বাংলা রচনা : সড়ক দুর্ঘটনার কারণ ও প্রতিকার

সড়ক দুর্ঘটনার কারণ ও প্রতিকার
বাংলা রচনা : সড়ক দুর্ঘটনার কারণ ও প্রতিকার

সড়ক দুর্ঘটনার কারণ ও প্রতিকার
অথবা, নিরাপদ সড়ক চাই

[ সংকেত : ভূমিকা; বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার প্রকৃতি; সড়ক দুর্ঘটনার কারণ; সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিকারের উপায়; উপসংহার। ]

ভূমিকা : জীবন ও জীবিকার তাগিদে মানুষকে প্রতিনিয়ত কর্মব্যস্ত থাকতে হয়। কখনাে শহর থেকে গ্রামে, কখনাে গ্রাম থেকে শহরে, আবার কখনাে বা বসবাসরত স্থানের নানা পথ ধরে এদিক-ওদিক মানুষকে ছুটতেই হয়। কেউ কেউ আবার পথকেই সঙ্গী করে নিয়েছে। কিন্তু পথ মানুষকে কতটুকু সঙ্গী করতে পেরেছে? প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ পথের বলি হচ্ছে। কত মানুষের জীবন। যন্ত্রদানবের চাকায় পিষ্ট হয়ে যাচ্ছে। মােটকথা সড়ক দুর্ঘটনা ইদানীং অহরহ ঘটে চলেছে। 

বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার প্রকৃতি : সড়ক দুর্ঘটনা বাংলাদেশের একটি নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিন পত্রিকার পাতা ও টেলিভিশনের পর্দায় চোখ রাখলেই দেখা যায় অসংখ্য মানুষ নানাভাবে সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন শহরে ও সড়ক-মহাসড়কে বেশিরভাগ দুর্ঘটনাগুলাে ঘটছে। ফলে অকালে ও অকস্মাৎ মৃত্যু বা পঙ্গুত্ব হচ্ছে এদেশের নিরীহ যাত্রী ও পথচারী। দুর্ঘটনা ঘটার সাথে সাথেই গাড়ির চালক পালিয়ে যায়। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের হিসাব অনুযায়ী, সড়ক, দুর্ঘটনায় প্রতিবছর বাংলাদেশে কমপক্ষে তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে; পঙ্গুত্ব হচ্ছে কমপক্ষে দশ হাজার মানুষ এবং দুর্ঘটনাস্থলে আহত হয় বিশ থেকে ত্রিশ হাজার মানুষ। দুর্ঘটনার বেশিরভাগই মহাসড়কগুলােতে ঘটে থাকে। 

সড়ক দুর্ঘটনার কারণ : বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার নানাবিধ কারণ রয়েছে। তন্মধ্যে উল্লেখযােগ্য কয়েকটি কারণ হলাে

১. যানবাহনের যান্ত্রিক ত্রুটি। 
২. চালকদের অসতর্কতা। 
৩. লাইসেন্সবিহীন কিংবা অনভিজ্ঞ চালক কর্তৃক গাড়ি চালনা। 
৪. কখনাে কখনাে চালক থাকা অবস্থায় হেলপার কর্তৃক গাড়ি চালনা।
একে অপরকে ওভারটেক করার প্রবণতা। 
৬. অতিরিক্ত গতিবেগের কারণে নিয়ন্ত্রণ হারানাে । 
৭. কখনাে কখনাে নিজের অজান্তে চালকের ঘুমিয়ে পড়া। 
৮. অতিরিক্ত যাত্রী বোেঝাই কিংবা মাল বােঝাই করা। 
৯, অমসৃণ ও আঁকাবাঁকা রাস্তা। 
১০. অতি পুরাতন জীর্ণ সেতু। 
১১. মহাসড়কে রিকশা, টেম্পু কিংবা অটো রিকশা চলাচল। 
১২. চালকদের মাদকাসক্তি বিশেষত ট্রাক চালকদের মাদকাসক্তি। 
১৩. পথচারীদের অসতর্ক চলাচল। 
১৪. দুর্বল আইন কিংবা আইন প্রয়ােগের দুর্বলতা। 
১৫. দুর্ঘটনা সংঘটনকারী চালকের উপযুক্ত শাস্তি বিধান না হওয়া। 

সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিকারের উপায় : উপরিউক্ত কারণগুলাে প্রতিরােধ করতে পারলেই সড়ক দুর্ঘটনা অনেকাংশেই এড়ানাে সম্ভব। যেমন,

১। গাড়ির ইঞ্জিন ও চাকাগুলাে ত্রুটিমুক্ত রাখা : আমরা প্রায়ই লক্ষ করি কিংবা শুনতে পাই ইঞ্জিনের ত্রুটির কারণে গাড়ির ব্রেক
ফেল করে কিংবা কখনাে কখনাে চাকার ত্রুটির কারণে গাড়ি দুর্ঘটনায় পতিত হয়। কাজেই গাড়ি রাস্তায় বের করার পূর্বে অবশ্যই এগুলাে ত্রুটিমুক্ত কি না তা ভালাে করে দেখতে হবে। 

২। সড়ক সংস্কার : আমাদের দেশের অধিকাংশ বড়াে বড়াে দুর্ঘটনা ঘটে মহাসড়ক ও রাজপথগুলােতে। এর প্রধান কারণ হলাে এ সড়কগুলাে অত্যন্ত আঁকাবাঁকা ও সংকীর্ণ। ফলে অধিক ও ভারী যানবাহন চলাচল করলে দুর্ঘটনা ঘটে। এজন্য এসব সড়ক মহাসড়ক প্রশস্ত ও সােজা করে নির্মাণ করে ডিভাইডারের ব্যবস্থা করতে হবে। 

৩। ট্রাফিক আইন আধুনিকরণ : আমাদের দেশে যে ট্রাফিক আইন প্রচলিত আছে তার আধুনিকীকরণ করতে হবে। গাড়ির বৈধ কাগজ না থাকলে সেক্ষেত্রে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। অনেক দিনের পুরাতন গাড়ির চলাচল বন্ধ করে দিতে হবে। অতিরিক্ত যাত্রী ও মালামাল পরিবহনের জন্য চালকদের শাস্তি ও জরিমানার বিধান করতে হবে। 

৪। চালকদের প্রশিক্ষণ : চালকদের জন্য সরকারি পর্যায়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। তাদের সামাজিক দায়িত্ববােধ ও বিভিন্ন । রীতিনীতি শেখানাে উচিত। অধিকাংশ চালক সমাজসচেতন নয়। তারা মানুষের জীবনের মূল্য সম্পর্কে জানে না। তাই তাদের এসব বিষয়ে সচেতন করে তুলতে হবে । 

৫। ডাইভার বা চালকের সতর্কতা : গাড়ির চালক যদি সতর্ক থাকেন তাহলে অনেক ক্ষেত্রেই সড়ক দুর্ঘটনা এড়ানাে সম্ভব। চালককে গাড়িতে উঠে প্রথমেই জেনে নিতে হবে গাড়ির ইঞ্জিনের অবস্থা, চাকার অবস্থা, তেলের অবস্থা। এসব ত্রুটিমুক্ত থাকলেই সে গাড়ি চালাবে অন্যথায় নয়। এরপর গাড়ি চালানাে অবস্থায় চালক কারও সাথে কথা বলতে পারবে না এবং অন্য কেউ তার সাথে অযথা কথা বলতে পারবে না । গাড়ির চালককে সবসময় মনে রাখতে হবে যে, এ গাড়ির সমস্ত যাত্রীর জীবন আমার কাছে জিম্মি। মনের আনন্দে কিংবা মনের দুঃখে গাড়ি চালানাে যাবে না। চালককে সামনে, ডানে, বামে সর্বদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। কোন রাস্তায় কী পরিমাণ গতিবেগ সে সম্পর্কে খেয়াল রেখে গাড়ি চালাতে হবে। চালককে ট্রাফিক আইন অবশ্যই মেনে চলতে হবে। দূরপাল্লার পথে অবশ্যই দুজন দক্ষ চালক থাকতে হবে। 

৬। লাইসেন্সধারী অর্থাৎ অভিজ্ঞ চালক : লাইসেন্সবিহীন কিংবা অনভিজ্ঞ চালক কর্তৃক কখনাে গাড়ি চালানাে উচিত নয়। এদিকে | গাড়ির মালিককে এবং ট্রাফিক পুলিশকে অবশ্যই সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে।

৭। চালকের অতিলােভ : প্রায়ই দেখা যায়, চালক লােভের বশবর্তী হয়ে অতিরিক্ত যাত্রী বোেঝাই করে। এমনকি বাসের ভিতরে যাত্রী উপরে মাল বােঝাই করে । এতে করে তার নিধারিত সময়ের অনেকটাই রাস্তায় নষ্ট হয়ে যায়। ফলে শুরু হয় কতগতিনে গাড়ি চালানাে। কোনাে দিকে লক্ষ না করে ওভারটেক করার চেষ্টা করে। একে অপরের আগে যাওয়ার তীব্র প্রতিদ্বন্দিতা শুরু হয়। ফলে দুর্ঘটনা ঘটে। মরে যাত্রী, পালায় চালক। অতএব, চালককে সংযমী হতে হবে।

৮। রিকশা চালকদের সতর্কতা : কখনাে কখনাে দেখা যায়, রিকশা চালকদের ভুলের কারণে দুর্ঘটনা ঘটে। বিশেষ করে মহানগরীগুলাে এবং বড়াে বড়াে শহরে অতিরিক্ত রিকশা চলাচল করে। রিকশা চালকদের অধিকাংশই কোনাে নিয়মকানুন জানে না। ফলে বাস, ট্রাকের তলায় চাপা পড়ে দুর্ঘটনার শিকার হয়। তাই রিকশা চালকদের সম্পর্কে কর্তৃপক্ষের চিন্তা করতে হবে। লাইসেন্সবিহীন রিকশা চালনা বন্ধ করতে হবে এবং লাইসেন্সধারীদের ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা করতে হবে। 

৯। কর্তৃপক্ষের সতর্কতা ও কঠোরতা অবলম্বন : প্রায়শ দেখা যায়, ঢাকা-খুলনা, ঢাকা-উত্তর বঙ্গ, ঢাকা-আরিচা, ঢাকা-চট্টগ্রাম,ঢাকা-নরসিংদী ও ঢাকা-সিলেটের মতাে ব্যস্ততম এবং দীর্ঘ পথেও কর্তৃপক্ষের চোখের সামনে ত্রুটিপূর্ণ অর্থাৎ ফিটনেসবিহীন গাড়ি, লাইসেন্সবিহীন ড্রাইভার ছাদে লােক ভর্তি অবস্থায় কিংবা ভিতরে অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে এবং ছাদে মাল বােঝাই অবস্থায় গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে। এ সময় কর্তৃপক্ষ বা ট্রাফিক পুলিশ উদাসীনতা প্রদর্শন করেন কিংবা কর্তব্যে অবহেলা করেন অথবা উৎকোচ গ্রহণের মাধ্যমে চলাচলের অনুমতি দেন। এটি অবশ্যই দুঃখজনক ও নিন্দনীয়। এ অন্যায় অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। দেখা যায় রাস্তা ভাঙা, ব্রিজ দুর্বল ও বিপজ্জনক এ তথ্য কর্তৃপক্ষ জেনেও উদাসীনতা প্রদর্শন করেন, ফলে দুর্ঘটনা ঘটে। ফেরির সামনে কোনাে বাধা নেই, ফেরিতে ওঠার রাস্তাটিও বিপজ্জনক অথচ কর্তৃপক্ষ উদাসীন। এসকল ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষকে সচেতন ও কঠোর হতে হবে। 

১০। বেপরােয়া ট্রাক-চালকদের নিয়নণ : ট্রাক মানেই হলাে একটি যন্ত্রদানব। মানুষের দেহ থেতলে দেওয়াই যেন এর তৃপ্তি ও আনন্দ এবং সড়ক দুর্ঘটনার একটা বড়াে কারণ ট্রাক। তাই ট্রাক দেখলেই মানুষ আতঙ্কিত হয়ে যায়। এর কারণ ট্রাক নয় ট্রাক চালক। এরা ট্রাক চালায় বেপরােয়াভাবে। এদের অধিকাংশই মাদকাসক্ত। তাই মাদকাসক্ত ট্রাক চালকের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। এদের লাইসেন্স বাতিল করতে হবে। দিনের বেলায় শহর এলাকায় ট্রাক চলাচল নিষিদ্ধ করতে হবে। এ আইন অমান্যকারীকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। 

উপসংহার : সড়ক দুর্ঘটনা এড়াতে হলে সকল যানবাহন চালককে সচেতন, সতর্ক ও সাবধান হতে হবে। তাদেরকে ট্রাফিক আইন মেনে চলতে হবে। প্রতিটি চালককে হতে হবে দক্ষ। দক্ষ চালক ব্যতীত ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়া যাবে না । ত্রুটিপূর্ণ গাড়ি চালানাে যাবে না। প্রত্যেক ড্রাইভারকে অবশ্যই মদ, গাঁজাসহ সকল প্রকার মাদকদ্রব্য সেবন থেকে মুক্ত থাকতে হবে। সর্বোপরি সড়ক দুর্ঘটনা রােধকল্পে সরকারকে কঠোর আইন প্রণয়ন করতে হবে এবং প্রতিটি সড়ক দুর্ঘটনার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত করে দোষী । ব্যক্তিকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। এতে কোনাে দল, সংগঠন কিংবা সমিতির আন্দোলন কিংবা কোনাে প্রকার চাপের কাছে নতি স্বীকার করা যাবে না। আর এভাবেই সড়ক দুর্ঘটনা রােধ করা সম্ভব হতে পারে।
Next Post Previous Post