বাংলা রচনা : বাংলাদেশের যােগাযােগ ব্যবস্থা

বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা

বাংলাদেশের যােগাযােগ ব্যবস্থা
অথবা, আর্থনীতিক উন্নয়নে যােগাযােগ ব্যবস্থা 

[ সংকেত : ভূমিকা; বাংলাদেশে যােগাযােগ ব্যবস্থার প্রকারভেদ; রেলপথ; সড়কপথ; নৌপথ; বিমানপথ; দেশের অর্থনীতিতে যােগাযােগ ব্যবস্থার গুরুত্ব; বাংলাদেশের যােগাযোেগ পরিস্থিতি; উপসংহার। ]

ভূমিকা : যে কোনাে দেশের আর্থনীতিক উন্নয়নে যােগাযােগ ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। যােগাযােগ ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করে আবর্তিত হয় একটি দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিক কর্মকাণ্ড। যােগাযােগ ব্যবস্থা উন্নত হলে কৃষিজাত দ্রব্যাদি, শিল্পের কাঁচামাল, শিল্পজাত পণ্যসামগ্রী ইত্যাদি সহজে ও স্বল্প ব্যয়ে স্থানান্তরের যে সুবিধা পাওয়া যায় তাতে দেশে উৎপাদন বৃদ্ধি পায়, শিল্প ও ব্যবসায়ের প্রসার ঘটে এবং আর্থনীতিক উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত হয়। এ কারণে যােগাযােগ ব্যবস্থাকে আর্থনীতিক সমৃদ্ধির প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা যায়। যােগাযােগ ব্যবস্থার সঙ্গে দেশের আর্থনীতিক, সামাজিক ও রাজনীতিক অবস্থার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। 

বাংলাদেশে যােগাযােগ ব্যবস্থার প্রকারভেদ : দেশের কাঠামাের ওপর ভিত্তি করে যােগাযােগ ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। ভূ-প্রাকৃতিক অবস্থার সঙ্গে সংগতি রেখে যােগাযােগ ব্যবস্থা গড়ে তােলা হয়। ভূ-প্রাকৃতিক বাস্তবতার ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশে রেলপথ, সড়কপথ, নৌপথ ও বিমানপথ এই চার ধরনের যােগাযােগ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে।

রেলপথ : বাংলাদেশের সামগ্রিক যােগাযােগ ব্যবস্থার মধ্যে রেলপথের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। দেশের রাজধানী, বিভিন্ন বন্দর ও বড়াে শহরের সঙ্গে পারস্পরিক যােগাযােগের জন্য রেলপথের গুরুত্ব অপরিসীম। রেলভ্রমণ বেশ আনন্দদায়ক। নদীমাতৃক দেশ হওয়ায় বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় রেল যােগাযােগ স্থাপন করা সম্ভব হয়নি। তাছাড়া বাংলাদেশের আয়তন ও জনসংখ্যার তুলনায় রেলপথ যথেষ্ট নয়। দেশে বর্তমানে প্রায় ৪৫০০ কিলােমিটার রেলপথ রয়েছে। 

সড়কপথ : বর্তমানে বাংলাদেশের যােগাযােগ ব্যবস্থায় সড়কপথ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে। এদেশ গ্রামপ্রধান এবং ।। দেশের অধিকাংশ মানুষ গ্রামে বসবাস করে। শহরের সঙ্গে গ্রামের ঘনিষ্ঠ যােগাযােগের ফলে জাতীয় উন্নতির সুযােগ ঘটে। বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় সড়কপথে যােগাযােগ ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের সড়ক যােগাযােগ যথার্থ উন্নত নয়। দেশে বর্তমানে প্রায় দুই লক্ষ সত্তর হাজার কিলােমিটার সড়কপথ রয়েছে। তার মধ্যে পাকা সড়কের পরিমাণ ২১,৫৮৯.৬৫ কিলােমিটার। সড়কপথে বাস, ট্রাক, সিএনজি, মােটর গাড়ি, মিনিবাস, স্কুলভ্যান, কলেজ বাস, টেম্পু, লরি, ট্যাংক ইত্যাদি যানবাহন যাতায়াত করে। সাম্প্রতিককালে সড়ক যােগাযােগের ক্ষেত্রে বেশ অগ্রগতি সাধিত হলেও পূর্ণাঙ্গ সড়ক যােগাযােগ ব্যবস্থা এখনও গড়ে তােলা। সম্ভব হয়নি। জনসংখ্যা বৃদ্ধিজনিত সমস্যার কারণে দেশের রেলপথ ও সড়কপথে প্রবল চাপ পড়ছে। এর জন্য সরকারের গৃহীত উদ্যোগ পর্যাপ্ত বলে প্রতীয়মান হচ্ছে না। 

নৌপথ : বাংলাদেশে নৌপথের গুরুত্ব খুব বেশি। কেননা বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে আছে ছােটো-বড়াে প্রায় ৭০০টি নদী। দেশের নৌপথের মােট দৈর্ঘ্য প্রায় ৮৪০০ কিলােমিটার। বাংলাদেশে সারাবছর মােট নাব্য নৌপথের দৈর্ঘ্য হলাে ৫২০০ কিলােমিটার। নৌপথে স্টিমার, লঞ্চ, কার্গো, ইঞ্জিনচালিত নৌকা, সাধারণ নৌকা ইত্যাদি চলাচল করে। দেশে যাত্রী ও পণ্যসামগ্রী বহনে নৌপথের বিশেষ অবদান রয়েছে। বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক নৌ-যােগাযােগ ব্যবস্থা রয়েছে। নদীপথে বহির্বিশ্বের সাথে নৌ-পরিবহনে পণ্য আদান-প্রদান করা হয়। চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর ও মংলা সমুদ্রবন্দর অন্যতম নৌ-যােগাযােগ মাধ্যম। তাছাড়া প্রস্তাবিত পায়রা সমুদ্রবন্দর আন্তর্জাতিক নৌ-যােগাযােগের অপেক্ষায় রয়েছে। দেশের সব যাত্রী ও পণ্যসামগ্রীর প্রায় পঁচাত্তর ভাগ নৌপথে পরিবাহিত হয়। মাননীয় নৌ-পরিবহনমন্ত্রীর দেওয়া সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী নৌপথের দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি করতে সরকার ইতােমধ্যে ৫৩টি নদী খনন কাজের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে এবং এর অংশ হিসেবে মংলা-ঘাষিয়াখালী নৌপথসহ বেশ কয়েকটি নদীতে ড্রেজিং কাজ অব্যাহত আছে। তিনি আরও জানান যে, বিআইডব্লিউটিএ গত ৫ বছরে ৩১০ কিলােমিটার নৌ-ফেরিপথ ড্রেজিং করেছে। এর ফলে নৌপথের দৈর্ঘ্য ৬২৮ কিলােমিটার বেড়েছে। দেশের উত্তরাঞ্চলে ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়ায় নৌপথের উপযােগিতা কমে এলেও দেশের দক্ষিণাঞ্চলে নৌচলাচলের ব্যাপকতা বিদ্যমান এবং এর ওপর জনগণের নির্ভরশীলতাও অপরিসীম।। 

বিমানপথ : দূর-দূরান্তে অতি দ্রুত যাতায়াত ও পণ্যসামগ্রী পরিবহনের যথার্থ সুযােগ দান করে বিমান ব্যবস্থা। বাংলাদেশ বিমান দেশের বিমান যােগাযোেগ ব্যবস্থার দায়িত্বে নিয়ােজিত। বাংলাদেশ বিমান সংস্থার নাম ‘বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স লিমিটেড। বাংলাদেশের প্রধান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নাম ‘হজরত শাহজালাল (র.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর'। বাংলাদেশ বিমান যেমন আন্তর্জাতিক পথে যােগাযােগ সাধন করছে, তেমনি অনেক বিদেশি বিমান সংস্থাও বাংলাদেশের সঙ্গে বিমান চলাচলের মাধ্যমে যােগাযোেগ রক্ষা করছে। বাংলাদেশ বিমান ক্রমান্বয়েই তার বিমান বহরের পরিধি বাড়াচ্ছে এবং দেশে-বিদেশে যােগাযােগের কােন উত্তরােত্তর নিজ গুরুত্ব বৃদ্ধি করে চলছে।

দেশের অর্থনীতিতে যােগাযােগ ব্যবস্থার গুরুত্ত্ব : দেশের বিভিন্ন ধরনের যােগাযােগ ব্যবস্থা যাত্রী বহন ও পণ্যসামগ্রী স্থানান্তরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের মাধ্যমে আর্থনীতিক অগ্রগতি সাধন করছে। বাংলাদেশের সড়ক যােগাযােগ ব্যবস্থার মাধ্যমে কৃষিনির্ভর ও গ্রামভিত্তিক এদেশের কৃষিপণ্য, শিল্পের কাঁচামাল ও উৎপাদিত পণ্য দ্রুত স্থানান্তরসহ গ্রাম ও শহরের মধ্যে যােগাযােগের উপায় সহজ হয়েছে। কৃষি উন্নয়ন, শিল্প উন্নয়ন, কৃষি ও শিল্পজাত পণ্য বাজারজাতকরণ, গ্রাম অঞ্চল থেকে মূল্যবান সম্পদ আহরণ, যাতায়াত, বনজ সম্পদ সংগ্রহ ইত্যাদি ক্ষেত্রে সড়ক যােগাযােগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। যােগাযােগ ব্যবস্থার সঙ্গে বিপুল সংখ্যক মানুষের জীবিকার প্রশ্ন জড়িত। পল্লিবাংলার উন্নয়নই দেশের উন্নয়ন এবং তার জন্য উন্নত সড়ক যােগাযােগের বিশেষ অবদান রয়েছে। বাংলাদেশ সড়ক যােগাযােগ সংস্থা এবং অসংখ্য বেসরকারি উদ্যোগ দেশের যােগাযােগ ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত। সাম্প্রতিককালে যােগাযােগ ব্যবস্থা ক্রমাগত সম্প্রসারিত হচ্ছে এবং যাত্রীসাধারণ ও মালপত্র পরিবহনের সুযােগ-সুবিধা বৃদ্ধি পাচ্ছে। যাতায়াত ও যােগাযােগের সুবিধা, স্বল্পব্যয়ে যােগাযােগ, উপকূলীয় অঞ্চলে যােগাযােগ, দুর্যোগ মােকাবিলা, বৈদেশিক বাণিজ্য, রাজস্ব আয় ইত্যাদি ক্ষেত্রে নৌ-যােগাযােগ ব্যবস্থা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে নৌ-যােগাযােগের ক্ষেত্রে নানাবিধ সমস্যা। বিরাজমান থাকায় এর সম্ভাবনাকে সম্পূর্ণ কাজে লাগানাে যাচ্ছে না। এক্ষেত্রে অধিকতর সুযােগ-সুবিধা বৃদ্ধির ব্যাপারে তৎপর হওয়া বাঞ্ছনীয়। নদীপথ ভরাট হয়ে যাওয়ার ফলে দেশে নৌ চলাচল বাধা-বিঘ্নের সম্মুখীন হচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ | অপরিহার্য। দেশের বিমান যােগাযােগের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। বিমানের মাধ্যমে অতি দ্রুত দূর-দূরান্তে গমনাগমন করা যায়। কার্গো বিমানে দ্রুত পণ্যসামগ্রী স্থানান্তর সম্ভব। এতে সময়ের অপচয় খুব কম হয়। পচনশীল পণ্যাদি সহজে স্থানান্তর করা যায়। প্রাকৃতিক দুর্যোগে দ্রুত ত্রাণসামগ্রী প্রেরণসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিমান যােগাযােগের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। বাংলাদেশে বিমান যােগাযােগ পর্যাপ্ত না হলেও পরিচালনা দক্ষতা বৃদ্ধি ও যাত্রীসাধারণকে উন্নত সেবাদানের ক্ষেত্রে বিশ্বের উন্নত বিমান সংস্থার সঙ্গে প্রতিযােগিতা করতে পারছে। 

বাংলাদেশের যােগাযােগ পরিস্থিতি : বাংলাদেশ একটি ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। এদেশে আয়তনের তুলনায় জনসংখ্যা অনেক বেশি। তাই অভাব-অনটন এদেশের নিত্য সঙ্গী। ফলে যােগাযােগ ব্যবস্থা তেমন উন্নত নয়। সকল প্রকার যােগাযােগ ব্যবস্থায় উন্নত যােগাযােগের সুযােগ খুবই কম। প্রায় সাড়ে চার হাজার কিলােমিটার রেলপথ থাকলেও তার অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। প্রায়ই ঘটে দুর্ঘটনা। যমুনা সেতু নির্মাণ হলেও তা দেশের যােগাযােগ ব্যবস্থার তেমন পরিবর্তন সাধন করতে পারেনি। দিন দিন নদী ভরাট হয়ে নদীর আয়তন কমছে। এতে নদীপথে যােগাযােগ ব্যবস্থা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ছে ও যােগাযােগের পথ সংকীর্ণ হচ্ছে। তবে ফ্লাইওভার নির্মাণের পর দেশের সড়ক যােগাযােগ ব্যবস্থা এখন কিছুটা সুবিধাজনক। 
উপসংহার : যােগাযােগ ব্যবস্থা দেশ ও জাতির উন্নয়নে বিশেষ অবদান রাখতে পারে। জাতীয় উন্নয়নকে গতিশীল করতে যােগাযােগ ব্যবস্থার উন্নয়নের প্রয়ােজন। বহুল জনসংখ্যা অধ্যুষিত উন্নয়নশীল এই দেশে উন্নত যােগাযােগ ব্যবস্থা গড়ে উঠলে আর্থনীতিক উন্নয়ন সম্ভব। বর্তমান যােগাযােগ ব্যবস্থা সকল ক্ষেত্রে সমপর্যায়ে নেই। বাংলাদেশের যােগাযােগ ব্যবস্থার এই বৈচিত্র্যের মধ্যে সকলের গুরুত্ব সমপর্যায়ের না হলেও দেশের আর্থনীতিক উন্নয়নে এদের অবদান অনস্বীকার্য। তাই বিভিন্ন যােগাযােগ ব্যবস্থার মধ্যে সুষ্ঠু সমন্বয় সাধন করে এগুলােকে পরস্পরের পরিপূরক হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। বিভিন্ন যােগাযােগ ব্যবস্থার সমন্বয় সাধনের মধ্যেই নিহিত আছে দেশের আর্থনীতিক উন্নতি।
Next Post Previous Post