ষুব্ধ হয়ে লেখেন, “The Pandits should be thrown into the holy water of the Ganges.' অর্থাৎ ওসব পণ্ডিতদের গঙ্গার পবিত্র জলে ফেলে দেওয়া উচিত । শহীদুল্লাহ্ সংস্কৃত ছেড়ে দিয়ে তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন । সংস্কৃতে এমএ পড়তে না পারলেও প্রবল ইচ্ছাশক্তি ও অধ্যবসায়ের বলে তিনি এ ভাষায় যথেষ্ট পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। ১৯১৪
খ্রিষ্টাব্দে তিনি আইন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন ।

কর্মজীবন : কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তখনকার উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের অনুরোধে তিনি উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার অধ্যাপক ডক্টর দীনেশচন্দ্র সেন-এর সহকারী গবেষকের পদে নিযুক্ত হন । ১৯২১ সালে তাঁকে আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত এবং বাংলা ভাষার অধ্যাপক হিসেবে দেখতে পাই। জ্ঞানার্জনের অদম্য স্পৃহা তাঁকে প্রথমে প্যারিস এবং পরে বার্লিনে যেতে উদ্বুদ্ধ করে । ১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি প্যারিসের সোরবন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন এবং পরে ধ্বনিতত্ত্বের ওপর গবেষণামূলক প্রবন্ধ লিখে ডিপ্লোমা অর্জন করেন ।

জ্ঞান-তাপস : এ যুগের শ্রেষ্ঠ জ্ঞান-তাপস মনীষী শহীদুল্লাহ । পড়াশুনায় তাঁর গভীর মনোযোগ সম্পর্কে বহু মজার মজার গল্প প্রচলিত রয়েছে । একদিন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে বসে তন্ময় হয়ে পড়ছিলেন । কখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে এবং অন্যান্য পাঠকেরা উঠে গেছে সেদিকে তাঁর খেয়ালই নেই। গ্রন্থাগারের দরজা-জানালা বন্ধ করে কর্মচারীরাও বেরিয়ে গেছে । যখন টের পেলেন তখন তিনি জানালার ফাঁক দিয়ে অনেক ডাকাডাকি করে সে যাত্রা রক্ষা পান। বই পড়ায় তিনি পেতেন গভীর আনন্দ । যখনই বই পড়তে বসতেন তখন অন্যকিছুর কথা খেয়াল থাকত না ।

সাহিত্যচর্চা : প্রায় অর্ধ-শতাব্দী ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ নিরবচ্ছিন্নভাবে জ্ঞানচর্চা করে গেছেন । তাঁর অমূল্য দানে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিভিন্ন দিক বিশেষভাবে সমৃদ্ধ হয়েছে। তাঁর রচিত ও সম্পাদিত মূল্যবান গবেষণামূলক গ্রন্থগুলোর মধ্যে 'বাঙালা সাহিত্যের কথা’, ‘বাঙ্গালা ভাষার ইতিবৃত্ত' ‘পূর্ব পাকিস্তানের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান’, ‘বিদ্যাপতি শতক’, ‘পদ্মাবতী’, ‘বাঙ্গালা ব্যাকরণ’, ‘আমাদের সমস্যা' ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । এছাড়া তাঁর বহু মূল্যবান প্রবন্ধ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে । অনুবাদেও তিনি যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দেন । হাফিজ, ওমর খৈয়াম, ইকবাল প্রমুখ বড়ো বড়ো কবির কবিতা অনুবাদ করেও তিনি বাংলা সাহিত্যের ঐশ্বর্য বৃদ্ধি করেন । বহু ভাষাবিদ পণ্ডিত মুহম্মদ শহীদুল্লাহ প্রাচীন বাংলা কবিতা চর্যাপদ ‘বৌদ্ধগান ও দোহা', আলাওলের পদ্মাবতী ইত্যাদি সম্পাদনা করেন ।

উপসংহার : ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ রোগাক্রান্ত হয়ে পড়েন । সুদীর্ঘ আড়াই বছরকাল অসুস্থ থেকে এ মনীষী, ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ জুলাই রবিবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন । তাঁর মৃত্যুতে একটি যুগের অবসান ঘটে ।
Next Post Previous Post