বাংলা রচনা : একক সন্ধ্যায় বসন্ত

বাংলা রচনা : একক সন্ধ্যায় বসন্ত
একক সন্ধ্যায় বসন্ত


একক সন্ধ্যায় বসন্ত


[সংকেত : ভূমিকা; বাংলাদেশের ঋতুচক্রে বসন্ত; বাসন্তী সন্ধ্যার পূর্বমূহুর্ত; একক সন্ধ্যায় বসন্ত; বাসন্তী সন্ধ্যায় নৈসর্গিক সৌন্দর্য; বসন্তের সন্ধ্যায় প্রকৃতি ও পরিবেশ; মানব হৃদয়ে বসন্ত সন্ধ্যার প্রভাব; বসন্তের সন্ধ্যায় প্রেমিক হৃদয়ের অবস্থা; উপসংহার ]

ভূমিকা : ষড়ঋতুর দেশ বাংলাদেশ। বাংলাদেশে প্রতিটি ঋতু পালাবদল করে আসে । গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত, বসন্ত— এ ছয় ঋতুতেই বাংলাদেশের প্রকৃতি নানারূপে আবির্ভূত হয়। ছয়টি ঋতু পালাক্রমে বারবার ফিরে আসে। ঋতু বদলের পালায় বাংলাদেশের প্রকৃতিতে বসন্ত আসে তার অপরূপ সৌন্দর্যের কারুকাজ নিয়ে। অপার সৌন্দর্যে প্রকৃতিকে ভরে তােলে বলে বসন্তকে ‘ঋতুরাজ বলা হয়। বসন্তের সন্ধ্যায় প্রকৃতির লীলা নিকেতনে পুষ্প-শােভিত নতুন রূপের দ্বার উন্মােচিত হয়। আর সেই রূপের ঝলকে মানুষের মন আনন্দে নেচে ওঠে ।

বাংলাদেশের ঋতুচক্রে বসন্ত : শীতের কাপন শেষে ঋতুরাজ বসন্ত আসে তার অনাবিল সৌন্দর্যের পসরা নিয়ে । বসন্তের দখিনা হাওয়ার মৃদুমন্দ ছোঁয়া লেগে ঘুমন্ত প্রকৃতি জেগে ওঠে। প্রকৃতি ফিরে পায় তার হারানাে যৌবন । বসন্ত গাছে গাছে, ফুলে ফুলে, পাতায় পাতায় নতুন সাজে প্রকৃতির বুকে ভ্রমরের গুঞ্জনে, আনন্দ-শিহরণ জাগায় । মধুমক্ষিকার গুনগুন সুর এক মােহনীয় আবেশের মাঝে কোকিল, দোয়েল আর শ্যামা গানে গানে বিমােহিত করে রাখে প্রকৃতি। বনের পথে পথে বেজে ওঠে পাতার বাঁশি। কবির কণ্ঠে উচ্চারিত হয়—

ওরে ভাই, ফাগুন লেগেছে বনে বনে—
 ডালে ডালে ফুলে ফুলে পাতায় পাতায় রে,
আড়ালে আড়ালে কোণে কোণে ॥
রঙে রঙে রঙিল আকাশ, গানে গানে নিখিল উদাস—

বসন্ত যেন তার সব রূপ মাধুর্য নিয়ে বাংলার প্রকৃতিতে ছড়িয়ে পড়ে।

বাসন্তী সন্ধ্যার পূর্বমুহূর্ত : বাংলার প্রকৃতিতে বসন্তের অপরূপ সৌন্দর্যে মােহনীয় হয়ে ওঠে সন্ধ্যার পূর্বমুহূর্তে। পশ্চিমাকাশে সূর্য। যখন ঢলে পড়ে তখন গােধূলি বেলার সূর্যের লাল আভায় পৃথিবী যেন রঙিন সাজে সেজে ওঠে। গাছের পাতায় আলাের নাচন মানুষের মনকে মােহিত করে। তখন এই আলাে আঁধারির দশ্য মােহময় লীলাক্ষেত্রে পরিণত হয়। বসন্তের সন্ধ্যায় আকাশের সাদা মেঘগুলাে রঙিন হয়ে যায়। এমন রূপ দেখে কবির মন গেয়ে ওঠে—

এই ক্ষণে এসাে তুমি এসাে আজ ফিরে
বসন্ত সন্ধ্যার এই সৌন্দর্যের ভিড়ে । 


একক সন্ধ্যায় বসন্ত: বসন্তের আগমনে মানুষের মন আনমনা হয়ে যায়। বসন্তের নির্জন সন্ধ্যায় দিনান্তের সব কথা মানব হৃদরে উর। করে। নিজের একান্ত বাসনাগুলাে কারও সাথে ভাগ করে নেওয়ার জন্য মন ব্যাকুল হয়ে ওঠে। এই নিঃসঙ্গ সন্ধ্যায় হৃদয়ে জেগে ওঠে এক অজানা ভালাে লাগা। একক এই বসন্ত সন্ধ্যায় প্রকৃতির সংস্পর্শে প্রেমিক হৃদয় আপ্লুত হয়ে যায়। এই সন্ধ্যাকে মনে হয়। জীবনের এক স্মরণীয় মুহূর্ত। এরই পরিচয় মেলে বিভিন্ন কবিতায় । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর 'বসন্ত' কবিতায় লিখেছেন—

আবর্তিয়া ঋতুমাল্য করে জপ, করে আরাধন
দিন গুনে গুনে। সার্থক হল যে তার বিরহের বিচিত্র সাধন
মধুর ফারুনে। 

বাসন্তী সন্ধ্যায় নৈসর্গিক সৌন্দর্য : বসন্তের সন্ধ্যায় প্রকৃতির সৌন্দর্য যেন দিগন্ত জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। কোকিলের মধুর কু-উ-কু-উ শব্দ মানুষের মনকে আলােড়িত করে। দক্ষিণা হাওয়ায় ভেসে আসে মনমাতানাে ফুলের সুবাস। ভরাবসন্তে শিমুল আর পলাশ ফুলে। ফলে চারদিক সুন্দর সাজে সজ্জিত হয়। মহুয়ার সুবাসে সুবাসিত মনােমুগ্ধকর মৃদু সমীরণ বসন্তের সন্ধ্যার নেসাগক সােন্দথকে আরও বাড়িয়ে দেয়। বসন্তের আকাশ দিনের শেষে কালাে বর্ণ ধারণ করে। সেই কালাে আকাশের গায়ে ফুটে ওঠে লক্ষ লক্ষ তারার মেলা, যেন প্রেমিকার শাড়িতে প্রেমিকের প্রেম মেশানাে কারুকার্য। বসন্তের আকাশে চলে অবিরাম আনন্দ আর রঙের খেলা। বাসন্তা সন্ধ্যায় নৈসর্গিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে কবি লিখেছেন—

আজি সবার রঙে
রঙ মিশাতে হবে। 

বসন্তের সন্ধ্যায় প্রকৃতি ও পরিবেশ : অন্যান্য সন্ধ্যার চেয়ে বসন্তের সন্ধ্যা একটু অন্যরকম। বসন্তের সন্ধ্যায় প্রকৃতি যেন নতুন। পােশাক পরিধান করে। গাছে গাছে নতুন পাতা গজায়, ফুলে ফুলে ভরে ওঠে প্রকৃতি। সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে সৌন্দর্যের এক নব সুরের আমেজ। বাংলার বনে বনে ফুলের অপরূপ রূপ, গাছে গাছে কোকিলের গান। বসন্তের প্রকৃতি ফুলে ফুলে পূর্ণ, বসন্তের কোকিল ক্ষণে ক্ষণে গায় ‘এমন ক্ষণে, কোথায় গাে তুমি’ । বসন্তের প্রকৃতির রূপে মুগ্ধ কবি আনমনে গেয়ে ওঠেন—

ওগাে দখিনা মলয়, আজি তব পরশনে
কার কথা পড়ে মনে ।
মধূপ হয়েছে আজি পাগল পারা
কুসুমে কুসুমে তাই জেগেছে সাড়া । 

মানব হৃদয়ে বসন্ত সন্ধ্যার প্রভাব : বসন্তের আগমনে মানব হৃদয় দুলে ওঠে । অজানা আনন্দে মানুষের মন চঞ্চল হয়ে যায় । বসন্তের একক সন্ধ্যায় মানব পেতে চায় মানবীর হাতের কোমল স্পর্শ । বসন্তের প্রকৃতির বিচিত্র আনন্দ ছড়িয়ে পড়ে মানব হৃদয়ে । মানব হৃদয় হয়ে ওঠে আনমনা । মানুষের কাছে চিরচেনা পৃথিবীটা বসন্তের আবির্ভাবে আরও সুন্দর হয়ে ওঠে। বসন্তের সন্ধ্যায় মানুষের মন আনন্দলােকে বিচরণ করার অজুহাত খুঁজে পায় । বসন্ত মানুষের জীবনকে নতুনরূপে দেখার সুযােগ করে দেয় । বলা যায়, বসন্তের সন্ধ্যা মানুষের হৃদয়কে সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ করে ।

বসন্তের সন্ধ্যায় প্রেমিক হৃদয়ের অবস্থা : বসন্তের সন্ধ্যা প্রেমিক হৃদয়কে আনমনা করে তােলে। বসন্তে প্রেমিক প্রেমিকাকে কাছে পেতে চায়। কারণ সন্ধ্যায় পৃথিবীর সমস্ত প্রেম জেগে ওঠে। বসন্ত সন্ধ্যার নিস্তব্ধতা ও সৌন্দর্যে পূর্ণ প্রকৃতি প্রেমিকের হৃদয়ে প্রেমিকাকে কাছে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি করে। বসন্ত সন্ধ্যায় নিকষ কালাে আকাশ যেমন তারাদের আলিঙ্গন করে তেমনি প্রেমিকও তার নিঃসঙ্গতা ঘােচাবার জন্য প্রেমিকার সঙ্গ কামনা করে । বসন্তের আগমনে প্রকৃতি যেমন সাজে তেমনি প্রেমিকের মনও প্রেমে উন্মাতাল হয় । বসন্তের সন্ধ্যায় বিশ্ব সংসারে প্রেমের তরঙ্গ বয়। আর সে প্রেমের তরঙ্গ সুর খুঁজে পায় প্রেমিকের হৃদয়ে। বসন্ত সন্ধ্যা মানবের তরে মায়াময় মুহূর্ত সৃষ্টি করে। আর তাই বসন্ত সন্ধ্যায় প্রেমিক হৃদয় তার মানসীকে খুঁজে বেড়ায়। বসন্তের সন্ধ্যায় প্রিয়াবিহনে প্রেমিক হৃদয় হয় বিরহে কাতর ।

উপসংহার : ঋতুচক্রের আবর্তে প্রতি বছরই বসন্ত আসে এক নবীনরূপে। বসন্ত সন্ধ্যার সৌন্দর্যের কোনাে শেষ নেই। তেমনি মানব হৃদয়ও এ সময় আনন্দে পূর্ণ হয়। আর এ আনন্দের কোনাে সীমা-পরিসীমা থাকে না। প্রকৃতির সাথে মিলেমিশেই মানবজীবন বেড়ে ওঠে। মানুষ তার হৃদয়ের প্রশান্তি পেতে প্রকৃতির কাছেই বারবার ফিরে যায়। প্রকৃতি থেকেই মানুষ নিজের আনন্দকে খুঁজে নিয়ে। জীবনকে করে তােলে আরও আনন্দময় । আর বসন্তের সন্ধ্যা মানুষের এই হৃদয়ের সুপ্ত ভালােবাসাকে জাগিয়ে তুলে নিয়ে যায় নতুন এক আনন্দলােকে।
Next Post Previous Post