বাংলা রচনা : একটি বর্ষণমুখর সন্ধ্যা

একটি বর্ষণমুখর সন্ধ্যা
একটি বর্ষণমুখর সন্ধ্যা

একটি বর্ষণমুখর সন্ধ্যা
অথবা, শ্রাবণ সন্ধ্যা অথবা, বর্ষণমুখর দুপুর
অথবা, বাদল দিনে
অথবা, বৃষ্টিভেজা দিন।


সংকেত: ভূমিকা; বর্ষণমুখর দিনের অবসান; শ্রাবণ সন্ধ্যার রূপ; শ্রবণ সন্ধ্যার প্রভাব; কাব্য সৃষ্টির আবেদন; উপসংহার ।

ভমিকা : গােরক গ্রাম বিদায় হওয়া মাত্র নীল নবঘন আষাঢ়ের পথ ধরে বাংলার ঋতুচক্রে সজল বর্ষার আগমন ঘটে মহাসমারােহে। শাবণে এসে বষা তার রূপ-ঐশ্বর্য আরও অধিক মাত্রায় ছড়িয়ে দেয় বাংলার নিসর্গ-নিলয়ে । নিরবচ্ছিন্ন বৃষ্টিধারায় তৃষ্ণার্ত ধরিত্রীকে কানায়-কানায় পূর্ণ করে তােলে। রুপালি বৃষ্টির কাক্ষিত স্পর্শে সদ্য ফোটা কদমফুল স্নাত হয়ে বাদলা হাওয়ায় দোলে আর তার সমিষ্ট বুনাে ঘ্রাণ বাতায়নবতী উদাসীর প্রাণে জাগায় ব্যাপক চঞ্চলতা। রবিঠাকুর গেয়েছেন-

এসাে নীপবনে ছায়াবীথি তলে
    এসাে করাে স্নান নবধারা জলে । 


সত্যিই সারাদিনমান অঝাের ধারা বর্ষণের মাঝে রুদ্ধদ্বার বদ্ধঘরে আবদ্ধ থেকে কোনাে এক অজানার আকর্ষণে সমস্ত মন-প্রাণ উদাসআকুল হয়ে থাকে। এক অপূর্ব মাদকতাপূর্ণ শিহরণ জাগে সর্বাঙ্গ জুড়ে । কী জানি একটা অনির্বচনীয় অভাববােধ সমগ্র ভাব-চৈতন্যকে আচ্ছন্ন করে রাখে। যেন কোনাে জনান্তক বা জনান্তিকার জন্য গভীর এক বেদনাভারাক্রান্ত অব্যক্ত ভাব মনের ভেতর গুমরে মরে । তাই বুঝি কবিগুরু বলেছেন

এমন দিনে তারে বলা যায়।
এমন ঘনঘাের বরিষায় । 

কিন্তু কী যে সেই ভাষা আর কাকেই বা বলার সেই আশা, সারাদিন ভেবেও .রি কুল পাওয়া যায় না। শুধু বিরহকাতর অনুভূতিতে অনুরণিত হয় মেঘ-মল্লার সুললিত তান।

বর্ষণমুখর দিনের অবসান : সারাদিন বৃষ্টির অবিরাম খেলা চলে আকাশের কোল জুড়ে। জলনূপুর পায়ে শ্রাবণ সমস্ত দিন ভর অশ্রান্ত নৃত্য করে প্রকৃতির শ্যামল আঙিনায় । তখন ঘন কালাে মেঘে আকাশের মুখ যেন বিষাদে ছেয়ে থাকে। মাঝে মাঝে খােলা তরবারির মতাে চমকে ওঠে বিদ্যুত্সালা আর গুরুগম্ভীর বজ্র নিনাদে থেকে থেকে কেঁপে ওঠে শ্রান্ত প্রকৃতি। মনে হয় শ্রাবণের এই অঝাের ধারার বুঝি শেষ নেই। তাই মেঘের আড়ালে কখন সকাল গড়িয়ে দুপুর হয় এবং দুপুর গড়িয়ে বিকেল, তার কিছুই টের পাওয়া যায় না । একসময় সমস্ত ভাবনাকে বিষন্ন আবেগে ভাসিয়ে শ্রাবণ সন্ধ্যার ঘন অন্ধকারে জগৎ-সংসার ক্রমশ তলিয়ে যায় । শ্রাবণ সন্ধ্যার জমাটবাধা কালাে অন্ধকার আমাদের সমস্ত বিষন্নতাকে স্মৃতি রােমন্থনের দূর অতীতে নিয়ে যায়। বর্ষণমুখর সন্ধ্যার এমন প্রাকৃতিক পরিবেশে মানবমনের নিঃসঙ্গতা বহুগুণ বেড়ে যায়। তখন ইচ্ছা হয় অতীতের স্মৃতি-বিজড়িত দিনের গান শুনতে অথবা কবিতা আওড়াতে । তাই বর্ষাকে নিয়ে রচিত হয়েছে অসংখ্য গান ও কবিতা ।

 শ্রাবণ সন্ধ্যার রূপ : শ্রাবণ সন্ধ্যায় এক নিঃসীম কালাে অন্ধকার সমগ্র পৃথিবীকে মুহূর্তে গ্রাস করে ফেলে। তখন ভাষাহীন নীরবতায় নিকষ কালাে আঁধারের বুকে বিশ্ব-প্রকৃতি যেন তার বিভ্রান্ত-অবসন্ন শরীর এলিয়ে দেয়। কেবল অশ্রান্ত সঙ্গীতমুখর বর্ষণধারা এই নীরব সন্ধ্যাকে ছন্দময় করে তােলে । শ্রাবণের বর্ষণধারাই সন্ধ্যাকে গম্ভীর ও গূঢ় রহস্যময় অর্থে ভরে দেয়। তখন সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ড যেন এক নিবিড় আবেশে কোনাে এক পাতালপুরীর রাজ্যে হারিয়ে যায় । বর্ষণমুখর সন্ধ্যার এমন মৌন-মুহূর্ত গভীর আবেগে হৃদয়কে আপুত করে ।

প্রকৃতির এমন করুণ ও বিষন্ন রূপ আর কখনাে চোখে পড়ে না। সারাদিন অবিরাম বৃষ্টিধারায় পথ-ঘাট যেন জনমানবহীন বিরান প্রান্তর । মনে হয় কোথাও যেন প্রাণের সাড়া নেই, নেই জীবনের উচ্ছল কোলাহল । গাছের পাতায় অনেক দিনের জমাটবাধা অশ্রু যেন বর্ষার জল হয়ে অবিরাম ঝরে । এমন অশ্রু পতনের অনুপম আওয়াজ আমাদের মনকে অসীমের সন্ধানে নতুন এক কল্পনার জগতে নিয়ে যায় । আমরা তখন নিজেকে হারিয়ে ফেলি রূপকথার কোনাে এক অচিন রাজ্যে। আর এ মানবমনের এমন ভাবাশ্রিত কাল্পনিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতেই বুঝি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন,

মন মাের মেঘের সঙ্গী
 উড়ে চলে দিগ্‌-দিগন্তের পানে
নিঃসীম শূন্যে
শ্রাবণ-বর্ষণ সঙ্গীতে...। 

শ্রাবণ সন্ধ্যার এ রূপ আমাদের মনে বিশেষভাবে দাগ কেটে যায়। বর্ষার এমন অপরূপ রূপ দেখেই হয়তাে মহাকবি কালিদাস রচনা। করেছিলেন তাঁর অমর কাব্য ‘মেঘদূত’ আর বৈষ্ণব কবিরা রচনা করেছিলেন অসংখ্য পদাবলি ।

শ্রাবণ সন্ধ্যার প্রভাব : শ্রাবণের বর্ষণমুখর সন্ধ্যা অনুভূতিপ্রবণ স্মৃতিকাতর মানবমনে ব্যাপক প্রভাব | আর বষার চিত্তহারী গজল আমাদের চিরকালের মূক অন্তরকে স্বতঃস্ফূর্ত আবেগে বাত্ময় করে তােলে। মানুষের হৃদয়ের গভারতম প্রদেশকে করে আন্দোলিত । মেঘের গম্ভীর নাদ আকাশে বিজলির চমকিত আলােকসজ্জা আর ধারাপণের আমাদের অন্তলােকে জেগে ওঠে এক স্বভাব-সলভ বিরহ-ব্যথা । আমরা আমাদের বাস্তব অস্তিত ভুলে পরাবাস্তব সত্তায় ভর কমে আণবনায়। কল্পনালােকে হারিয়ে যাই। কখনােবা অতীত স্মৃতির এলবাম হাতড়িয়ে রােমাঞ্চকর রােমন্থনে সজীব করে তুল পেং বা অনুভূতির যাপিত প্রহরগুলাে । বর্ষণমুখর সন্ধ্যায় আমাদের হৃদয় যেন কার নিবিড় সান্নিধ্য লাভ করতে চায়। মন যেন কাকে না পাওয়ার চিরঅতৃপ্তিতে গুমরে গুমরে কাঁদতে থাকে। বাইরের প্রকতিতে এমন অবিরাম জলসিঞ্চন অথচ আমাদের অন্তরে জ্বলতে থাকে এক সহজাত বিরহ ব্যথার অনির্বাণ চিতা! কিন্তু তাকে তাে পাওয়া যাবে না । সে যে চির-অধরা; কেননা এই না পাওয়া বিরহের স্বরূপ নির্ণয়ও আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।

কাব্য সৃষ্টির আবেদন : কবির হৃদয়ে বর্ষার আবেদন অতল গভীর । মহাকবি কালিদাস থেকে শুরু করে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত বহু কবি বর্ষা নিয়ে অনেক কবিতা লিখেছেন। মেঘলা দিনের বর্ণনা, তার রূপ, আকাশের রং, মনের অবস্থা কালিদাসের কবিতায় কী। নিখুতভাবেই না মূর্ত হয়ে উঠেছে! বর্ষণমুখর শ্রাবণ সন্ধ্যা কাব্যিক ভাবে যেন আরও নেশা চড়িয়ে দেয়। এমন বিরহমধুর ভাবে। বিভাের চোখে মায়াঞ্জন বােলানাে নন্দিত প্রহরে আমাদের মন অব্যক্ত সুগভীর সুন্দর এক অনুভূতিতে ভরে ওঠে । সে অনুভূতি কী এক প্রগাঢ় বন্ধনে জড়িয়ে থাকে মনের আনন্দ-বেদনার সঙ্গে, সুরের সঙ্গে, গানের সঙ্গে। যদিও সে অনুভূতি চির অপ্রকাশ মৌনী আকাশের মতাে চিরগম্ভীর। যেন এই উপলব্ধির সঙ্গে জীবনের জটিল এক দর্শন মিশে আছে, যা অনিবার্য সত্যের আবর্তে অন্তরে বারংবার বিভাসিত হয়ে ওঠে। হয়তাে তা পরপারের চিন্তা— এই দুর্ভেদ্য অনিন্দ্য রহস্যের মাঝে অলখ শক্তিমানের সান্নিধ্য পাওয়ার প্রবল এক আকাক্ষা । তাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন

আষাঢ়সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলাে, গেল রে দিন বয়ে
বাঁধন-হারা বৃষ্টিধারা ঝরছে রয়ে রয়ে
একলা বসে ঘরের কোণে কী ভাবি যে আপন মনে
সজল হাওয়া যূথীর বনে কী কথা যায় কয়ে। 

উপসংহার : শ্রাবণ সন্ধ্যার বর্ষণমুখর প্রকৃতি মানবমনে বিচিত্র ভাবের জন্ম দেয় । মনের ভিতর ভাবের তােলপাড় আর বাইরে বৃষ্টির উচ্চাঙ্গ মেঘ-মল্লার রাগ মানুষের মনে গভীর প্রভাব বিস্তার করে। তাই মন্ত্রমুগ্ধের মতাে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে বর্ষণমুখর সন্ধ্যাটিকে। উপলব্ধির ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভােগ করা ছাড়া অন্যকিছু করার থাকে না। কবির কবিতা আর আমাদের মনের বীণা একই সরে বেজে। ওঠে

আজিকে বাহিরে শুধু ক্রন্দন ছলছল, জলধারে
বেণু-বনে বায়ু নাড়ে এলােকেশ, মন যেন চায় কারে ।

মন কাকে চায়? এই প্রশ্নের উত্তরে আমাদের হৃদয় আনন্দ-বেদনায় অশ্রু ঝরঝর ।
Next Post Previous Post