বাংলা রচনা : সৎসঙ্গ

সৎসঙ্গ

সৎসঙ্গ

[সংকেত : ভূমিকা; সৎসঙ্গ বলতে যা বােঝায়; সৎসঙ্গীর বৈশিষ্ট্য; সৎসঙ্গের তাৎপর্য; সৎসঙ্গ ও অসৎ সঙ্গের প্রভাব; সৎসঙ্গী নির্বাচন; ছাত্রজীবনে সৎসঙ্গের গুরুত্ব; সৎসঙ্গের প্রয়ােজনীয়তা; উপসংহার। ]

ভূমিকা : মানুষ সামাজিক জীবই শুধু নয়; সে জন্মগতভাবেই সঙ্গপ্রিয়। সঙ্গসুখ ছাড়া মানুষের জীবন এক মুহূর্তও চলতে পারে না। সঙ্গীর কামনা মানুষের চিরন্তন প্রবৃত্তি। তাই তাে সৃষ্টির শুরু থেকেই মানুষ সংঘবদ্ধভাবে জীবনযাপন করে আসছে। বস্তুত ব্যক্তিজীবনের সার্থকতা নির্ভর করে সমাজ ও পরিবেশের ওপর। সেই সমাজ ও পরিবেশ মানুষের ব্যক্তিত্ব দ্বারাই প্রভাবিত হয়। তাই জীবনের যথার্থ ও সুষ্ঠু বিকাশের জন্য সৎ সাহচর্যের বিশেষ প্রয়ােজন। সৎসঙ্গ মানুষের জীবনকে পরিপূর্ণতার দিকে উন্নীত করে। পক্ষান্তরে, অসৎসঙ্গ তার ব্যক্তিত্ব, প্রতিভা, সুনাম এমনকি সাফল্যকেও ধ্বংস করে। এ কারণে সৎসঙ্গ ও অসৎসঙ্গ এই দুয়ের মধ্যকার পার্থক্যটা বুঝে সুচিন্তিতভাবে সৎসঙ্গকে বেছে নেওয়াই ব্যক্তির মঙ্গলার্থে বাঞ্ছনীয়। 

সৎসঙ্গ বলতে যা বােঝায় : যে সঙ্গ বা সান্নিধ্য থেকে সদুপদেশ, সৎ পরামর্শ ও সঠিক পথে পরিচালিত হওয়ার প্রেরণা পাওয়া যায় তাই সৎসঙ্গ হিসেবে বিবেচিত। অর্থাৎ, ব্যক্তি তার মানসিক ও সামাজিক অভাব পূরণ করার জন্য যেসব সঙ্গীর সঙ্গে নিত্য চলাফেরা ও ওঠাবসা করে, তাদের চরিত্র যদি পবিত্র এবং সুন্দর হয়, তাহলে তাদের সঙ্গই সৎসঙ্গ। বস্তুত, সৎসঙ্গ বলতে বােঝায় উত্তম চরিত্রের বন্ধুবান্ধব- যাদের প্রভাব ও আদর্শে নিজের জীবনকে সুন্দরভাবে গড়ে তােলা যায়। আর উত্তম চরিত্র বলতে বােঝায়সততা, সত্যনিষ্ঠা, প্রেম পরােপকারিতা, দায়িত্ববােধ, শৃঙ্খলা, অধ্যবসায়, কর্তব্যপরায়ণতা ইত্যাদি। এগুলাে যখন মানুষ সহজে নিজের মধ্যে বিকশিত করে তােলে এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবে তার প্রতিটি কথা ও কাজের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয় তখন উত্তম চরিত্র তার স্বভাবের সঙ্গে একীভূত হয়ে যায়। 

সৎসঙ্গীর বৈশিষ্ট্য : ইংরেজিতে একটি প্রবাদ ত তে একটি প্রবাদ আছে— A man is known by the company he keeps. অর্থাৎ সঙ্গী থেকে মানুষের চরিত্র জানা যায়। তাই চরিত্রবান হতে হলে চাই সৎ ও পরােপকারী সঙ্গী। যে বন্ধু বা সুহৃদের আচরণে অনুসরণীয় আদর্শ থাকবে, যার কথাবার্তায় সুখকর অনুভূতি সঞ্চারিত হয়ে হৃদয়ে উত্তাপ সঞ্চার করবে, যার কর্মকাণ্ডে কল্যাণের স্পর্শ থাকবে সেই হলাে যথার্থ বন্ধু বা সঙ্গী। সৎসঙ্গী কখনােই বন্ধুর অকল্যাণ কামনা করে না, বরং সবসময় কীভাবে বন্ধুর উপকার হবে সে ব্যাপারে সচেতন থাকে। সৎ বন্ধু নিজের স্বার্থকে বিসর্জন দিয়ে বন্ধুর স্বার্থকেই বড়াে করে দেখে। বস্তুত মানবিক গুণাবলির সমাহার হিসেবে ধৈর্য, সাহস, আনুগত্য, সততা, সৌজন্য, কৃতজ্ঞতাবােধ ইত্যাদি সৎসঙ্গীর বৈশিষ্ট্য বলে বিবেচ্য। 

সৎসঙ্গের তাৎপর্য : কবি শেখ সাদির একটি কবিতায় সৎসঙ্গের গুরুত্ব সম্পর্কে উপদেশ পাওয়া যায়। তাঁর ভাষায়ー

হে সুগন্ধী মৃত্নপী কহ ত বিবরি 
তুমি কি অম্বার মণি অথবা কস্তুরি ।
নইক অম্বার আমি, নই কস্তুরিকা
গােলাপের মূলে ছিনু আমি যে মৃত্তিকা । 

যে ফুলবাগানে থাকে তার গায়ে ফুলের সৌরভ ছড়ায় আর যে নর্দমায় থাকে তার গায়ে দুর্গন্ধ ছড়ায়। অনুরূপভাবে, মানুষের জীবনেও সৎসঙ্গের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। সমাজজীবনে একজন মানুষ সঙ্গ প্রভাবে যেমন অতুলনীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী হতে পারে, তেমনি হতে পারে দুশ্চরিত্র, দুবৃত্ত। অনেক প্রতিভাবান ও মনােরম চরিত্রের মানুষকেও অসৎ সঙ্গের প্রভাবে অধঃপতনের গভীরে তলিয়ে যেতে দেখা গেছে। আবার অনেক অধঃপতিত ব্যক্তিকেও সচ্চরিত্র মানুষের সঙ্গলাভের মাধ্যমে সুস্থ-সুন্দর জীবনে ফিরে আসতে দেখা যায়। প্রকৃতপক্ষে, সৎসঙ্গী সচেতন প্রহরীর মতাে। বন্ধুকে অন্যায় ও অসত্যের পথ থেকে বিরত রাখতে সে সর্বদাই সচেষ্ট থাকে। মােটকথা, ব্যক্তিগত, সামাজিক ও জাতীয় জীবনের একতা আনয়নে সৎসঙ্গী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

সৎসঙ্গ ও অসৎ সঙ্গের প্রভাব : ভালাে-মন্দের সমাহারে মানুষের চারপাশের জীবন নিয়ত আবর্তিত হচ্ছে। কিন্তু জীবনের সার্থক বিকাশের জন্য প্রয়ােজন কেবল ভালাে দিক, মন্দ দিকগুলাে মানুষকে সচেতনভাবে পরিহার করে চলতে হয়। সেজন্য মন্দ সঙ্গ পরিত্যাগ করে উত্তম সঙ্গীকে সাথে নিয়ে জীবনে এগিয়ে যেতে হয়। ব্যক্তি-চরিত্রের ওপর তার সঙ্গী-সাথির প্রভাব অত্যন্ত প্রত্যক্ষ এবং প্রবল। সঙ্গীর চরিত্র যদি হয় অসৎ, নিয়মবিরুদ্ধ এবং কলুষিত তাহলে সঙ্গ পাওয়া ব্যক্তির ওপর খারাপ প্রভাব পড়বে এতে কোনাে সন্দেহ নেই। পক্ষান্তরে, সঙ্গীর চরিত্র যদি নির্মল, সুন্দর এবং পবিত্র হয় তার প্রভাবেও ব্যক্তির নিজস্ব চরিত্র বিকশিত হওয়ার সুযােগ পায়। বস্তুত সৎসঙ্গের অভাবেই মানুষ আজ সত্যপথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে। ফলে সমাজে এসেছে অবক্ষয়। ঘরে-বাইরে সর্বত্রই আজ মনুষ্যত্বের দীনতার চিত্র পরিলক্ষিত হয়। একদিকে রাজনীতিক দ্বন্দ্ব-কলহ, অপরদিকে অর্থনীতিক দুর্দশা; ফলে স্বেচ্ছাচারিতা যুবসমাজকে বিপথগামী করছে। সুতরাং মানুষকে সরল-সঠিক পথে পরিচালিত করার জন্য সৎসঙ্গের কোনাে বিকল্প নেই। সৎসঙ্গের সংস্পর্শে মানুষ পাপ ও পতন থেকে রক্ষা পায়। সকল অন্যায়-অকল্যাণ থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখে সে সার্বিক মঙ্গল কামনায় আত্মনিয়ােগ করে। তাই ব্যক্তির ভালাে-মন্দ গুণ বিচারে সঙ্গীর প্রভাব ব্যাপকভাবে ক্রিয়াশীল। 

সৎসঙ্গী নির্বাচন : বিখ্যাত দার্শনিক ও প্রখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এরিস্টটল বলেছেন, প্রকৃত বন্ধু হলাে দুই দেহ এক আত্মা। বন্ধু নির্বাচন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং এর ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে। একজন উত্তম বন্ধু যেমন জীবনের অধঃপতন রােধ করতে পারে। তেমনি একজন অসৎ বন্ধু জীবনকে ধ্বংসের চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে দিতে পারে। এজন্য প্রবাদ রয়েছে- ‘সঙ্গদোষে লােহা ভাসে। পরশমণির ছোঁয়ায় লােহা যেমন সােনায় রূপান্তরিত হয় তেমনি সচ্চরিত্রের প্রভাবে মানুষের পশুপ্রবৃত্তি ঘুচে যায়, জন্ম নেয় সৎ, সুন্দর ও মহৎ জীবনের আকাঙ্ক্ষা। আবার সঙ্গদোষে মানুষ তার চরিত্র হারিয়ে পশুর চেয়েও অধম হয়ে যায়। এ জগতে যত লােকের অধঃপতন হয়েছে অসৎ সংসর্গই এর অন্যতম কারণ। এজন্য বলা হয়, দুর্জন বিদ্বান হলেও পরিত্যাজ্য। তাই সঙ্গ নির্বাচনে আমাদের সবিশেষ সতর্ক হতে হবে। কাউকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করার পূর্বে তার আচার-আচরণ, কার্যকলাপ, তার প্রকৃতি ও প্রবৃত্তি সম্পর্কে ভালাে ধারণা নিতে হবে। নিছক আবেগ ও ক্ষণিকের মােহে আবদ্ধ হয়ে বন্ধু নির্বাচন করলে এর পরিণাম ভয়াবহ হতে পারে। এজন্য সৎ বন্ধু নির্বাচনে তিনটি গুণ পরীক্ষা করা একান্ত আবশ্যক। (১) নির্বাচিত ব্যক্তিকে জ্ঞানী হতে হবে (২) তার চরিত্র হতে হবে সুন্দর ও মাধুর্যময় এবং (৩) তাকে পুণ্যবান হতে হবে। বস্তুত জ্ঞানী, সৎ, ন্যায়পরায়ণ, ত্যাগী, নিঃস্বার্থ, চরিত্রবান, সহজসরল ইত্যাদি গুণ দেখে সঙ্গী নির্বাচন করলে উত্তম বন্ধু লাভ করা যায়।

ছাত্রজীবনে সৎসঙ্গের গুরুত্ব : ছাত্রজীবন মানুষের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়। বয়সগত কারণে এ বয়সে মানুষের সঙ্গ কামনা সবচেয়ে বেশি অনুভূত হয়। অভিজ্ঞতা ও বাস্তব জ্ঞানের অভাবে এ বয়সে বন্ধুর দ্বারা মানুষ সহজেই প্রভাবিত হয়। তাই এ বয়সে সৎসঙ্গের জরুরি প্রয়ােজন। অনেক তরুণ বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে দুষ্কর্মে জড়িয়ে পড়ে। আজকাল ছাত্র ও তরুণ সামজের মধ্যে মাদকদ্রব্যের নেশা, সন্ত্রাস ও অসামাজিক কার্যকলাপের যে প্রবণতা লক্ষ করা যায়, তার জন্য তাদের একমাত্র সঙ্গদোষই দায়ী। তাই ছাত্রদের নিজেদের সঙ্গী নির্বাচনে যেমন সতর্ক হতে হবে, তেমনি অভিভাবকদেরও লক্ষ রাখতে হবে তাদের সন্তান কার সঙ্গে মেলামেশা করে সে ব্যাপারে। কাজেই ছাত্রদের জীবনে কোনাে সর্বনাশ যাতে ঘনিয়ে না আসে, সেজন্য সর্বদা তাদের সঙ্গী নির্বাচনে সচেতন থাকতে হবে। ছাত্রসমাজের সর্বনাশ মানে জাতির ভবিষ্যৎ ধ্বংস হওয়া। কেননা ছাত্ররাই জাতির ভবিষ্যৎ কর্ণধার। 

সৎসঙ্গের প্রয়ােজনীয়তা : শেখ সাদির একটি বিখ্যাত উক্তি রয়েছে, “সৎসঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎসঙ্গে সর্বনাশ’ । সৎসঙ্গের প্রভাবে অনেক কলুষিত চরিত্রের ব্যক্তিও অনুকরণ ও অনুসরণের পথ অবলম্বন করে নিজের চরিত্রকে নির্মল ও আকর্ষণীয় করে তােলার সুযােগ পায় । সৎসঙ্গের এই অনুবর্তনকারী এবং পরিবর্তনকারী উভয় প্রভাবই গুরুত্বপূর্ণ এবং কাম্য। সুতরাং নিজের জীবন বিকশিত করার জন্য এবং একই সঙ্গে অপরের কলুষিত চরিত্রের ধ্বংসকারী প্রভাব থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য সৎসঙ্গ অত্যাবশ্যক। বস্তুত যতদিন পর্যন্ত জীবন গঠনের জন্য শিক্ষাকাল চলতে থাকে ততদিন পর্যন্ত উত্তম সঙ্গী অপরিহার্য। যদিও সারা জীবনই উত্তম সঙ্গীর প্রয়ােজন রয়েছে, তথাপি জীবন গঠনকালে একজন ভালাে বন্ধু স্রষ্টার অনবদ্য আশীর্বাদ। একজন উত্তম সঙ্গী মানুষের জীবনকে সার্থক, সুন্দর, আনন্দদায়ক ও মধুময় করে তােলে। 

উপসংহার : মহানবি হজরত মুহম্মদ (সা.) বলেছেন, কুসংসর্গে বাস করার চেয়ে একা বাস করা ভালাে এবং অসৎ বাক্যালাপ অপেক্ষা চুপ করে থাকা উত্তম। অর্থাৎ বাক্যালাপের জন্য যেমন বিদ্যান্বেষীর দরকার, তেমনি সঙ্গদানের জন্য সৎসঙ্গের একান্ত প্রয়ােজন। বস্তুত একজন ভালাে ও জ্ঞানী বন্ধু একটি গ্রন্থাগারের সমান, যার সান্নিধ্যে যে কারও জীবন বিকশিত হতে বাধ্য। দুঃখ, হতাশা ও ব্যর্থতার গ্লানি মানুষকে প্রতিনিয়ত তাড়া করে বেড়ায়, যার থেকে পরিত্রাণ পেতে একজন সৎসঙ্গীর সান্নিধ্য লাভ পরশমণিস্বরূপ। তবে যদি নিতান্ত প্রয়ােজনে অসৎ ব্যক্তির সঙ্গে মিশতেই হয়, তাহলে সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সেই কালজয়ী উক্তি স্মরণ করেই চলতে হবে। আর তা হলাে- ‘তুমি অধম, তাই বলিয়া আমি উত্তম না হইব কেন। তাহলে হয়তাে দেখা যাবে আমি নিজেই অন্যের সৎসঙ্গী হয়ে অপরের কলুষিত জীবনকে আলােয় ভরে তুলতে সক্ষম হয়েছি। এর চেয়ে মহৎ কর্ম জগতে আর কিছু হতে পারে না।

Next Post Previous Post