বাংলা রচনা : পল্লী উন্নয়ন

পল্লী উন্নয়ন

পল্লী উন্নয়ন 

একি অপরূপ রূপে মা তােমায় হেরিনু পল্লি জননী
ফুলে ও ফসলে কাদা মাটি জলে ঝলমলে লাবণী, 

ভূমিকা : হাজার বসতি নিয়ে এক একখানা গ্রাম। বাউলের একতারা মাটির সুবাসে ভরা গ্রাম। আটষট্টি হাজার গ্রামের সেই অতীত গৌরব এখন আর নেই। গােলাভরা ধান আর পুকুর ভরা মাছের সুখকর সমৃদ্ধির কথা স্লান হয়ে আছে স্মৃতির পাতায়। সুজলা, সুফলা শস্যশ্যামলা গ্রামবাংলা তার সকল সমৃদ্ধি হারিয়ে এখন উপেক্ষিত। বিধাতা তৈরি করেছিলেন গ্রাম আর মানুষ তৈরি করেছে শহর। শহরের চাকচিক্য আর চোখ ধাঁধানাে আলােয় বিভ্রান্ত মানুষ পতঙ্গের মতাে ঝাঁপিয়ে পড়ছে শহরের নির্মম সৌন্দর্যে। ফলে গ্রাম হয়ে গেছে হতশ্রী। অশিক্ষা, দুঃখ-দারিদ্র্য, প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর নদীর আক্রোশে ভেঙেপড়া গ্রাম এখন রুগণ, শুষ্ক, শ্রীহীন।

অতীতের গ্রাম : এককালে এ দেশের গ্রামগুলােই ছিল সম্পদ আর সমৃদ্ধির প্রাণকেন্দ্র। উদার প্রকৃতি, মুক্ত আকাশ, সতেজ হাওয়া ভরিয়ে দিত মন। বিস্তৃত ফসলের মাঠ, বিশাল নদীর বুকে পাল তােলা সওদাগরি নৌকা, সহজ সরল গ্রামবাসীদের অনাড়ম্বর সাধারণ জীবন যাপন, উৎসব-অনুষ্ঠান এসব ছিল গ্রামের সমৃদ্ধির নমুনা। কবি জসীমউদ্দীন সেই গ্রামের কথাই বলেছেনー

তুমি যাবে ভাই, যাবে মাের সাথে আমাদের ছােট গাঁয়
গাছের ছায়ায় লতায় পাতায় উদাসী বনের বায় ॥

সেই কিংবদন্তির গ্রামবাংলা এখন আর নেই। রােগ, শােক, ক্ষুধা-দারিদ্র্য, অশিক্ষা-অন্ধকার, কুসংস্কার আর বেকারত্বে গ্রাম এখন পর্যদস্ত।

গ্রামের বর্তমান অবস্থা : নানা সমস্যায় জর্জরিত এখন গ্রামের জীবন। গ্রামে যারা একটু লেখাপড়া শিখছে, তারা শহরে ছুটছে চাকরির আশায়। লেখাপড়া জানা লােক এখন আর গ্রামে থাকতে চায় না। কারণ গ্রামে শিক্ষিত লােকের কোনাে কর্মসংস্থান নেই। জীবিকা নেই, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের সুযােগ নেই। দেশে মানুষ বেড়েছে, শিক্ষার সুযােগও অনেক বেড়েছে কিন্তু গ্রামে শিক্ষিত লােকের অভাব আগের মতােই। যােগাযােগব্যবস্থা কোথাও কোথাও কিছুটা ভালাে হলেও অধিকাংশ গ্রামের রাস্তাঘাট উন্নত নয়। ফলে অবহেলিত গ্রামে স্বাচ্ছন্দ্যহীন পরিবেশে মানুষ বাস করতে চায় না। গ্রামের কথা ভাবলেই এখন চোখে ভাসে ক্লিষ্ট মানুষ, ছিন্ন বস্তু, জীর্ণ বাড়িঘর ইত্যাদি।

পল্লী উন্নয়ন : বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতির অস্তিত্ব রক্ষার প্রয়ােজনেই পল্লি-উন্নয়ন করতে হবে। দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে গ্রামের উন্নয়ন প্রয়ােজন। কারণ, গ্রাম উন্নয়ন ছাড়া জাতির উন্নতি সম্ভব নয়। আর এ কারণেই গ্রামের উন্নতির জন্য বিভিন্ন সময়ে সরকার নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। গ্রামে শিক্ষা বিস্তারের জন্য স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠা করা, গ্রামের অর্থনীতিকে সবল করার জন্য স্বাস্থ্য, স্যানিটেশনব্যবস্থা, কৃষি উৎপাদন, কৃষিযন্ত্রপাতি, সেচ, সার, কীটনাশক, উন্নত বীজ ইত্যাদি সরবরাহ করা হচ্ছে। কৃষিঋণ ও কৃষিভর্তুকি-ব্যবস্থাও আছে। কিন্তু সরকারি এসব উপকরণ গ্রামের সবার কাছে সময়মতাে পৌঁছে না। মনে রাখতে হবে যে, গ্রাম উন্নয়ন মানে গ্রামের উচ্ছেদ নয়, গ্রামীণ অবকাঠামােগত উন্নয়ন সাধন। গ্রাম উন্নয়নের জন্য দরকার বাস্তবমুখী বিভিন্ন পদক্ষেপ, যেমন : 

১. কৃষি উন্নয়ন : কৃষিই গ্রাম বাংলার অর্থনীতির প্রাণ। কৃষি অর্থনীতিতে প্রাণসঞ্চার করতে হলে দরকার কৃষিক্ষেত্রের আধুনিকায়ন। আমাদের সব জায়গায় আধুনিকতার ছোঁয়া লাগলেও কৃষিক্ষেত্র রয়ে গেছে মান্ধাতার আমলে। কৃষিক্ষেত্রে আধুনিক ও উন্নত যন্ত্রপাতির ব্যবহার সুলভ ও সম্প্রসারিত করতে হবে। সেচ, সার, কীটনাশক, উন্নত বীজ ইত্যাদি সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। কৃষিপণ্যের সংরক্ষণ, বাজারজাতকরণ ও উপযুক্ত মূল্য নিশ্চিত করে গ্রামীণ অর্থনীতিকে সবল করা যায়। 

২. অবকাঠামােগত উন্নয়ন : পল্লির অবকাঠামােগত উন্নয়ন সাধন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষা, স্বাস্থ্য,পানীয় জল, রাস্তাঘাট, যােগাযােগ ব্যবস্থার উন্নয়ন দরকার। এগুলাে নিশ্চিত করা গেলে শিক্ষিত মানুষের গ্রামে বসবাস করার সুযােগ তৈরি হবে। শিক্ষিত মানুষ গ্রামে বসবাস করলে গ্রামের সামাজিক উন্নয়ন অনেকাংশে ত্বরান্বিত হবে। 

৩. কুটির শিল্প : কৃষিনির্ভর ব্যবসা, স্বল্পপুঁজির কুটির শিল্প গড়ে তােলার উদ্যোগ নিতে হবে। অনুৎপাদনশীল জনগােষ্ঠীকে কৃষির পাশাপাশি কাজে লাগাতে হবে কুটির শিল্পে।

৪. ভূমিহীনদের পুনর্বাসন : গ্রামে যেসব ভূমিহীন দরিদ্র মানুষ আছে, তাদের মধ্যে খাসজমি বিতরণ করে তাদের পুনর্বাসন করতে হবে। তাদের বেকার হাতকে কাজে লাগিয়ে গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙা করা সম্ভব। 

৫. বৃত্তিমূলক শিক্ষার ব্যবস্থা : গ্রামের দরিদ্র পরিবারের যুবক, যারা নানা কারণে শিক্ষাগ্রহণ করতে পারেনি, তাদের বৃত্তিমূলক শিক্ষার ব্যবস্থা গ্রামেই নিতে হবে। এতে গ্রামের বেকারত্ব ও দারিদ্র্য বিমােচন ঘটবে বিপুলভাবে। বৃত্তিমূলক শিক্ষা গ্রহণকারীদের গ্রামের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শিল্প গড়ে তােলার কাজে সহজ শর্তে প্রয়ােজনীয় ঋণের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। 

৬. সমবায় আন্দোলন গড়ে তােলা : সমবায় আনে সমৃদ্ধি, সমবায়ে সুখ। গ্রামের মানুষকে সমবায়ে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। সমবায়ের মাধ্যমে কৃষি-উন্নয়ন, কুটিরশিল্প স্থাপন, ব্যবসা-বাণিজ্যের নানা সুযােগ সৃষ্টি করা যায়। এতে সর্বস্বত্বভােগীদের দৌরাত্ম থেকেও গ্রামবাসী রক্ষা পাবে। 

৭. মৎস্যচাষ, পশুপালন, দুধ-খামার তৈরি : গ্রামের মানুষদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যতই যুক্ত করা যাবে ততই গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নতি ঘটবে। এ জন্য গ্রামীণ জনশক্তিকে কৃষিকাজের পাশাপাশি মৎস্যচাষ, পশুপালন, হাঁসমুরগির খামার স্থাপন ইত্যাদিতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। 

উপসংহার : দেশের বৃহত্তর স্বার্থে গ্রাম-উন্নয়নে সর্বাত্মক উদ্যোগ নেওয়া দরকার। সরকারকে পাঁচসালা পরিকল্পনায় গ্রাম উন্নয়নকে প্রাধান্য দিতে হবে। উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু কেবল শহর নয়, যুগপৎ গ্রামও হতে হবে। গ্রামকে বাদ দিয়ে দেশের উন্নতি কখনও সম্ভব হবে না। জাতীয় অর্থনীতির প্রধান অংশ আজও গ্রামই জোগান দিয়ে থাকে। শহরের চাল, ডাল, সবজি, মাছ গ্রাম থেকেই আসে। শহরের জনগণকে বাঁচিয়ে রাখছে গ্রাম। অথচ সেই গ্রামই সবচেয়ে অবহেলিত। দেশের সার্বিক সমৃদ্ধির প্রয়ােজনেই তাই গ্রামের উন্নয়ন অপরিহার্য।

Next Post Previous Post