বাংলা রচনা : মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আমাদের দেশপ্রেম

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আমাদের দেশপ্রেম
বাংলা রচনা : মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আমাদের দেশপ্রেম

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আমাদের দেশপ্রেম

[ সংকেত: ভূমিকা; মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পটভূমি; মুক্তিযুদ্ধের চেতনার স্বরূপ; মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও দেশপ্রেম; দেশপ্রেমের উৎস ও । প্রভাব; মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বাংলাদেশ; বর্তমান সমাজ-বাস্তবতায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা; উপসংহার । ]

ভূমিকা :
স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে,
কে বাঁচিতে চায় ? 
দাসত্ব শৃঙ্খল বল কে পরিবে পায় হে,
কে পরিবে পায়।

একটি সভ্য জাতির বেচে থাকার সর্বোত্তম অবলম্বন হলাে স্বাধীনতা তথা মক্তি। পরাধীনতার গ্লানি, বেষম্যের পাখা এবং গলা ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসন থেকে মুক্তির আশায় বাংলাদেশের সর্বস্তরের জনগণ ১৯৭১ সালে বর্বর পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে এম মুদ্ধি করে স্বাধীনতার রক্তিম সূর্যকে ছিনিয়ে আনে। ত্রিশ লক্ষ শহিদের আত্মত্যাগ ও দুই লক্ষ মা-বােনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে আমরা যে স্বাধীনতা অর্জন করেছি তার মলে রয়েছে বাঙালি জাতির ঐক্যের চেতনা, সাম্যের চেতনা, মুক্তির চেতনা । আবহমানকাল থেকে এই চেতনা আমাদের প্রেরণা যুগিয়েছে, ঐক্যবদ্ধ করেছে এবং উন্নয়নের দিক-নির্দেশনা দিয়েছে। 

মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পটভূমি : ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে এই উপমহাদেশের মুক্তিলাভ হলেও বাঙালি জাতির প্রকৃত মুক্তি আসেনি। পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের শােষণ ও শৃঙ্খলের জটিল জালে বন্দি হয় বাঙালি জাতি । ১৯৫২ সালের মহান ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্র আন্দোলন, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয়দফা, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান এবং ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে বাঙালি জাতি শােষণ ও বঞ্চনা থেকে মুক্তির আশায়। ঐক্যবদ্ধ হয়। বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে একটি উদার-অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আশায় ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সর্বস্তরের জনগণ একত্রিত হয় দেশমাতৃকার মুক্তি সংগ্রামে। দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালে চূড়ান্ত। বিজয় লাভ করে বাঙালি জাতি । এরপর নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতির আলােকে গড়ে ওঠে বাঙালির সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় প্রেক্ষাপট। বাঙালির রক্তে রঞ্জিত উর্বর ভূমি বাঙালিকে লালন করছে সগৌরবে । ফলে বাঙালি গড়ে তুলেছে নতুন গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা। মূলত ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে আমাদের যে সংস্কৃতি গড়ে উঠছিল তার মূলে ছিল মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা । কিন্তু স্বাধীনতাবিরােধী চক্রের চক্রান্তে সে চেতনা বারবার আঘাতিত হয়েছে। 

মুক্তিযুদ্ধের চেতনার স্বরূপ : মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ধর্মীয় কুসংস্কার ভুলে গিয়ে বাঙালি হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান একই পতাকাতলে। সমবেত হয়। বাঙালির আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে নতুন প্রেরণা দান করে মুক্তিযুদ্ধ । আমাদের সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে মুক্তিযুদ্ধ। বাঙালি জাতি আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার লাভ করে বিশ্বের দরবারে নিজেদের স্বতন্ত্র সত্তাকে উপস্থাপন করতে সক্ষম। হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে। 

যে অসাম্প্রদায়িক চেতনা লালন করে বাঙালি এগিয়ে চলেছে তার গতি সুস্থিত নয় । মাঝে মাঝে জাতীয় মতানৈক্যের অভাবে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নানা অস্থিরতা দেখা দেয়। অন্যদিকে, কিছু গােষ্ঠীর সাম্প্রদায়িক চেতনা ও কর্মকাণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত করছে মূল চেতনা তথা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে। লাল-সবুজ পতাকাতলে মানুষ কোনাে ধর্মীয় চেতনায় ঐক্যবদ্ধ হয়নি বরং সকল ধর্মীয় কুসংস্কার ও বিভেদ ভুলে গিয়ে মানবতাবােধের চেতনায় উজ্জীবিত হয়েছিল । সুতরাং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শানিত হয়ে আমাদের দেশকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া আমাদের আবশ্যিক ও নৈতিক দায়িত্ব। 

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও দেশপ্রেম : মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাথে ওতপ্রােতভাবে জড়িয়ে আছে বাঙালির দেশপ্রেম । ঐক্যবদ্ধ জাতি দেশপ্রেমের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে । এমনকি অতীতের সকল সংগ্রামেও দেশপ্রেমই ছিল অন্যতম চালিকা শক্তি। স্বদেশ, স্বভাষা ও স্বজাতির প্রতি ভালােবাসার চূড়ান্ত অভিব্যক্তি হলাে ১৯৭১ সালের মুক্তি সংগ্রাম । এ সময় বাঙালি জাতি নতুন করে জেগে ওঠে। ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭১ সাল এই দীর্ঘ ২৩ বছর পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠী তিলে তিলে নিঃশেষিত করেছে বাঙালি জাতিকে । কেড়ে নিতে চেয়েছে মুখের ভাষা, বঞ্চিত করেছে ন্যায্য অধিকার থেকে। শত বছরের শােষণ-বঞ্চনা থেকেই বাঙালির দেশাত্মবােধ তার অস্থিমজ্জায় শক্তপােক্তভাবে, গেড়ে বসেছে । বাঙালির সাহিত্য চর্চায়ও আমরা পাই মুক্তিযুদ্ধ ও দেশপ্রেমের চেতনা। গল্পে, কবিতায়, গানে, নাটকে, উপন্যাসে প্রকাশিত হয়ে আসছে মুক্তিযুদ্ধ ও দেশপ্রেমের চেতনা। তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধের পর দেশাত্মবােধক গানের একটা নতুন জোয়ার পরিলক্ষিত হয় । আমাদের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রেও ব্যাপকভাবে দেশপ্রেম প্রতিফলিত হয়ে আসছে। 

দেশপ্রেমের উৎস ও প্রভাব :
স্বদেশের উপকারে নেই যার মন
কে বলে মানুষ তারে? পশু সেইজন ।

স্বদেশ ও স্বজাতির প্রতি প্রেমহীন মানুষ বিবেকবর্জিত। সকল মানুষের অন্তরে সুপ্ত থাকে স্বদেশপ্রেমের চেতনা । আত্মসম্মান, পরিশুদ্ধ। ভাবাবেগ ইত্যাদি থেকে স্বদেশপ্রেমের উদ্ভব হয়। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধে আমাদের ঐক্যবদ্ধ স্বদেশপ্রেমের পরিচয় মিলে ।। স্বদেশপ্রেমের চেতনায় উজ্জীবিত মানুষের মন-মানসিকতায় সংকীর্ণতা ও স্বার্থপরতা স্থান পায় না। স্বদেশপ্রেম মানুষকে উদার হতে। সহযােগিতা করে। রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী, কবি, সাহিত্যিক, শিক্ষক, চিকিৎসক, বিজ্ঞানী সবাই তাদের আপন কর্মের মাধ্যমে স্বদেশপ্রেমের প্রকাশ ঘটিয়ে থাকে। তাদের প্রদীপ্ত চেতনাবােধে উদ্বুদ্ধ হয়ে সাধারণ মানুষ দেশপ্রেমের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে প্রেরণা পায় । 

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বাংলাদেশ : শােষণ-বঞ্চনাহীন স্বাধীন-সার্বভৌম পবিত্র ভূমিতে বেঁচে থাকার দৃঢ় অভীপ্সায় ১৯৭১ সালে মানুষ। মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সকল শ্রেণির মানুষের মৌলিক চাহিদা ও অধিকার আদায়ের চেতনা হলাে মুক্তিসংগ্রাম। কষক, শ্রমিক, ছাত্র, জনতাসহ সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ তাদের ন্যায্য অধিকারের জন্য সংগ্রাম করে । পরিকল্পিত কৃষি ও শিল্প বিপ্লবের মাধ্যমে। আত্মনির্ভর বাংলাদেশ গড়াই ছিল তাদের লক্ষ্য। এই মহান মুক্তিযুদ্ধে আত্মােৎসর্গকারী বীর মুক্তিযােদ্ধারাই আমাদের জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান । জাতি শ্রদ্ধার সাথে চিরদিন তাদের অবদানকে মূল্যায়ন করবে ।

বর্তমান সমাজ বাস্তবতায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা : মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা পেয়েছি মুক্ত-স্বদেশ ভূমি । কিন্তু কতটুকু রক্ষা। করতে পেরেছি এই চেতনা তা আজ প্রশ্নবিদ্ধ। সমাজ জীবনে চরম অবক্ষয় আজ জাতিকে দিশেহারা করে তুলেছে। নানা অনিয়মদুনীতি আজ মহামারির মতাে জাতীয় জীবনের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে । আমাদের যুবসমাজও আক্রান্ত এই অবক্ষয়ের করাল গ্রাসে । তাছাড়া রাজনীতিক অস্থিতিশীলতা ও ঐক্যের অভাব আমাদেরকে দ্বন্দ্ব, কলহ, দুর্দশা ও নৈরাজ্যের ভেতর টেনে নিয়ে যাচ্ছে। প্রতিনিয়ত। মানবতাহীন, নিষ্ঠুর কাজ করতে মানুষের বিবেক আর বাধা দেয় না। এ অবস্থায় আমাদের প্রয়ােজন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়। প্রতিষ্ঠিত দুর্নীতিমুক্ত ও কল্যাণমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা। আমাদের প্রকৃত গৌরবগাথার ইতিহাস ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে বেশিমাত্রায় উপস্থাপন করা উচিত। যে আদর্শ, লক্ষ্য ও চেতনা ধারণ করে জীবন আত্মেসর্গ করেছে বাংলার আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা, সেই আদর্শ ও চেতনাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করা আমাদের অবশ্য কর্তব্য। 

উপসংহার : দেশপ্রেমের যেমন বিকল্প নেই তেমনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাও আজ অপরিহার্য । ১৯৭১ সালে আমরা রাজনীতিক ও তখণ্ডগত স্বাধীনতা অর্জন করেছি। এই চেতনাকে আমাদের ব্যক্তিগত, সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, আর্থনীতিক ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে ছড়িয়ে দিয়ে চিরস্থায়ী রূপ দেওয়ার চিন্তা করতে হবে। তবেই সার্থক হবে আমাদের সকল ত্যাগ, সকল উৎসর্গ । তবেই মানুষ দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে লালন ও পরিচর্যা করতে পারবে ।
Next Post Previous Post