বাংলা রচনা : চরিত্র

চরিত্র

চরিত্র

ভূমিকা : চরিত্র মানবজীবনের মহিমা। মানুষের সমস্ত মানবিক গুণাবলির প্রতিফলন ঘটে চরিত্রে। তা তাকে পাশবিক আচরণ ও বৈশিষ্ট্য থেকে পৃথক করে। চরিত্র অনুযায়ী গড়ে ওঠে মানুষের ব্যক্তিজীবন। তার প্রভাব পড়ে তার চিন্তা ও কর্মে। ফলত তা প্রভাবিত করে তার চারপাশের পরিবেশ ও সমাজজীবনকে। 

চরিত্র কী : ব্যক্তির আচরণ ও আদর্শগত বৈশিষ্ট্যের নাম চরিত্র। সূক্ষ্মভাবে দেখলে মানুষের চরিত্রের রয়েছে দুই বিপরীত বৈশিষ্ট্য কেউ সচ্চরিত্র, কেউ দুশ্চরিত্র। যে মানুষের চরিত্র নানা মহৎ ও সৎগুণের আধার, তিনি সচ্চরিত্র। আর কারও চরিত্র লুকানাে পশুত্বের আধার হলে সেই চরিত্রই দুশ্চরিত্র। যিনি সৎ চরিত্রের অধিকারী তিনি সমাজের শ্রেষ্ঠ অলংকার। চরিত্রকে জীবনের মুকুট বলা হয়। মুকুট যেমন সম্রাটের শােভা বর্ধন করে, তেমনি চরিত্রও মানবজীবনের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে। সততা, নীতিনিষ্ঠা, ন্যায়পরায়ণতা, সহৃদয়তা, সংবেদনশীলতা, ক্ষমা, উদারতা, ধৈর্য, কর্তব্যপরায়ণতা, গুরুজনে ভক্তি, মানবিকতা ও আত্মসংযম ইত্যাদি সচ্চরিত্রের লক্ষণ। যিনি চরিত্রবান তিনি কখনও ন্যায়, নীতি, আদর্শ ও সত্য পথ থেকে বিচ্যুত হন না, দুর্নীতি ও অন্যায়কে প্রশ্রয় দেন না। তিনি সযত্নে ক্রোধ, অহংকার, রূঢ়তা ইত্যাদিকে পরিহার করেন। তিনি হন সত্যবাদী, সংযমী ও ন্যায়পরায়ণ । যাবতীয় মানবিক গুণাবলির বিকাশ ঘটে বলে চরিত্রবান মানুষ জাতির সম্পদ। 

চরিত্র গঠনের গুরুত্ব : মানুষের জীবনে চরিত্রের মূল্য ও গুরুত্ব অপরিসীম। কেবল চরিত্রের শক্তিতে মানুষ হয়ে উঠতে পারেন বিশ্ববরেণ্য ও চিরস্মরণীয়। কেবল চরিত্রের গুণে মানুষ অমর হতে পারে। মানবজীবনে চরিত্রের মহিমা সম্পর্কে ধারণা করা যায় একটি ইংরেজি সুভাষিত থেকে :

When money is lost nothing is lost, 
When health is lost something is lost,
When character is lost everything is lost.
 

তাই চরিত্রের বিকাশ সাধনই মানুষের লক্ষ্য হওয়া উচিত। চরিত্র-গঠনমূলক শিক্ষার লক্ষ্য শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য চরিত্র গঠন। তাই ব্যক্তির চারিত্রিক গুণাবলি বিকাশের লক্ষ্যে নিম্নলিখিত দিকগুলাে শিক্ষার ক্ষেত্রে গুরুত্ব পাওয়া প্রয়ােজন :

১। ন্যায়-নীতি, ধৈর্য, সাহস, সততা, সৌজন্য, কৃতজ্ঞতাবােধ ইত্যাদি সৎ ও মহৎ গুণাবলির বিকাশ ও লালন; 
২। শৃঙ্খলা, সময়ানুবর্তিতা, শিষ্টাচার ইত্যাদি আচার-আচরণ-অভ্যাস গঠন; 
৩। দেশপ্রেম, অসাম্প্রদায়িকতা, মানবপ্রেম ইত্যাদি সংগঠিত ভাবাবেশের পরিচর্যা; 
৪। হিংসা, বিদ্বেষ, কুটিলতা ইত্যাদি মন্দ প্রবৃত্তি দমন;
৫। ন্যায়বিচার, সম্প্রীতি-চেতনা, মানবকল্যাণ ইত্যাদি মানবিক গুণাবলিকে জীবনের চালিকাশক্তি হিসেবে গ্রহণ। 

চরিত্র গঠনে বাবা-মা, পাড়া-প্রতিবেশীর ভূমিকা ছাড়াও বয় স্কাউট, গার্লস গাইড, রেডক্রস ইত্যাদি সংগঠনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা গুরুত্বপূর্ণ। স্বেচ্ছা সংগঠনের মাধ্যমে মানুষ যৌথ কাজের গুরুত্ব ও আনন্দ অনুভব করতে পারে। 

চরিত্র গঠনের সাধনা : চরিত্র গঠনের জন্যে প্রত্যেকের নিজস্ব প্রচেষ্টা ও সাধনা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। চরিত্রবান হতে হলে লােভ-লালসা ও অসৎ প্রবৃত্তির নানা কুপ্রলােভন পরিহার করার শক্তি অর্জন করতে হয়। চরিত্রবান মানুষের জীবনাদর্শের আলােয় সুচরিত্র গঠনে এগিয়ে যেতে হয়। 

মহৎ চরিত্রের দৃষ্টান্ত : পৃথিবীতে যারা স্মরণীয়-বরণীয় হয়ে রয়েছেন তাঁরা ছিলেন সুন্দর, নির্মল ও পরিচ্ছন্ন চরিত্রের শক্তিতে বলীয়ান। কোনাে প্রলােভনই তাদের ন্যায় ও সত্যের পথ থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। এমনই চরিত্রের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত মহানবী হযরত মুহম্মদ (স:)। তিনি আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন অন্যায়, অসত্য ও পাপের বিরুদ্ধে। যুগে যুগে ইতিহাসের পাতায় যীশুখ্রিষ্ট, বুদ্ধ, নানকের মতাে আরও যেসব মহৎ ব্যক্তিত্ব আপন মহিমায় ভাস্বর তাঁরা সকলেই ছিলেন মানব্রতী, ছিলেন উত্তম চরিত্রের অধিকারী। বিদ্যাসাগর, রামমােহন, রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ, শেরে বাংলা, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, মওলানা ভাসানী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতাে মানব্রতী, সমাজব্রতী, দেশ্বতী মহাপ্রাণ মানুষ তাঁদের উন্নত ও মহৎ চরিত্রশক্তির গুণেই অন্যায় ও অসত্যের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নিতে পেরেছিলেন। 

উপসংহার : পরিভােগপ্রবণ বিশ্বে আজ চারপাশে বাড়ছে মূল্যবােধের অবক্ষয়। সততা, ন্যায়নীতি হচ্ছে বিপর্যস্ত। চরিত্রের মহিমাকে উপেক্ষা করতে বসেছে মানুষ। লােভ-লালসা, ঈর্ষা-হিংসা, অন্যায়-দুর্নীতি ক্রমেই আচ্ছন্ন করছে ব্যাপক সংখ্যক মানুষকে। হীনস্বার্থ হাসিলের অনৈতিক পন্থায় চালিত হচ্ছে একশ্রেণির লােক। এ অবস্থায় জাতীয় জীবনে চাই চরিত্রশক্তির নবজাগরণ। চরিত্র হারানাে প্রজন্মকে শােধরানাে কঠিন। তাই নতুন প্রজন্মকে বেড়ে উঠতে হবে চরিত্রের মহান শক্তি অর্জন করে। তাহলেই আমাদের ভবিষ্যৎ হবে মানবিক মহিমায় ভাস্বর।

Next Post Previous Post